জোটে আছে ভোটে নেই

দীর্ঘদিনের জোট ২০ দলের সঙ্গে আগে থেকেই বিএনপির দূরত্ব প্রকাশ পাচ্ছিল। তাদের সঙ্গে থেকেও জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট নামে আরেকটি জোট গঠন করে ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে যায় বিএনপি। কিন্তু ড. কামাল হোসেন, আ স ম আবদুর রব, বঙ্গবীর আবদুল কাদের সিদ্দিকী, মাহমুদুর রহমান মান্নার মতো নেতাদের নিয়ে গড়া এই জোটও অকার্যকর প্রমাণ হওয়ায় এখন ঐক্যফ্রন্টের সঙ্গেও অনেক বিষয়ে বনিবনা হচ্ছে না বিএনপির। আবার তারা ২০ দলকে একপাশে রেখে ঐক্যফ্রন্ট গঠন করায় ওই পুরনো জোটের কিছু দল মিলে গড়ে ‘জাতীয় মুক্তিমঞ্চ’ নামে নতুন প্লাটফর্ম।

এমন নানা জটিলতায় পড়ে বিএনপি এখন যেন ‘একলা চলো নীতি’ নিয়েছে। বিভিন্ন সংসদীয় আসনের উপনির্বাচনে অংশ নেয়াসহ অনেক সিদ্ধান্তই তারা নিচ্ছে জোট শরিকদের সঙ্গে কোনো আলোচনা ছাড়াই, এককভাবে। বিএনপির এমন ‘একলা চলো নীতি’র পক্ষে সাফাই গেয়ে আবার দলটির নেতারাও বলছেন, জোট হয়েছে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের জন্য, নির্বাচনের জন্য নয়। এক্ষেত্রে জোট শরিকদের অবস্থা এখন- ‘জোটে আছে, ভোটে নেই’।

বিএনপি এবং তার দুই জোট ঐক্যফ্রন্ট ও ২০ দলের নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনে অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে ২০ দলকে গৌণ করে ঐক্যফ্রন্টকে সামনে রেখে এগোলেও পরবর্তী সময়ে বিএনপির বিভিন্ন সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে দুই জোটের মতামতই অগ্রাহ্য হয়েছে। সর্বশেষ পাঁচ সংসদীয় আসনের উপনির্বাচনে অংশ নেয়ার সিদ্ধান্তও বিএনপি নিয়েছে এককভাবে। অথচ এর আগে প্রতিটি নির্বাচনে অংশ নেয়ার বিষয়ে জোটগত সিদ্ধান্ত নেয়া হতো।

৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনের ফলাফল প্রত্যাখ্যান করে আবার সেই ফলাফলে বিজয়ী চারজনকে সংসদে পাঠিয়ে বিএনপি তখনই প্রশ্নের মুখে পড়ে। আবার এ সরকারকে অবৈধ বলে তাদের অধীনে কোনো নির্বাচনে অংশগ্রহণের বিরোধী হয়েও এখন কেন উপনির্বাচনগুলোতে বিএনপি জোটের মতামত ছাড়া অংশ নিচ্ছে, তা নিয়েও উঠেছে নানা প্রশ্ন।

jagonews24

দুই জোটের কয়েকজন নেতা বলেন, ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনের পর জোটগতভাবেই নির্বাচনী ফলাফল প্রত্যাখ্যান করা হয়েছিল। জোটগতভাবে সিদ্ধান্ত হয়েছিল, যে ক’জন বিজয়ী হয়েছেন, তারা শপথ নেবেন না। কিন্তু জোটের সেই সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করে পরে বিএনপি এককভাবেই তার চার সংসদ সদস্যকে শপথ পড়িয়ে সংসদে পাঠায়। এই ইস্যুতে ২০ দলীয় জোট ত্যাগ করে ব্যারিস্টার আন্দালিভ রহমান পার্থের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি- বিজেপি। আর জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট ত্যাগ করে বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বাধীন কৃষক-শ্রমিক জনতা লীগ।

ওই নেতারা বলেন, এত নাটকীয়তার পর একক সিদ্ধান্তে বিএনপি উপনির্বাচনে অংশ নেয়ায় দুই জোটে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। খোদ বিএনপির তৃণমূলও এই নির্বাচনে অংশ নেয়ায় প্রচণ্ড হতাশ। তৃণমূল নেতাদের মতে, ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করে সেই নির্বাচনে মাধ্যমে গঠিত সংসদে যোগ দিয়ে বিএনপি স্ববিরোধী আচরণ করেছে। এরপর জোটসঙ্গীদের মতামত না নিয়ে এই সরকারের অধীনে উপনির্বাচনে অংশ নিয়ে বিএনপি প্রকারান্তরে সরকারকে বৈধতাই দিচ্ছে।

তবে বিএনপি সূত্র বলছে, আন্তর্জাতিক বিশ্বে জামায়াত সম্পর্কিত নেতিবাচক ধারণার কারণে দলটির সঙ্গে সম্পর্ক গুটিয়ে আনার বিষয়টি তুলে ধরতেই বিএনপি এককভাবে এসব উপনির্বাচনে অংশ নিচ্ছে। বিএনপি বিদেশি বন্ধুদের কাছে জামায়াতের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করার বার্তা দিতে চাইছে এর মাধ্যমে।

দুই জোটের নেতারা বিএনপির সমালোচনা করে বলছেন, উপনির্বাচনে অংশগ্রহণ করবেন, সংসদে গিয়ে সরকারি সুযোগ-সুবিধা ভোগ করবেন, আবার সরকারকে অবৈধ বলবেন— এ ধরনের দ্বিচারিতার রাজনীতি বিএনপিকে আরও বেশি জনবিচ্ছিন্ন করে ফেলবে। যার মাশুল দিতে হবে আগামী দিনের রাজনীতিতে। তাছাড়া, উপনির্বাচনে যদি অংশ নেবেই, বিএনপির উচিত ছিল প্রার্থী মনোনয়ন দেয়ার আগে হলেও অন্তত জোট নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করা, যাতে ভোটের মাঠে সবাইকে পাশে পাওয়া যায়। তা না করার ফলে দুই জোটের দল বিএনপিকে মাঠে একাই থাকতে হচ্ছে।

jagonews24

বিএনপির এককভাবে উপনির্বাচনে অংশগ্রহণ সম্পর্কে জানতে চাইলে ২০ দলীয় জোটের শরিক বাংলাদেশ জাতীয় দলের চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট সৈয়দ এহসানুল হুদা জাগো নিউজকে বলেন, ‘জোট আছে কি-না, সেটাই তো সন্দেহ! ইতোমধ্যে জোটের অনেক নেতাও প্রকাশ্যে মন্তব্য করেছেন এ বিষয়ে। বিগত উপনির্বাচন ও সামনের উপনির্বাচন নিয়ে ২০ দলীয় জোটে কোনো আলোচনা হয়নি। এজন্য বিএনপিই দায়ী।’

তিনি বলেন, ‘আমি মনে করি বিএনপির উচিত ছিল প্রার্থী মনোনয়ন দেয়ার আগে জোট নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করা। তা না করে তারা মিডিয়ায় বলছেন, জোট তাদের সঙ্গে আছে। তাদের এই বক্তব্যের সঙ্গে আমি একমত নই। কারণ তারা নিজেরা প্রার্থী দেবে, আর আমরা তাদের সঙ্গে মাঠে কাজ করব, সেটা হতে পারে না। সমঝোতার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত হলে অবশ্যই মাঠে থাকতাম।’

জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের শরিক নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, ‘এসব উপনির্বাচনে বিএনপি এককভাবেই অংশ নিচ্ছে। কিন্তু এতে অংশ নিয়ে বিএনপিরও যেমন কোনো লাভ হবে না, জনগণেরও কোনো লাভ হবে না। এসবের মাধ্যমে বিএনপি ২-১ আসনে জিতলেও জনগণের কিছু আসে যায় না।’

জোট ছাড়া ভোটে যাওয়ার বিষয়ে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, জোট গঠন হয়েছে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের আন্দোলনের জন্য, নির্বাচনের জন্য নয়।

 

সূত্রঃ জাগো নিউজ