জীবনের শত বাধা পেরিয়ে সাফল্যের চূড়ায় ইউসুফ (আ.)

সুরা ইউসুফে আল্লাহ চরম প্রতিকূলতা অতিক্রম করে সাফল্যের শীর্ষে পৌঁছানো একজন নবীর জীবনসংগ্রামের কথা তুলে ধরেছেন। একজন মানুষকে বিলীন করে দিতে যত ধরনের চেষ্টা ও প্রচেষ্টা হতে পারে এবং যে যে মাধ্যম ব্যবহার করা যায় তার সবই ইউসুফ (আ.)-এর বিরুদ্ধে ব্যবহৃত হয়েছিল।

আপনজনদের শত্রুতা : মানুষ সবচেয়ে বেশি সাহায্য-সহযোগিতা পায় তার ঘর ও পরিবারের কাছ থেকে। কিন্তু ইউসুফ (আ.)-এর ঘটনার শুরু হয়েছে ভাইদের শত্রুতা দিয়ে। তারা তাঁকে ঘর থেকে বের করে দেওয়ার এবং বাবার চোখের আড়াল করার সর্বাত্মক চেষ্টা করেছে। তাঁকে ঘর থেকে বিতাড়িত করা হয় এবং কূপে নিক্ষেপ করা হয়। আবার যারা তাঁকে কূপ থেকে ওঠাল তারা ছিল দূর দেশের যাত্রী। এ অমূল্য রত্নের মর্যাদা তারা বুঝতে পারেনি। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘তারা তাকে বিক্রি করল সামান্য মূল্যে—মাত্র কয়েক দিরহামের বিনিময়ে। তারা ছিল তার ব্যাপারে নির্লোভ।’ (সুরা : ইউসুফ, আয়াত : ২০)

যৌবনের পরীক্ষা : আজিজে মিসরও (মিসরের তৎকালীন মন্ত্রিসভার প্রধান) তাঁকে দাস হিসেবে কিনে নিলেন। এরপর তিনি এমন পরীক্ষার মুখোমুখি হলেন—একজন যুবকের জন্য যা অতিক্রম করা দুঃসাধ্যপ্রায়। তাঁর ওপর এমন দাগ লাগানোর চেষ্টা হয়, যার পর একজন মানুষের পক্ষে সম্ভ্রান্ত সমাজে ওঠাবসা করা সম্ভব নয়। পৃথিবীর ইতিহাসে এমন দৃষ্টান্ত পাওয়া ভার যে কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে চারিত্রিক অভিযোগ আনা হয়েছে এবং সে ইউসুফ (আ.)-এর মতো আলোকদীপ্ত হয়েছে।

মিথ্যা অভিযোগে জেল : তাঁকে জেলে পর্যন্ত পাঠানো হয়, যেখানে চারিত্রিক অভিযোগে অভিযুক্ত ব্যক্তির কোনো সম্মান নেই। কিন্তু তাঁর সত্তাগত মণি-মাণিক্য সেখানেও দ্যুতি ছড়িয়েছে। তিনি প্রমাণ করেন, যাঁকে জেলে পাঠানো হয়েছে এবং অনুত্তম-অন্ধকার পরিবেশে ঠেলে দেওয়া হয়েছে, তিনি তার যোগ্য নন। তিনি মর্যাদাপূর্ণ অবস্থানের যোগ্য। এমনকি মানুষ তাঁর কাছে আসতে শুরু করল এবং নিজেদের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে তাঁর পরামর্শ গ্রহণ করতে লাগল।

জেল থেকে রাষ্ট্র পরিচালনায় : জেলের দুজন সঙ্গী স্বপ্ন দেখল এবং ইউসুফ (আ.)-এর কাছে তার ব্যাখ্যা জানতে চাইল। তিনি তাদের প্রথমে হিদায়াতের পথে আহ্বান জানালেন এবং তারপর ব্যাখ্যা বললেন। ব্যাখ্যা সত্য প্রমাণিত হলো। কিছুদিনের মধ্যে তিনি খ্যাতির শীর্ষবিন্দুতে পৌঁছে গেলেন। ফলে রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রের অভিভাবকরা বুঝতে পারেন যাঁকে তাঁরা জেলে পাঠিয়েছেন তাঁকে রাষ্ট্রের প্রয়োজন। বাদশাহ নির্দেশ দিলেন ইউসুফ (আ.)-কে মুক্তি দিয়ে রাষ্ট্র পরিচালনার কাজে যুক্ত করতে। কিন্তু তিনি পরিষ্কার বললেন, ‘তোমার মনিবের কাছে ফিরে যাও এবং জিজ্ঞেস করো, যে নারীরা হাত কেটে ফেলেছিল তাদের অবস্থা কী? নিশ্চয়ই আমার প্রতিপালক তাদের ছলনা সম্পর্কে সম্যক অবগত।’ (সুরা : ইউসুফ, আয়াত : ৫০)

ইউসুফ (আ.) তাঁর ওপর আরোপিত অপবাদের অবসান চাইলেন, যেন কেউ বলতে না পারে বিশেষ বিবেচনায় তাঁকে মুক্তি দেওয়া হয়েছে। অপবাদের কালো মেঘ সরে যাওয়া এবং তাঁর সঙ্গে যথাযথ ধারণা প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় তিনি বললেন, ‘আমাকে দেশের ধনভাণ্ডারের ওপর কর্তৃত্ব দিন। আমি তো উত্তম রক্ষক ও সুবিজ্ঞ।’ (সুরা : ইউসুফ, আয়াত : ৫৫)

স্বেচ্ছায় খাদ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বগ্রহণ : ইউসুফ (আ.) খাদ্য মন্ত্রণালয়ের মতো স্পর্শকাতর দায়িত্ব পেলেন। তাঁর ভাইয়েরা বিনীত হয়ে উপস্থিত হলো খাবার সংগ্রহের জন্য। তারা ইউসুফ (আ.)-কে চিনতে পারল। বলল, ‘তবে কি তুমিই ইউসুফ? সে বলল, আমি ইউসুফ আর এ আমার সহোদর। আল্লাহ আমাদের প্রতি অনুগ্রহ করেছেন। নিশ্চয়ই যে ব্যক্তি আল্লাহভীরু ও ধৈর্যশীল, আল্লাহ সেরূপ সৎকর্মপরায়ণদের শ্রমফল নষ্ট করেন না।’ (সুরা : ইউসুফ, আয়াত : ৯০)

মানুষের মূল্যাবান দুটি গুণ : উল্লিখিত আয়াতে ইউসুফ (আ.) নিজের পরিচয় দেওয়ার পর যে বাক্য দুটি উল্লেখ করেছেন, তা খুবই তাৎপর্যমণ্ডিত। আল্লাহ ধৈর্যশীল ও আল্লাহভীরুদের প্রতিদান নষ্ট করেন না। হীনম্মন্য ও ভীরু হওয়ার কারণে মানুষ সময়কে দোষ দেয়। কিন্তু সময় কখনো মানুষের গতি নির্ধারণ করেনি এবং সময় কখনো মানুষের গতি নির্ধারণ করবেও না। মানুষ এগিয়ে যায় তার সত্তাগত গুণাবলি ও চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের বলে; বরং চারিত্রিক সৌন্দর্য ও সত্তাগত গুণাবলি সময়ের বৈরী প্রবাহকে পরাজিত করে, তাকে মাথা নত করতে বাধ্য করে।

 

সূত্রঃ কালের কণ্ঠ