জিপিএ-৫ পেয়েও টাকার অভাবে অমরের উচ্চ শিক্ষা নিয়ে দুশ্চিন্তায় পরিবার

আমানুল হক আমান:
হতদরিদ্র দিনমজুর পঞ্চনন্দ কুমারের ছেলে অমর কুমার এবার এইচএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পেয়েও টাকার অভাবে উচ্চ শিক্ষা নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছে পরিবার।

 
জানা যায়, অমর কুমার রাজশাহীর বাঘা শাহদৌলা ডিগ্রী কলেজের বাণিজ্য বিভাগ থেকে জিপিএ-৫ পেয়েছে। তার বাড়ি বাঘা উপজেলার কালিদাসখালী গ্রামে। চাষাবাদের কোন জমি নেই। অন্যের জমিতে ঘর তুলে কোনো রকম মাথা গোঁজার ঠাঁই হয়েছে। দিনমুজুরের কাজ করে সংসার চালায় তার বাবা। সংসারের অভাব মেটাতে মা-ও অন্যের বাড়িতে ঝি-এর কাজ করে। দুটি টিনের ছাপরা ঘর। একটিতে অমর কুমার অন্যটিতে তার বাবা-মা থাকেন।

 
ঘরে একটি চৌকি ছাড়া অন্য কোন আসবাব পত্র নেই, নেই কোন পড়ার টেবিলও। চৌকিতে বসেই হারিকেন জ্বালিয়ে রাতে পড়া-লেখা করে অর্জিত হয় তার সাফলতা। দিন মুজুর বাবা সারা দিন অন্যের কাজ করে চাল-ডাল নিয়ে এলে সংসারের হাড়ি চলে। যেদিন কোন কাজ পায় না সেদিন অনাহারেই দিন যায় তাদের। তার পরও অমর কুমার পড়া-লেখা থেকে বিন্দু মাত্র বিচ্যুত হয়নি। অমর এবার এইচএসসি বানিজ্য বিভাগ থেকে জিপিএ-৫ এবং গত এসএসসি পরীক্ষায় জিপিএ গোল্ডেন এ প্লাস পেয়েছে।

 
রোববার সকালে কালিদাস খালি গ্রামের গেলে তার মা নীলা রানি সিল্কসিটি নিউজকে বলেন, অমর বাড়িতে নেই। পাশের গ্রামে অন্যের কাজে গেছে। ভালো কলেজে ভর্তি হওয়ার ইচ্ছা তার। টাকা লাগবে তাই কাজ করে টাকা জোগানোর চেষ্টা করছে। কতবার বললাম তোর বাবার একার রোজগার দিয়ে কিছু করতে পারছেনা। তুই বাবার সাথে কাজ করলে নিজের কিছু জায়গা জমি করতে পারবি। একথা বললেই অমর দোয়া করতে বলে। সকলের সহযোগিতায় ভালো কলেজে ভর্তি হয়ে লেখাপড়া শেষ করতে পারলে কিছু একটা হব। তখন জায়গা জমির অভাব থাকবেনা। গরীব মানুষের জন্যও কিছু করতে পারবো। লেখাপড়া থেকে পিছু না হটে ছেলের লড়াই এর কথা এভাবেই বলেন, মা নীলা রানী।

 
কলেজ শিক্ষকদের সহযোগিতায় ভাল ফলাফল করলেও উচ্চ শিক্ষায় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে দারিদ্রতা। মেধাবী অমর ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। আর্থিক সংকটের কারণে সে স্বপ্ন কি অধরাই থেকে যাবে এমননি প্রশ্ন তার বাবা-মায়ের।

 
বাবা পঞ্চনন্দ কুমার এই প্রতিবেদককে বলেন, আমি সংসার চালানোর জন্য প্রতিদিন ঘুম থেকে উঠে কাজের সন্ধানে বের হতে হয়। তার পর ছেলের লেখা-পড়া করানো বড় দুঃসাধ্য হয়ে পড়ে। তাই পঞ্চম শ্রেণী পাশ করার পর অমরকে জানিয়ে দিলাম, আর পড়াশোনার দরকার নেই। সে সামর্থ্যও নেই। তাই কাজ করে পয়সাকড়ি জুগিয়ে নিজেদের একটু জমি কেনা যায় কি-না?, সেটিই হবে ভালো। তারপরও হাল ছাড়েনি। লেখাপড়া সে ছাড়বে না, তবে কাজও করবে। সেই থেকে শুরু দিনমজুরি। সপ্তাহে তিন দিন স্কুল, আর তিন দিন দিনমজুরের কাজ। শুক্রবার সারাদিন বাড়িতে পড়াশোনা। এভাবেই লেখা পড়া করে জিপিএ-৫ পেয়েছে অমর।

 
ভালো ফলাফলেও হাসি নেই তার। আর্থিক অসচ্ছলতার কারণে ছেলের লেখাপড়া নিয়ে বাবা-মা শঙ্কিত হলেও নিজের ইচ্ছা শক্তিকে কাজে লাগিয়ে ফিন্যান্স এ্যান্ড ব্যাকিং-এ পড়তে চাই অমর।

 
সোমবার সরাসরি কথা হলে ভবিষৎতে বড় হওয়ার আশা আকাঙ্খা ও স্বপ্নের কথা জানিয়ে অমর এই প্রতিবেদককে বলেন, তার লেখা-পড়া অনিশ্চয়তার মধ্যে থাকায় ভবিষ্যতকে নিয়ে অন্ধকারে নিমর্জ্জিত। কালিদাশখালী উচ্চ বিদ্যালয়ের দুইজন শিক্ষক-রফিক স্যার সাফাজুল স্যার সাহায্যের হাত বাড়ান। মানসিক সাপোর্ট দেয়ার পাশাপাশি একজন অংক আর একজন ইংরাজি বিনামূল্যে প্রাইভেট পড়ান। বাঁচার সাহস জোগান। তাদের অনুপ্রেরণায় এসএসসি পরীক্ষায় ভালো ফলাফল করি। এইচএসসিতে ভর্তি হওয়ার পর বাঘা পৌর মেয়র আক্কাছ আলী সহযোগিতা করে। বই কিনে দেন স্থানীয় সাংবাদিক নুরুজ্জামান।

 
বৃত্তির ১০ হাজার ৮০০ টাকা অনেক সহযোগিতা এসেছে। এখন সামর্থ্য না থাকায় স্বপ্ন পূরণ হবে কি সন্দেহ অমরের মনে উঁকি দিচ্ছে বারবার। দারিদ্রতার কালো মেঘ তবু অধ্যাবসায়ের কারণে সাফল্য একটু হলেও ছুঁয়েছে তাকে।

 
কলেজের অধ্যক্ষ আমজাদ হোসেন সিল্কসিটি নিউজের এই প্রতিবেদককে বলেন, ওর নিজের প্রচেষ্টা এবং কলেজের শিক্ষকদের সহযোগিতায় লেখাপড়া চালিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছে। ভালো ফলও করেছে। ভবিষ্যতের জন্য ওদের দরকার সমাজের সহৃদয় ব্যক্তিদের সহযোগিতা। অমর অভাবের মধ্যেও নিজের পায়ে দাঁড়ানোর অদম্য ইচ্ছায় লেখা-পাড়া চালিয়ে যাচ্ছে। উচ্চ শিক্ষাই শিক্ষিত হওয়ার স্বপ্ন যেন তার অধরা থেকে না যায় এজন্য সমাজের বিত্তবানদের কাছে আবেদন।

স/শ