জিও ব্যাগে বালুর বদলে মাটি

সিল্কসিটি নিউজ ডেস্ক:

চাঁপাইনবাবগঞ্জে গত এক মাসের বেশি সময় ধরে চলছে পদ্মার বিধ্বংসী ভাঙন। শুধু জিও ব্যাগ ফেলে এ ভাঙন ঠেকানোর চেষ্টা চালাচ্ছে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো)।

কিন্তু এখনো আসেনি তেমন কোনো কার্যকর ফল। কারণ ভাঙন রোধ সংক্রান্ত কাজে পরতে পরতে ব্যাপক অনিয়ম দুর্নীতি চলছে-এমন অভিযোগ স্থানীয়দের। তাদের মতে, বিভিন্ন পয়েন্টে বালুর পরিবর্তে ধষনা (চিকন) মাটি ভর্তি জিও ব্যাগ ফেলা হচ্ছে। আর এই মাটি দিয়ে কোনোভাবে ভাঙন থামানো সম্ভব নয় বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

এই মাটি ভর্তি জিও ব্যাগ ফেলে ঠিকাদার ও পাউবো কর্মকর্তারা মিলে রীতিমতো লুটপাটের মহোৎসবে মেতে উঠেছেন। ভুক্তভোগী এলাকাবাসীর অভিযোগ-পাউবো থেকে ঠিকাদাররা এক সিএফটি বালুর দাম পাচ্ছেন ১৮ টাকা। কিন্তু তারা বালু না কিনে মরা পাগলা নদী খননের ধষনা মাটি কিনছেন ৫ টাকা সিএফটি করে। এসব পচা ধষনা বালুর বদলে জিও ব্যাগে ভরে নদীতে ফেলছেন। ফলে জিও ব্যাগ ভেসে যাচ্ছে পানির তোড়ে। যার কারণে ভাঙন ঠেকানো যাচ্ছে না। হাকিমপুর এলাকাতে গত ৩ সেপ্টেম্বর ওলিউল নামের একজন ঠিকাদার বালুর বদলে জিও ব্যাগে ধষনা মাটি ভরে ডাম্পিং করছিলেন। অভিযোগ পেয়ে এলাকার ইউপি চেয়ারম্যান আব্দুস সালাম এলাকাবাসীকে সঙ্গে নিয়ে বিপুল পরিমাণ মাটি ভর্তি জিও ব্যাগ আটকে রাখেন। পরে পাউবো কর্মকর্তারা ঘটনাস্থলে গিয়ে ব্যাগ থেকে মাটি ফেলে দিতে বাধ্য করেন ঠিকাদারকে।

তাদের আরও অভিযোগ-কোনো কোনো স্থানে রাতের আঁধারে নদীতে জিও ব্যাগ ফেলা হচ্ছে। এতে ব্যাগের প্রকৃত সংখ্যা কত-তা নিয়ে দেখা দিয়েছে নানা প্রশ্ন। সম্প্রতি সাড়ে ৬ কোটি টাকা ব্যয়ে ৮৪ হাজার ৫০০ বস্তা ফেলা হয়েছে। আরও ২৫ হাজার বস্তা প্রস্তুত আছে।

এদিকে ভুক্তভোগী মানুষ কাজের মান নিয়ে প্রশ্ন তুললেই তাদের বিরুদ্ধে পরিকল্পিতভাবে চাঁদাবাজির অভিযোগ করা হচ্ছে। চাঁপাইনবাবগঞ্জের চরবাগডাঙ্গা ও ভাঙনকবলিত এলাকা সরেজমিন ঘুরে এসব অভিযোগ জানা গেছে।

চাঁপাইনবাবগঞ্জের চরবাগডাঙ্গা ও ভাঙনকবলিত বিভিন্ন এলাকা সরেজমিন ঘুরে ও সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে উল্লিখিত সব তথ্য। জিও ব্যাগে বালুর বদলে ধষনা মাটি (চিকন মাটি) ভরে ডাম্পিং করার অভিযোগ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) রাজশাহী অঞ্চলের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (এসই) মোহা. শফিকুল ইসলাম বৃহস্পতিবার বলেন, ভাঙন ঠেকাতে জরুরি প্রতিরক্ষা কাজে জিও ব্যাগে কোনোভাবেই মাটি ভরে ডাম্পিং করার নিয়ম নেই। বালু ভরেই ডাম্পিং করতে হবে। ভাঙন ঠেকাতে এটাই টেকসই ও স্বীকৃত ব্যবস্থা। কারা কীভাবে ঘটনাস্থলে মাটি নিয়ে গেল এবং ব্যাগে ভরে ডাম্পিং করে ফেলল সেটা খুঁজে দেখা হচ্ছে।

চাঁপাইনবাবগঞ্জে পদ্মার সাতটি পয়েন্টে চলছে লাগাতার ভাঙন। এর মধ্যে চরবাগডাঙ্গা সর্বাধিক ভাঙনকবলিত এলাকা। সেখানকার বাসিন্দা আজিজুল ইসলাম বলেন, পদ্মার আলমনগর পয়েন্ট থেকে বাখর আলী ঘাট পর্যন্ত এলাকায় ব্লক ম্যাট্রেসিং ছিল। কিন্তু ৭৩২ কোটি টাকা ব্যয়ের দুটি পৃথক প্রকল্প (১৬৬ ও ৫৬৬ কোটি টাকার দুই প্রকল্প) টাকার প্রকল্প গ্রহণের পরও তা সময়মতো বাস্তবায়ন হয়নি। ফলে গত আগস্টের শুরুতে ব্যাপক ভাঙন শুরু হয়। পুরো এলাকার সিসি ব্লক ম্যাট্রেসিং নদীতে বিলীন হয়ে যায়। বিধ্বংসী ভাঙনে গোয়ালডুবি এলাকায় পদ্মা প্রায় এক কিলোমিটার ভেতরে ঢুকে পড়েছে। নদীতে বিলীন হয়েছে ৫২টি পাকা বাড়িসহ অসংখ্য গাছপালা ও আমগাছ। ভাঙনের তীব্রতায় লোকজন এসব গাছপালা কাটার সময়ও পাননি। গত ৫ সেপ্টেম্বর এলাকাটিতে আবারও তীব্র ভাঙন শুরু হয়। পাউবোর কর্মকর্তারা দুজন ঠিকাদারকে সঙ্গে নিয়ে এলাকায় আসেন সন্ধ্যার সময়। ওই রাতে শ’চারেক জিও ব্যাগ ও ১৫ ট্রাক ধষনা মাটি ঘটনাস্থলে আনেন তারা। গভীর রাতে ধষনা মাটি জিও ব্যাগে ভরে নদীতে ফেলার সময় এলাকাবাসী বাধা প্রদান করেন। কারণ জিও ব্যাগে বালু ভরে ডাম্পিং (নিক্ষেপ) করার নিয়ম। সেখানে ব্যাগে ধষনা মাটি ভরতে বাধা দেওয়ায় পাউবোর কর্মকর্তারা এলাকাবাসীর বিরুদ্ধে জেলা প্রশাসকের দপ্তরে চাঁদা দাবি ও জরুরি কাজে বাধা প্রদানের অভিযোগ দেন। আজিজুল ইসলামসহ একাধিক এলাকাবাসীর আরও অভিযোগ-ওই রাতে চারশ জিও ব্যাগ এনে দুইশ ব্যাগ ডাম্পিং করা হয়। সকালে পাউবো কর্মকর্তারা ১৫ হাজার জিও ব্যাগ ফেলা হয়েছে বলে এলাকাবাসীকে বলা হয়। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে এলাকাবাসী ব্যাগ ফেলতে বাধা দেন। বুধবার পর্যন্ত ধষনা মাটি ভর্তি বাকি জিও ব্যাগ এলাকাবাসী নদীতে ফেলতে দেননি তদন্তের দাবিতে। তারা সেগুলো গত বুধবারও পাহারা দিচ্ছিলেন বসে বসে। এলাকার বাসিন্দা জিয়ারুল বলছিলেন, ভাঙনে আমরা বাড়িঘর হারিয়ে নিঃস্ব হচ্ছি আর পাউবোর লোকরা ঠিকাদারের সঙ্গে মিলে নিজেদের পকেট ভারী করছেন। বালুর বদলে পচা মাটি ব্যাগে ভরে নদীতে ফেলছে। এলাকাবাসী এমন কয়েকশ ব্যাগ আটক করে রেখেছেন যার তদন্ত হলে সত্যতা পাওয়া যাবে।

চরবাগডাঙ্গা ইউপি চেয়ারম্যান শহিদ রানা টিপু বলেন, কারও সর্বনাশ আর কারও পৌষ মাস। এই পরিস্থিতি চলছে ভাঙনকবলিত এলাকায়। পাউবোর কর্মকর্তারা বিএনপি-জামায়াতের দুজন চিহ্নিত ঠিকাদার সাজিদ এন্টারপ্রাইজ ও নাসেরকে দিয়ে জরুরি কাজগুলো করাচ্ছেন। সাজিদ এন্টারপ্রাইজের মালিক আশরাফুল হক ও নাসেরের সঙ্গে পাউবোর উপবিভাগীয় প্রকৌশলী ময়েজ উদ্দীনের পার্টনারশিপের কথা সবাই জানেন। একদিকে একের পর এক এলাকা নদীতে যাচ্ছে আর পাউবোর কর্মকর্তারা এটাকে পুঁজি করে ঠিকাদারদের সঙ্গে মিলে চুটিয়ে ব্যবসা করছেন। এলাকাবাসী কাজের মান নিয়ে প্রশ্ন তুললেই তাদের চাঁদাবাজ বলা হচ্ছে। তিনি এ বিষয়ে সরেজমিন তদন্তের দাবি জানিয়েছেন মন্ত্রণালয়ের প্রতি।

এদিকে স্থানীয়দের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে চাঁপাইনবাবগঞ্জে কাজের মান যাচাইসহ কাজ তদারকির জন্য গত ৮ সেপ্টেম্বর জেলা প্রশাসক জরুরি এক বৈঠক করেন পাউবোর কর্মকর্তা, ঠিকাদার ও এলাকাবাসীর প্রতিনিধিকে নিয়ে। সেখানে অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট দেবেন্দ্র নাথ উঁরাওকে প্রধান করে পাঁচ সদস্যের ভাঙন প্রতিরোধ তদারকি কমিটি করেছেন। কমিটি ওইদিন বিকাল থেকেই তদারকি শুরু করেন।

অভিযোগ অস্বীকার করে পাউবোর উপবিভাগীয় প্রকৌশলী ময়েজ উদ্দীন বলেন, ওইদিন গোয়ালডুবি পয়েন্টে কারা বা কে ধষনা মাটি নিয়ে গিয়েছিল তা তিনি বলতে পারবেন না। তিনি জানতে পেরে দ্রুত ঘটনাস্থলে গিয়ে ধষনা মাটি ভর্তি জিও ব্যাগ ডাম্পিং করতে দেননি। এই প্রকৌশলীর আরও দাবি এলাকারই কেউ ষড়যন্ত্রমূলকভাবে জিও ব্যাগে বালুর বদলে ধষনা মাটি ভরে ছিল। তবে এলাকার মানুষের দাবি, ময়েজ উদ্দীনের পার্টনার আশরাফ ও নাসেরই ১৫ ট্রাক ধষনা মাটি এনেছিল। ময়েজ উদ্দীন চেয়েছিলেন বালুর বদলে মাটি ভরেই জিও ব্যাগ ডাম্পিং করবেন। কিন্তু তারা তা করতে দেননি। আর নিজের দুর্নীতি ঢাকতে এলাকাবাসীর বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির মিথ্যা অভিযোগ করেছেন। হাকিমপুর এলাকার ঠিকাদারের জিও ব্যাগে ভরা মাটি তিনি ঘটনাস্থলে গিয়ে আনলোড করতে বাধ্য করেন বলে দাবি করেন।

সূত্র:যুগান্তর