জামায়াত নিয়ে ঐক্যপ্রক্রিয়ায় বিতর্ক!

সিল্কসিটিনিউজ ডেস্ক:

বৃহত্তর ঐক্যপ্রক্রিয়ায় এবার জামায়াতের অবস্থান নিয়েই সংশ্লিষ্ট দলগুলোর মধ্যে বিতর্ক তৈরি হয়েছে। আর এই বিতর্কের একদিকে রয়েছে অধ্যাপক এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন দল। দলটি সরাসরি বলছে, বিএনপির সঙ্গে জামায়াতের জোট থাকলে তারা বিএনপির সঙ্গে ঐক্যে যাবে না। অন্যদিকে ঐক্যপ্রক্রিয়ার ব্যানারের প্রধান দল গণফোরাম এবং যুক্তফ্রন্টের অন্য দুটি দল জেএসডি ও নাগরিক ঐক্য নীতিগতভাবে জামায়াতের সঙ্গে ঐক্যে রাজি না হলেও ২০ দলীয় জোট থেকে জামায়াতকে এখনই ঠেলে বের করে দেওয়ার বিষয়টিকে বড় ইস্যু করতে চাইছে না। কিছুটা কৌশলী অবস্থান নিয়ে এই তিনটি দল এ প্রশ্নে এখনই বিএনপিকে চাপ বা শর্ত দিতে রাজি নয়।

এই তিনটি দলের নেতাদের মতে, জামায়াতের সঙ্গে বৃহত্তর ঐক্য হচ্ছে না। ঐক্য হচ্ছে বিএনপির সঙ্গে। বিএনপির সঙ্গে ২০ দলীয় জোটে জামায়াত থাকলে ওই বিষয়টি এখনই এজেন্ডায় নেওয়া ঠিক হবে না। কারণ তাতে বৃহত্তর ঐক্যের ক্ষতি হবে।

জানা গেছে, সর্বশেষ গত মঙ্গলবার রাতে বদরুদ্দোজা চৌধুরীর বাসায় অনুষ্ঠিত বৈঠকেও জামায়াত ইস্যুতে বিতর্ক হয় দলগুলোর মধ্যে। বিকল্পধারার যুগ্ম মহাসচিব মাহী বি চৌধুরী একাই এই বিতর্ক করেন অন্য তিনটি দলের উপস্থিত নেতাদের সঙ্গে। তিনি বলেন, জামায়াতের ইস্যুটি নিষ্পত্তি দরকার। এ সময় নাগরিক ঐক্যের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ডা. জাহেদ উর রহমান বলেন, হ্যাঁ, নিষ্পত্তি হওয়া দরকার এই কারণে যে আনুষ্ঠানিক সিদ্ধান্ত এবং সুস্পষ্ট অবস্থান থাকার পরেও জামায়াত প্রসঙ্গে বৃহত্তর ঐক্যপ্রক্রিয়ায় আগ্রহী দলগুলোর দু-এক নেতা টক শোসহ বিভিন্ন জায়গায় ভিন্ন ভাষায় কথা বলছেন। এতে বাইরে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হচ্ছে। এ পর্যায়ে নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, ‘আমাদের এখন প্রধান ইস্যু হওয়া উচিত বৃহত্তর ঐক্যপ্রক্রিয়া। এর বাইরে অন্য ইস্যুকে গুরুত্ব দেওয়া হলে বৃহত্তর ঐক্যের ক্ষতি হবে।’

জানা যায়, ‘জামায়াত থাকলে বৃহত্তর ঐক্য হবে না’—এমন একটি প্রস্তাব বিকল্পধারার যুগ্ম মহাসচিব মাহী বি চৌধুরী মঙ্গলবার বৈঠকে উপস্থিত নেতাদর পড়ে শোনান। যেখানে বলা হয়েছে, ‘প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে স্বাধীনতাবিরোধী দল বা ব্যক্তির সঙ্গে কোনো ঐক্য হতে পারে না। জিয়াউর রহমান প্রতিষ্ঠিত দল হিসেবে বিএনপির সঙ্গে আমরা জাতীয় ঐক্য চাই। তবে স্বাধীনতাবিরোধী কোনো দল বা

ব্যক্তিকে শরিক রাখলে বিএনপিকে জাতীয় ঐক্যপ্রক্রিয়ায় সম্পৃক্ত করা যাবে না। স্বাধীনতাবিরোধী দল বা ব্যক্তির সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করার ঘোষণা না দেওয়া পর্যন্ত বিএনপি জাতীয় ঐক্যপ্রক্রিয়ার মঞ্চে স্থান পেতে পারে না।’

সূত্র জানায়, বৃহত্তর ঐক্যপ্রক্রিয়ার বৈঠকের সংবাদ সংগ্রহ করতে যাওয়া সাংবাদিকদের কাছে বিকল্পধারার ওই প্রস্তাব আগেই চলে যায়। ফলে অনেকের কাছে এই বার্তা পৌঁছায় যে এটি বৃহত্তর ঐক্যেরই প্রস্তাব। কিন্তু ওই প্রস্তাবের সঙ্গে উপস্থিত অন্য তিনটি দলের নেতাদের কোনো সম্পর্ক বা সায় ছিল না। তাঁরা ওই প্রস্তাব দেখে কিছুটা বিস্মিত হন। জানা গেছে, কার্যত জামায়াত ইস্যুতে এখন বিকল্পধারা একাই একদিকে এবং অন্য তিন দল বিপরীত দিকে অবস্থান নিয়েছে।

এ প্রসঙ্গে মাহী বি চৌধুরীর বক্তব্য হলো, ‘আমাকে বাদ দিয়ে ঐক্য করলেই হয়। আমার সঙ্গে কেউ একমত না-ও হতে পারেন। কিন্তু বিএনপির সঙ্গে জামায়াত থাকবে, আবার আমি বিএনপির সঙ্গে থাকব, এটি হতে পারে না। তার অর্থ আমি জামায়াতের সঙ্গে পরোক্ষভাবে ঐক্য করলাম।’ ‘বিএনপি জামায়াতের হাত ধরবে আর আমি জামায়াতের হাত ধরব, তাহলে কী হলো’—এই প্রশ্ন তোলেন মাহী।

বৈঠকে উপস্থিত নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না   বলেন, বিকল্পধারার প্রস্তাবের সঙ্গে একমত হওয়ার প্রশ্নই ওঠে না এবং এটি নিয়ে যুক্তফ্রন্টের বৈঠকে কোনো আলোচনাই হয়নি। তিনি জানান, বৈঠক শেষে যুক্তফ্রন্টের চেয়ারম্যান যা ব্রিফ করেছেন সেখানেও ওই ধরনের কথা ছিল না। অবশ্য মাহী বি চৌধুরী দাবি করেন, তাঁর বক্তব্যের সঙ্গে বিকল্পধারা সভাপতি একমত আছেন। সময়ই এটি বলে দেবে তিনি কোথায় আছেন।

জানতে চাইলে বৈঠকে উপস্থিত জেএসডির সহসভাপতি তানিয়া রব   বলেন, বিকল্পধারার প্রস্তাবের সঙ্গে যুক্তফ্রন্টের সব দল একমত নয়। তিনি বলেন, যে দলটির নিবন্ধন নেই এমন একটি দলকে নিয়ে খুচরা বিতর্ক করে অযথা সময় নষ্ট করার মানে হয় না। তাঁর মতে, বৃহত্তর ঐক্য হবে বিএনপির সঙ্গে। এখন বিএনপি অন্য কার সঙ্গে রাজনীতি করবে সেটি তাদের বিষয়। এ ছাড়া স্বাধীনতাবিরোধীদের প্রসঙ্গটি যুক্তফ্রন্ট ও গণফোরামের যৌথ ঘোষণায় রয়েছে। সেখানে প্রতিদিন এটি নিয়ে কথা বলতে হবে কেন?

জানতে চাইলে গণফোরামের নির্বাহী সভাপতি অ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরী   বলেন, ‘স্বাধীনতাবিরোধীদের সঙ্গে ঐক্য হবে না—ড. কামাল হোসেনের দেওয়া ওই বক্তব্যেই আমরা আছি। এর বাইরে ২০ দলে কারা থাকবে, থাকবে না সেটি আমাদের দেখার বিষয় নয়।’ তিনি বলেন, অনেকে অনেক কথা বাড়িয়ে বলছেন। ১৫০ আসন চায়, ক্ষমতার ভারসাম্য চায়; কী করা যাবে! এগুলো বলার জন্য বলা; যোগ করেন গণফোরামের এই নেতা।

বৈঠকে উপস্থিত নাগরিক ঐক্যের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ডা. জাহেদ উর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, যে প্রস্তাবের কথা মঙ্গলবার বিকল্পধারা বলেছে সেটি শুধু বিকল্পধারার প্রস্তাব এবং এর সঙ্গে যুক্তফ্রন্ট বা বৃহত্তর ঐক্যের কোনো সম্পর্ক নেই। তিনি বলেন, বিকল্পধারার প্রস্তাব যুক্তফ্রন্টের ‘কমন’ অবস্থান নয়।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে যুক্তফ্রন্টের আরেকটি দলের দায়িত্বশীল এক নেতা বলেন, আসলে মাহী চৌধুরী একাই বৃহত্তর ঐক্য পণ্ড করে দেবেন। তিনি অনবরত লেগেই আছেন। ‘নৌকা আর ধানের শীষ দুই নাগিনীর একই বিষ’—ইদানীং এ ধরনের স্লোগান মাহী বের করেছেন বলেও জানান ওই নেতা। বলেন, মাহীকে নিয়ে যুক্তফ্রন্টে সন্দেহ ক্রমে ঘনীভূত হচ্ছে। বৃহত্তর ঐক্যে শেষ পর্যন্ত বিকল্পধারা থাকবে বলে মনে হয় না। আবার যুক্তফ্রন্ট ভেঙে যেতে পারে বলেও সংশয় প্রকাশ করেন ওই নেতা।

বৃহত্তর ঐক্যপ্রক্রিয়ায় মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা পালনকারী গণস্বাস্থ্যের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর মতে, জামায়াতের ব্যাপারে মাহী ও বিকল্পধারা বাড়াবাড়ি করছে এবং অন্য তিন দল এতে ক্ষুব্ধ হচ্ছে। তিনি বলেন, জামায়াতের কোনো ভূমিকা এখন দৃশ্যমান নয়। তারা কোনো কিছুর ধারে-পাছে নেই। অযথা তাদের নিয়ে সময় নষ্ট মাহী কেন করছেন তা তিনিই জানেন। প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বিকল্পধারার কারণে ঐক্যে হয়তো শেষ পর্যন্ত বাধার সৃষ্টি হবে না। কিন্তু ঝামেলা তৈরি হবে।

নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে, বেশ কয়েক মাস ধরেই বিএনপির সঙ্গে জামায়াতের অবস্থান নির্ণয়কে কেন্দ্র করে বিকল্পধারার সঙ্গে যুক্তফ্রন্টের শরিক জেএসডি ও নাগরিক ঐক্য এবং গণফোরামের টানাপড়েন চলছে। এমনকি গত ১৫ সেপ্টেম্বর ঘোষিত ওই দুই জোটের যৌথ ঘোষণা তৈরিতেও এর প্রভাব পড়েছে বলে জানা যায়। পাঁচ দফা দাবি ও ৯টি লক্ষ্যসংবলিত ওই ঘোষণা তৈরি করা হয়েছে ১৪ সেপ্টেম্বর সকালে চারটি দলের বৈঠকে; যেখানে উপস্থিত ছিলেন বিকল্পধারার ব্যারিস্টার ওমর ফারুক, জেএসডির আবদুল মালেক রতন এবং আ ও ম শফিক উল্লাহ।

সূত্র মতে, প্রস্তাবটি তৈরি করে যুক্তফ্রন্টের চেয়ারম্যান অধ্যাপক বদরুদ্দোজা চৌধুরীর কাছে স্বাক্ষরের জন্য পাঠানো হয় এবং এর ঘোষণা দেওয়ার কথা পরের দিন শনিবার কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারে। ওই ঘোষণায় ‘সকল স্বাধীনতাবিরোধী রাজনৈতিক দল ও ব্যক্তিকে বাদ দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী রাজনৈতিক দল, সামাজিক শক্তি ও নাগরিক সমাজসহ জনগণকে সুসংগঠিত করে অভিন্ন দাবি আদায় ও লক্ষ্যসমূহ বাস্তবায়নে শান্তিপূর্ণ ও অহিংস আন্দোলন গড়ে তোলার অঙ্গীকার ব্যক্ত করে বৃহত্তর জাতীয় ঐক্য গড়ার কার্যকর উদ্যোগ অব্যাহত রাখার ঘোষণা করছি’—এমন কথা বলা ছিল। কিন্তু যুক্তফ্রন্টের অন্তর্ভুক্ত অন্য দলগুলোর অভিযোগ, বি চৌধুরীর কাছে স্বাক্ষরের জন্য পাঠানো প্রস্তাবের ওই খসড়ায় ‘সকল স্বাীধনতাবিরোধী’দের আগে ‘প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে’ শব্দ দুটি জুড়ে দেওয়া হয়। শুধু তাই নয়, শনিবার আনুষ্ঠানিকভাবে যৌথ ঘোষণার আগে শুক্রবার বিকেলেই ওই প্রস্তাব গণমাধ্যমে বিকল্পধারার অফিস থেকে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ তাদের। আবার সেখানে গণফোরামের সভাপতি ড. কামাল হোসেনের স্বাক্ষরও ছিল না বলে জানান নাম প্রকাশ না শর্তে যুক্তফ্রন্টের এক নেতা।

সূত্রের দাবি, সংবাদমাধ্যমে আগের দিন সন্ধ্যায় ওই ঘোষণা যাওয়ায় ক্ষুব্ধ হয় অন্য দলগুলো। কিন্তু বৃহত্তর ঐক্যের কথা বিবেচনায় নিয়ে বিষয়টি তারা চেপে যায়। তবে শনিবার প্রেস ক্লাবে যৌথ ঘোষণা পাঠ করার সময় নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না নতুন সংযোজন করা শব্দ দুটি সতর্কভাবে এড়িয়ে যান।

জানতে চাইলে মাহী চৌধুরী কালের কণ্ঠকে বলেন, হ্যাঁ, কামাল হোসেনের স্বাক্ষর ছাড়া যৌথ ঘোষণা গণমাধ্যমে গেছে; দিয়েছি। কিন্তু শুক্রবার ওরাও তো (অন্য তিন দল) বি চৌধুরী ও কামাল হোসেনের স্বাক্ষর ছাড়া একটি ঘোষণা প্রেসে দিয়েছিল। তিনি বলেন, “যেদিন আমরা দিয়েছি একই দিন ওরা প্রথমে দিয়েছে। পরে আমরা বি চৌধুরী সাহেবের স্বাক্ষরের পর কামাল হোসেন সাহেবের কাছে পাঠিয়েছি। কিন্তু একটি কপি কে বা কারা ‘লিক’ করেছে আমি জানি না।” মাহীর দাবি, পরের দিন দুই দফা ভালো করে পড়ে ঘোষণায় ড. কামাল হোসেন স্বাক্ষর করেছেন। এ নিয়ে অপরাজনীতি করার কিছু নেই।