জানার পথে ভাষার দেয়াল

সিল্কসিটি নিউজ ডেস্কঃ

কপটতা, স্ববিরোধিতা, আত্মপ্রতারণার এক অদ্ভুত ক্ষমতা আছে বাঙালি ডিগ্রিধারী সমাজের, বাঙালি শাসকদের। প্রতিবছর ফেব্রুয়ারি মাস এলে মাতৃভাষা বাংলা, ২১ ফেব্রুয়ারি নিয়ে তাদের যে আবেগ-উচ্ছ্বাস দেখা যায়, তার তুলনা যেমন বিশ্বের আর কোথাও পাওয়া যাবে না; তেমনি রাষ্ট্রীয় নীতিমালা, পরিকল্পনা, শিক্ষা, গবেষণা, আদালত, এমনকি সেমিনার-সম্মেলন পর্যন্ত সর্বত্র নিজের মাতৃভাষাকে যেভাবে অবশ্যবর্জনীয়, অব্যবহারযোগ্য হিসেবে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে এরা ছুড়ে ফেলে দেয়, তারও তুলনা পাওয়া কঠিন হবে। বাংলা ভাষাকে ‘হৃদয়ের ভাষা’, ‘প্রাণের ভাষা’ বলে বলে কাজের ক্ষেত্রে তাকে অপাঙ্‌ক্তেয় করে রাখা—এই হলো বর্তমান চিত্র।

সংবিধান, সরকারি দাবি এবং প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী বাংলাদেশের রাষ্ট্রভাষা বাংলা। কিন্তু আমরা দেখি রাষ্ট্রের সব পর্যায়ে, তার সঙ্গে শিক্ষাঙ্গনে, আদালতে ইংরেজিই প্রধান ভাষা। সেই হিসেবে অঘোষিতভাবে বাংলাদেশের রাষ্ট্রভাষা কার্যত ইংরেজি। পাকিস্তান আমল তো বটেই, ব্রিটিশ আমলের সঙ্গেও বর্তমান সময়ে সমাজে বাংলা ভাষার আপেক্ষিক অবস্থানের পার্থক্য খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করে খুব লাভ হবে না। দেশের অন্যান্য জাতির ভাষা আরও করুণ অবস্থায়।

দেশের উন্নয়ন কার্যক্রম-সম্পর্কিত সব প্রতিষ্ঠানই তাদের কার্যক্রমে ইংরেজিই প্রধান মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করে। মন্ত্রণালয়, সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার চাহিদা এবং অর্থ বরাদ্দে বিভিন্ন কনসালটেন্সি বা গবেষণা হয়। এসব রিপোর্টের মূল পাঠক সেসব সংস্থার লোকজনই থাকেন। ইংরেজি ভাষায় প্রণীত এসব রিপোর্ট সাধারণের অগম্য তো বটেই, অনেক ক্ষেত্রে ইংরেজি জানা কেউ আগ্রহী থাকলেও এগুলো পাওয়া কঠিন। যাঁদের নির্দেশে এসব গবেষণা, তাঁরা ছাড়া আর কারও কাছে এগুলো পৌঁছানোর তেমন উদ্যোগও দেখা যায় না। এনজিও রিপোর্টগুলোর ভাষাও প্রধানত ইংরেজি।

সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, এডিবি, ইউএসএইড, জাইকাসহ বিভিন্ন রাষ্ট্র ও সংস্থার ঋণে বিভিন্ন প্রকল্প পরিচালিত হয়। এসব প্রকল্পের ব্যাপারে ঋণদাতা সংস্থাগুলোর যেমন আগ্রহ থাকে, তেমনি গ্রহীতা হিসেবে সরকারি আমলা, মন্ত্রী, ব্যবসায়ীদেরও আগ্রহ থাকে। কারণ, এগুলোর সঙ্গে মন্ত্রী-আমলাদের বিদেশ সফর, প্রজেক্ট-কর্তা হিসেবে আমলাদের বাড়তি সুযোগ-সুবিধা, ব্যবসায়ীদের ক্রয় বা আমদানির মুনাফা, কনসালট্যান্টদের বাড়তি আয় সম্পর্কিত। সুতরাং প্রয়োজন থাকুক বা না-থাকুক, ক্ষতিকর বা বিপজ্জনক যা-ই হোক, এসব প্রকল্পে ভরা বিভিন্ন মন্ত্রণালয়।

এত সব প্রতিষ্ঠানের এত গবেষণা, এত প্রকল্প—সবই বাংলাদেশের উন্নয়নসংক্রান্ত। যেমন নারী, গরিব-প্রান্তিক মানুষের ক্ষমতায়ন, উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় জনগণের অংশগ্রহণ, তাদের জীবন-জীবিকা, পরিবেশ, যোগাযোগ, পানিসম্পদ, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি, সক্ষমতা বৃদ্ধি, অর্থনৈতিক সংস্কার, বিনিয়োগ, শিক্ষা, চিকিৎসা, বিরাষ্ট্রীয়করণ, দারিদ্র্য দূরীকরণসহ ভবিষ্যৎ নানা কর্মসূচি। অথচ এসব গবেষণা ও প্রকল্পের রিপোর্ট সবই ইংরেজি। যাদের নিয়ে ব্যয়বহুল এসব রিপোর্ট, তার কোনোটাই সেই মানুষদের ধরাছোঁয়ার মধ্যে থাকে না। তাদের সম্মতি তো অনেক দূরের বিষয়।

সুনির্দিষ্ট দৃষ্টান্ত হিসেবে বাংলাদেশের মানুষের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ দুটো মহাপরিকল্পনার কথা এখানে উল্লেখ করা যায়।

১. বাংলাদেশের জন্য নদী ও পানিসম্পদ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, এই ভূখণ্ডের জন্ম, প্রাণ, প্রকৃতি জীবন-জীবিকার প্রধান উৎস। নদীর সঙ্গে বাংলাদেশের মানুষের সম্পর্ক অত্যন্ত গভীর। তার শক্তি ও সংকটের, গতি ও দুর্গতির কারণ সমাধানের বিষয়ে নদীসংলগ্ন এলাকার মানুষের অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞানও গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু ১৯৫৪ সালে যুক্তরাষ্ট্র থেকে আসা ক্রুগ মিশন থেকে শুরু করে সর্বশেষ ‘ডেল্টা প্ল্যান ২১০০’ পর্যন্ত নদী ও পানিসম্পদ নিয়ে যত পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে, সবই বাংলাদেশের প্রকল্প প্রকৃতি সম্পর্কে অজ্ঞ বিদেশি কনসালট্যান্টদের দিয়ে। এগুলো সবই ইংরেজি ভাষায় প্রণীত; যাঁরা ইংরেজি জানেন, তাঁরাও এগুলো সম্পর্কে খুব কমই জানেন। প্রধানত বিদেশি ঋণে-পরামর্শে এসব নীতিনির্ধারণী প্রকল্প নেওয়া হয়েছে, সিদ্ধান্ত হয়েছে, তার বাস্তবায়নও হয়েছে। কিন্তু এসব সম্পর্কে নদীর মানুষেরা কিছুই জানতে পারেননি, তাঁদের অধিকার শুধু ভোগান্তির শিকার হওয়া। এসব পরিকল্পনার বিষয় ঠিকাদার, প্রকৌশলী, কনসালট্যান্ট অর্থাৎ এসব প্রকল্প থেকে যাঁরা লাভবান হন, তাঁরাই কেবল জানেন। নদীর মানুষের কাছে ভুল বা অসম্পূর্ণ তথ্য, মৌখিক অসার, মিথ্যা প্রতিশ্রুতি ছাড়া আর কিছু পৌঁছায় না।

গত কয়েক দশকে দেশি-বিদেশি কনসালট্যান্টদের সুপারিশে, ক্ষমতাবানদের ইচ্ছায়, জনকল্যাণ, বন্যানিয়ন্ত্রণ, সেচ, উৎপাদন বৃদ্ধি প্রভৃতি নামে সারা দেশের নদীগুলোর মধ্যে হাজারো বাঁধ, স্লুইস গেট ও পোল্ডার নির্মিত হয়েছে। বহু নদী এগুলোর কারণেই এখন মৃতপ্রায়। যেসব নীতি, পরিকল্পনার কারণে নদীগুলোর এ দশা, সেগুলোর যথাযথ পর্যালোচনা না করে, দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন না করে আবারও ওলন্দাজ বিশেষজ্ঞদের দিয়ে শতবর্ষের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে, কয়েক হাজার পৃষ্ঠার এ দলিলও যথারীতি ইংরেজিতে প্রণীত।

২. জ্বালানি ও বিদ্যুৎ সম্পর্কে মহাপরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে ২০৪১ সাল পর্যন্ত। এটা করা হয়েছে জাপানি সংস্থা জাইকা এবং কয়েকটি প্রাইভেট কোম্পানির কর্তৃত্বে এবং শতভাগ জাপানি কনসালট্যান্টদের দিয়ে। জাইকার মাধ্যমে ২০১৬ সালে প্রণীত মহাপরিকল্পনা (পিএসএমপি ২০১৬) অনুযায়ী সরকার দেশের বিদ্যুৎ খাতে কয়লা, এলএনজি ও পারমাণবিক নির্ভরতা বাড়াচ্ছে। পরে কিছু সংশোধন করলেও মূল প্রবণতা একই আছে। ব্যয়বহুল পথ গ্রহণ ও দুর্নীতির বোঝা জনগণের ওপর চাপাতে বারবার বাড়ানো হচ্ছে গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম, গণশুনানিকে বানানো হয়েছে প্রহসন। পারমাণবিক বিদ্যুতের ঝুঁকি ও বিপদের যে কোনো সীমা-পরিসীমা নেই, তা সর্বজনবিদিত। বাংলাদেশের মতো ঘনজনবসতি, পানি ও আবাদি জমির ওপর বিপুলভাবে নির্ভরশীল একটি দেশে এ ঝুঁকি বিশ্বের যেকোনো দেশের চেয়ে অনেক বেশি। এ সত্য অগ্রাহ্য করে রূপপুরে বাংলাদেশের সবচেয়ে ব্যয়বহুল পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প করা হচ্ছে। উপকূলজুড়ে রামপাল-পায়রা-মাতারবাড়ী-বাঁশখালী.., সুন্দরবন থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত, দেশবিনাশী কয়লাবিদ্যুৎ প্রকল্প করা হচ্ছে একের পর এক। বাংলাদেশের জন্য তৈরি হচ্ছে মহাবিপর্যয় ও জাতীয় নিরাপত্তাহীনতার হুমকি। এ মহাপরিকল্পনার ভাষাও ইংরেজি। বাংলাদেশের মানুষের এ সম্পর্কে বিস্তারিত জানার উপায় নেই। বরং এগুলো নিয়ে যাতে মানুষ না জানে বা প্রশ্ন করতে না পারে, তার জন্য আছে প্রবল পাহারা, হুমকি, নজরদারির ভয়াবহ আয়োজন।

আরও আছে। বাংলাদেশে বর্তমান পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনাকে সরকারিভাবে নিজেদের সব উন্নয়নকাজের চালিকা শক্তি হিসেবে বর্ণনা করা হয়। এসব পরিকল্পনা দলিল তার প্রস্তুতির অংশ হিসেবে তৈরি বিভিন্ন গবেষণাপত্র সবই ইংরেজি ভাষায় প্রণীত। জনগণ তো দূরের কথা, সেগুলো দেশের বিদ্যায়তনগুলোতেও সুলভ নয়। বাস্তবে এখন সরকারের বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মসূচির লক্ষ্য হিসেবে বৈশ্বিক লক্ষ্যমাত্রাগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এ জন্য সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ফোরামের জন্য নিয়মিত অগ্রগতি রিপোর্ট প্রণয়ন করে থাকে। ব্যস্ততা এ কাজেই বেশি, আর এগুলো সবই লেখা হয় ইংরেজিতে। বাংলাদেশের মানুষের অজানাই থাকে সরকার তাদের নিয়ে কী পরিকল্পনা করছে, তাদের অগ্রগতির কী কী রিপোর্ট আন্তর্জাতিক দরবারে উপস্থিত করছে।

তার মানে বিদেশি ভাষাকে কার্যত রাষ্ট্রভাষার অবস্থানে নিয়ে বাংলাদেশ রাষ্ট্র তার সব নীতিমালা প্রণয়ন করছে, দেশ ও জনগণ সম্পর্কে সব সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়া চালাচ্ছে। এর অংশীদার বাঙালি উচ্চ ডিগ্রিধারী সমাজ তার শিক্ষা, গবেষণা, উপার্জন ও জীবনযাপনের মধ্য দিয়ে তৈরি করছে এক সংখ্যালঘু জগৎ, যার পা মাটিতে নেই। এসবের মধ্য দিয়ে যে জ্ঞানের জগৎ তৈরি হচ্ছে, তা দেশের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের জগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন। ভাষার দেয়াল টানা দুই জগতে জ্ঞানের, চিন্তার, ভাবের, কল্পনার, পরিকল্পনার এ বিভেদ দিনে দিনে বাড়ছেই কেবল। এ বিভেদ বাড়ানোর প্রধান কারিগর রাষ্ট্র নিজেই। আমরা দেখছি ‘উন্নয়নের’ তোলপাড়। কিন্তু তার নীতিমালা প্রণয়ন, সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়া এবং তার পরিণতি কোনো কিছুই জনগণের জানা নেই।

আনু মুহাম্মদ অর্থনীতিবিদ ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক এবং সর্বজনকথা পত্রিকার সম্পাদক