সিল্কসিটিনিউজ ডেস্ক:
একদল নবীণ-প্রবীণ শিল্পীর হাতে জলরংয়ে আঁকা ৫০টি ছবি নিয়ে রাজধানীতে শুরু হয়েছে প্রদর্শনী ‘ওয়াটার রাইমস-৪’।
শুক্রবার সন্ধ্যায় উত্তরার গ্যালারি কায়ায় ঘণ্টা বাজিয়ে এই প্রদর্শনীর উদ্বোধন করেন অধ্যাপক সমরজিৎ রায় চৌধুরী ও স্থপতি শামসুল ওয়ারেস।
কেবল জলরংয়ের ছবি নিয়ে শুরু হওয়া এই প্রদর্শনী আগামী ২ ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রতিদিন বেলা ১১টা থেকে সন্ধ্যা সাড়ে ৭টা পর্যন্ত চলবে।
জলরংয়ে আঁকা ছবির এই প্রদর্শনীর আলাদা কোনো থিম রাখা হয়নি জানিয়ে আয়োজক প্রতিষ্ঠান গ্যালারি কায়ার পরিচারক গৌতম চক্রবর্তী।
তিনি বলেন, “সবাই নিজের থিম নিয়ে কাজ করেছেন। তবে মূলত এখানে ল্যান্ডস্কেপের কাজটাই বেশি। ভালো ওয়াটার কালার করেন- এমন ১০ জন শিল্পীর শিল্পকর্মকে এখানে স্থান দেওয়া হয়েছে।”
মাস তিনেক আগে ১২ জন শিল্পীকে নিয়ে ভুটানে আর্ট ক্যাম্প আয়োজন করেছিল গ্যালারি কায়া। সেই আয়োজনে অংশ নেওয়া কয়েকজন শিল্পী ছাড়াও বাইরের কয়েকজনের ছবি প্রদর্শনীতে রয়েছে।
শুক্রবার সন্ধ্যায় উত্তরায় গ্যালারি কায়ায় নবীন-প্রবীণ একদল শিল্পীর জলরঙে আঁকা ৫০টি ছবি নিয়ে শুরু হয়েছে ‘ওয়াটার রাইমস-৪’ শিরোনামে প্রদর্শনী; চলবে ২ ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রতিদিন সকাল ১১টা থেকে সন্ধ্যা সাড়ে ৭টা। ছবি: আব্দুল মান্নান
তবে ক্যাম্পে অংশ নেওয়া যারা আছেন তাদের অনেকেই ওই ক্যাম্পে করা চিত্রকর্মের বাইরে নতুন ও ভালো কাজ দিয়েছেন বলে জানান গৌতম চক্রবর্তী।
প্রদর্শনীতে যাদের চিত্রকর্ম স্থান পেয়েছে, তাদের একজন শিল্পী রঞ্জিত দাশ উদ্বোধনীর পর জলরং মাধ্যমে ছবি আঁকার সাম্প্রতিক প্রসারের প্রসঙ্গে কথা বলেন।
তিনি বলেন, “আমাদের দেশে পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে জয়নুল-এসএম সুলতানের মতো শিল্পীরা ওয়াটার কালার করতেন। ওয়াটার কালারকে তখন তেমনভাবে মূল্যায়নও করা হতো না।ইদানিং ৬-৭ বছর ধরে আস্তে আস্তে এটা তুঙ্গেই গিয়েছে বলা যায়।
“এখন অনেকেই এটা করছে, জলরংয়ে আমাদের তরুণদের অনেকেই আঁকছে। প্রদর্শনী হচ্ছে অনেক। মাঝখানে অনেকটা সময় ছিল যখন ওয়াটার কালার নিয়ে এত প্রদর্শনীও হতো না, মাতামাতিও হতো না।”
সাম্প্রতিক সময়ে কোনো প্রদর্শনীতে অংশ নিলে পেইন্টিং ও ড্রয়িংয়ের সঙ্গে তার ওয়াটার কালারের কাজও থাকছে জানিয়ে রঞ্জিত দাশ বলেন, “আমরা পানির দেশের মানুষ। পানির দেশের মানুষ পানির রংয়ে মনে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। এখানকার দৃশ্য আমরা অনায়াসে ওয়াটার কালারে ধরতে পারি। আমাদের তরুণ প্রজন্মও কাজ করে যাচ্ছে।”
“চীন ও জাপানের শিল্পীরা মাস্টার মাস্টার ছবি এঁকে গেছেন। ওদের ওয়াটার কালারের স্টাইলই আলাদা। অল্প স্ট্রক দিয়ে করে ফেলছে। ক্যালিগ্রাফি ওদের আর্টের মধ্যেই পড়ে। তাদের প্রত্যেকেই এটা শিখে। বাক্য একটা ফিগারের মধ্যে থাকে।”
‘ওয়েটিং’ নামে একটা ছবি দেখিয়ে এই চিত্রশিল্পী বলেন, ছবিটি হরাইজেন্টাল লাইনে আঁকা। এখানে জলের আর আকাশের আলাদা কোনো রং দেওয়া হয়নি।
মাঝের হরাইজেন্টাল লাইনে গাছগাছালি থাকা ওই ছবি দেখিয়ে জলরংয়ে ছবি হয়ে ওঠার বর্ণনাও দেন শিল্পী রঞ্জিত দাশ।
তিনি বলেন, “মনে করেন, আমি এখানে একটা টান দিয়ে দিলাম। উপরের সাদা অংশে একটা পাখি দিলাম, নিচে একটা নৌকা দিলাম। তাতে উপরেরটাকে আকাশই মনে হবে, নিচেরটাকে পানি। বুঝতে কারো অসুবিধা হবে না। ছবিতে এ রকম সহজ চিন্তা নিয়ে আসা হয়েছে।”
এর আগে উদ্বোধনীর বক্তব্যে নিজের আঁকা ছবি নিয়ে কথা বলেন শিল্পী রঞ্জিত দাশ।
“ছবি কথা বলে, ছবির কাছে গেলেই বুঝতে পারবেন, ছবি কী বলছে। প্রত্যেকটিরই বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য আছে। গ্যালারি কায়ার পক্ষ থেকে আমরা বাইরে যেতাম, সেখানেও ছবি আঁকতাম। এখানে আরও দুইটা ছবি এঁকেছি। ভুটানে গিয়েছি, থাইল্যান্ডে গিয়েছি, সেখানকার প্রকৃতি আছে। অধিকাংশই বাস্তবধর্মী ছবি এঁকেছি। সবার ছবিতেই আমরা এক ধরনের ডেভেলপমেন্ট দেখতে পাচ্ছি।”
জলরংয়ের ছবি নিয়ে এই আয়োজনকে ব্যক্তিক্রমী আখ্যা দেন প্রদর্শনী উদ্বোধকদের একজন অধ্যাপক সমরজিৎ রায় চৌধুরী।
তিনি বলেন, “এখানে নিছক প্রদর্শনী দেখার জন্যই আমি আসি না। এখানে কিছু হলেই আমি ভাবি, গৌতম আয়োজন করেছে, একটা ব্যতিক্রম কিছু হবেই।”
জলরংয়ের ছবি নিয়ে এই সিরিজ প্রদর্শনীর প্রথমটি হয় ২০১২ সালে। দুই বছর পর ২০১৪ সালে দ্বিতীয় প্রদর্শনী হয়। তৃতীয় প্রদর্শনী এ বছরের এপ্রিলে হলেও বছর না ঘুরতেই আয়োজন করা হয় চতুর্থ প্রদর্শনীর।
উদ্বোধনীতে প্রদর্শনীর এক ছবি দেখিয়ে অধ্যাপক সমরজিৎ বলেন, “এই ছবি শিল্পীর হাতে আঁকা। ক্যামেরায় দিয়ে তোলা হলে ঠিক এই রকম হতো না। ক্যামেরায় যা আছে, তাই দেখায়। ক্যামেরা থেকে তাই হাতে আঁকা ছবি অনেক মজার।
“ক্যামেরার ছবি বাস্তবেও দেখা যায়। শিল্পী এখানে কিছু যুক্ত করেছেন, কিছু বাদ দিয়েছেন, কিছু কায়দা করেছেন-সবকিছুর সমন্বয়ে একটা ছবি তৈরি হয়। প্রত্যেক শিল্পীর কাজেই আমরা এই রকমটা দেখতে পাই।”
উত্তরার গ্যালারি কায়ায় শুক্রবার সন্ধ্যায় ‘ওয়াটার রাইমস-৪’ প্রদর্শনী। ছবি: আব্দুল মান্নান
অনেকদিন পর ওয়াটার কালার দেখায় উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে উদ্বোধনী বক্তব্যে স্থপতি শামসুল ওয়ারেস বলেন, বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ। এটা জলের দেশ। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় বদ্বীপ এটি। জলময়তা আছে। মাঝখানে এক্রিলিক ছবি দেখে দেখে চোখটা অন্য অবস্থানে ছিল। গ্যালারিতে সবগুলোই ওয়াটার কালার। এটা খুব নরম রং, তাড়াতাড়ি আঁকতে হয়। এই ছবিতে এক ধরনের সরলতা আছে। হালকা হলে বেশি সুন্দর হয়।
“যে কোনো শিল্প আত্মজৈবনিক। শিল্পীদের আবেগ, চিন্তা, অভিজ্ঞতার ওপর ভিত্তি করে শিল্প হয়। অভিজ্ঞতার প্রভাব থাকলেই সেটা আত্মজৈবনিক হয়ে উঠে।নিজের ভেতরের সঙ্গে বোঝাবুঝির ব্যাপার থাকে।”
আত্মজৈবনিক হতে হলে কোনোকিছুকে হৃদয় থেকে আসতে হবে মন্তব্য করে এই স্থপতি বলেন, “যে কোনো কর্মকাণ্ড, যা তার হৃদয় থেকে আসে, সেটা অন্যের হৃদয়ে পৌছায়। যা কেবল মুখ থেকে বলি, সেটা কখনো অন্যের হৃদয়ে পৌছাতে পারে না।”
প্রদর্শনী দেখতে আসা ইকবাল হোসেন নামে একজনের সঙ্গে আলাপে জানা গেল, তিনিও ছবি আঁকেন এবং সেটা জলরংয়েই।
তরুণ এই শিল্পী বলেন, জলরংয়ে ফ্লুয়েন্টলি এবং দ্রুত আবেগ প্রকাশ করা যায়। এটা সহজেই মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। কেউ যদি একবার এটাকে রপ্ত করে ফেলতে পারে, তাহলে এটা অন্য ধরনের নান্দনিকতা পায়।
প্রদর্শনীতে চল্লিশের দশকে জন্ম নেওয়া শিল্পী হামিদুজ্জামান খান, পঞ্চাশের দশকে জন্ম নেওয়া জামাল আহমেদ, রঞ্জিত দাশের শিল্পকর্ম যেমন রয়েছে তেমনি রয়েছে আশির দশকে জন্ম নেওয়া কামালুদ্দিন, শাহানুর মামুনের শিল্পকর্ম।
রয়েছে শিশির ভট্টাচার্য, মোহাম্মদ ইকবাল, আলপ্তগীন তুষার, আনিসুজ্জামান, আজমীর হোসেনের শিল্পকর্মও।
এই প্রদর্শনী স্পন্সর করেছে এডিএন গ্রুপ। মিডিয়া পার্টনার হিসাবে রয়েছে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম। প্রদর্শনী চলাকালে যে কেউ এই ছবি কিনে নিতে পারবেন, যা প্রদর্শনী শেষে তাকে বুঝিয়ে দেওয়া হবে।
সূত্র: বিডি নিউজ