ছোটর মধ্যে বড়ত্ব আছে, গৌরব আছে

পৃথিবীতে আমরা সব সময় বড় জিনিস বা বিষয়কে মূল্য দিই। আমাদের চোখগুলো বড় শব্দটা নিয়ে এত বেশি চর্চা করেছে যে আমাদের চোখগুলোও এখন বড় বড় হয়ে গেছে। অনেক ছোট জিনিস বা বিষয় যে অনেক বড় জিনিস থেকে অনেক বেশি মূল্যবান হতে পারে, তা অনেক সময় আমরা বুঝতে চাই না। ছোট থেকেই যে বড়র সৃষ্টি—সেটা আমাদের রক্ষণশীল মন অনেক সময় মানতে চায় না। অথচ একবিন্দু রক্ত থেকে যে একজন মানুষের জন্ম, সেটা আমরা কেমন যেন স্বার্থপরের মতো ভুলে যাই। ছোট থেকে মানুষ ক্রমাগত বাড়তে বাড়তে একদিন বড় হয়। বড় হয়ে কেউ মানুষ হয়, কেউ অমানুষ হয়। কেউ কেউ আবার জড় পদার্থও হয়। জড় পদার্থ মানে শরীরটা মানুষের মতো তবে মনটা মৃত মানুষের মতো। মানুষ মরে গেলে মন থাকে কি না সেটা বেঁচে থেকে বলাটা একটু কঠিন। তবে গবেষকরা এটা নিয়ে হয়তো গবেষণা করে যাচ্ছেন। সেটা নিয়ে গবেষকরাই ভাবুক বরং সেটিতে অদেখার দেখা মিললেও মিলতে পারে। মানুষকে নিয়ে গবেষণার তো শেষ নেই। সেটা যত দিন পৃথিবী থাকবে তত দিন চলবে। তবে ন্যানো গবেষণা নিয়ে সারা পৃথিবী এখন মেতে উঠেছে। ন্যানো মানে ছোটর থেকেও ছোট, তার থেকেও ছোট। একসময় মানুষ ম্যাক্রো নিয়ে মেতেছিল, এখন ন্যানো নিয়ে মেতেছে। তার মানে মানুষ বড় থেকে ছোটতে নেমেছে। এভাবে ছোট থেকে ছোটর দিকে মানুষের যাত্রা অব্যাহত রয়েছে। কিন্তু সেটা মনের বাস্তবতা মানলেও মনের আমলাতান্ত্রিক জটিলতা মানতে চায় না। পৃথিবীর সব নতুন সৃষ্টিতে ন্যানো গবেষণা এখন সবচেয়ে বেশি অবদান রাখছে। ন্যানো টেকনোলজি, ন্যানো-মেডিসিন থেকে ক্যান্সার গবেষণা, ভাইরাস প্রতিরোধ— সবখানেই তার জয়যাত্রা অব্যাহত রেখেছে। ছোটর ছোট অনেক বড় বড় কাজ করে পৃথিবীকে জানিয়ে দিচ্ছে ছোট বলে কাউকে অবহেলা করো না বরং ছোট এখন বড়র থেকেও আরো অনেক বড়। পৃথিবীর সবচেয়ে ছোট গল্পটার কথা মনে পড়ে গেল। পৃথিবীর সবচেয়ে ছোট গল্পটার লেখক মার্কিন সাহিত্যিক ও সাংবাদিক আর্নেস্ট হেমিংওয়ে। গল্পটি মাত্র ছয়টি শব্দে লেখা। গল্পটি ছিল এমন : “For sale. Baby shoes. Never worn.” গল্পটির বাংলা অনুবাদ : “বিক্রির জন্য। শিশুর জুতা। ব্যবহৃত নয়।”

গল্পটির ভেতর একটা অজানা রহস্য লুকিয়ে ছিল। ছোট গল্পটির সবচেয়ে বিস্ময়কর দিকটি হলো গল্পটা নিয়ে যে যার মতো করে ভাবতে পারে। তার মানে ছোট গল্প মানুষের মধ্যে ক্রিয়েটিভিটি তৈরি করতে পারে। ভাবা যায়, গল্পটা ছোট হলেও তার মধ্যে চিন্তাচর্চার জায়গাটা অসম্ভব একটা পাওয়ার হাউসের মতো। খুব সাধারণভাবে গল্পটার ভাবার্থ হলো, ‘বাচ্চার জন্য জুতা কেনা হয়েছিল, কিন্তু সেই বাচ্চাটা পৃথিবীর আলোই দেখেনি।’ ছয় শব্দের গর্ভে মারা যাওয়া শিশুর জন্য মায়ের গভীর বেদনা আর ব্যাকুলতার প্রকাশ ঘটেছে এখানে, যা ভাষায় বর্ণনা করা হয়তো কারো পক্ষেই সম্ভব নয়।

অযত্নে পড়ে থাকা ছোট একটা গল্প খুব কম সময়ে একটা মানুষের মধ্যে যে বোধের সৃষ্টি করেছে, একটা বড় মহাকাব্য বা উপন্যাসও তা হয়তো পারবে না। এখানে ছোটর হার না মানা হারের না বলা শব্দের মেরুদণ্ডটা খাড়া করে দাঁড়ানো। কারণ নীরবতা একটা এমন শক্তি, যা অনেক ছোটকে পুড়িয়ে পুড়িয়ে একদিন বড় করে তোলে।

 

পৃথিবীর সবচেয়ে ছোট চিঠিটা সাংকেতিক চিহ্নে লেখা হয়েছিল। এটাও একটা বিস্ময়। ১৮৬২ সালে ফরাসি ঔপন্যাসিক ভিক্টর হুগো এই চিঠিটা লিখেছিলেন তার বই ‘লা মিজারেবলস’ প্রকাশককে ‘?’ (প্রশ্নবোধক) চিহ্নের মাধ্যমে। তার প্রকাশকও কম যান না। তিনি উত্তর পাঠিয়েছিলেন শুধু ‘!’। প্রশ্নবোধক মানে বইটা কেমন চলছে আর বিস্ময়বোধক চিহ্ন মানে বইটা অনেক বিক্রি হচ্ছে। চমত্কার। একটা ছোট চিঠি এভাবে সৃজনশীলতা দিয়ে ইতিহাস হয়েছে। মানুষের মধ্যে ছোটকে বড় করে দেখার চিন্তাশক্তি তৈরি করেছে।

শচীন টেন্ডুলকার আর ব্রায়ান লারা ছোটখাটো দু’জন মানুষ। কিন্তু ক্রিকেটকে তারা দাবড়িয়ে বেড়িয়েছেন। পেলে আর মারাদোনাও ছোটখাটো দু’টো মানুষ। তারা ফুটবলকে শিল্পের রূপ দিয়ে মানুষের গতানুগতিক ভাবনার পরিবর্তন ঘটিয়েছেন। বি আর আম্বেদকর ছোট ঘরে জন্মেছিলেন বলে শ্রেণিকক্ষের বাইরে বারান্দায় বসে লেখাপড়া করেছেন। মানুষ তাকে একদিন ছোট করে দেখেছে, অবহেলা করেছে। তিনি সেই ছোটত্বের উদারতা নিয়ে ঘুরে দাঁড়িয়েছেন। ভারতের সংবিধানপ্রণেতা হয়ে মানুষের অন্তরে জায়গা করে নিয়েছেন। অবাক করার মতো বিষয় হলো একদিনের বঞ্চিত এই মানুষটি ২০১২ সালে হিস্ট্রি টিভি ১৮ আয়োজিত একটি বিশেষ অনুষ্ঠানে ভারতীয়দের ভোটের দ্বারা ‘শ্রেষ্ঠ ভারতীয়’ নির্বাচিত হয়েছেন। এ পি জে আবদুল কালাম ছোট এক জেলে পরিবারে জন্মেছিলেন। অনেক অনেক টাকা তাদের ছিল না, দারিদ্র্যও ছিল। না পাওয়ার কষ্ট ছিল। সেই চোখের অগোচরে পড়ে থাকা ছোট পেশার বাবার সন্তানটি ভারতের পারমাণবিক শক্তির জনক হয়েছেন। সব ছোটর ছোটকে অতিক্রম করে তিনি ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের একাদশ রাষ্ট্রপতি হয়েছেন। তাই তিনিই বলতে পারেন, তুমি যদি সূর্যের মতো আলো ছড়াতে চাও, তাহলে আগে সূর্যের মতো পুড়তে শেখো। লাল বাহাদুর শাস্ত্রী তখন নেহেরুর মন্ত্রিসভার রেলমন্ত্রী। ছোটখাটো গড়নের হালকা-পাতলা মানুষ। পরপর দু’টো রেল দুর্ঘটনার পর, দুর্ঘটনার সব দায় মাথায় নিয়ে তিনি রেলমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করেছেন। অনেকে ভেবেছে, তারার পতনের মতো তার পতন হয়েছে। অনেকে তাকে ছোট চোখে দেখতে লাগলেন। কিন্তু তার এই দায়বদ্ধতা সাধারণ মানুষের কাছে তাকে বড় বানিয়ে দিল। তিনি একসময় ভারতের প্রধানমন্ত্রী হলেন। মানুষ ছোট হয় না। ছোট হয় মানুষের চারপাশের মানুষ। এর ফলে যারা অন্যদের ছোট ভেবে অপমান করে, অবাঞ্ছিত করে তারাই একদিন বড় হয়ে ওঠে। প্রকৃতির বিচারটা আসলে এমনই। যেখানে সময় এসে মানুষকে ধরা দেয়।

আমাদের জীবনে এমন অনেক ছোট ছোট ঘটনা আছে, যা দিয়ে আমরা ইতিহাস গড়তে পারি। ছোট ছোট মানবিক মূল্যবোধ দিয়ে আমরা মানুষে মানুষে সম্প্রীতি ও ভালোবাসার বন্ধন গড়তে পারি। ছোট ছোট উপাদান দিয়ে নতুন সৃষ্টির আনন্দে মেতে উঠতে পারি। ছোট ছোট সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা, কষ্ট, আবেগ, যন্ত্রণা ভাগাভাগি করে জীবনবোধকে খুঁজে পেতে পারি। ছোট ছোট জয় আর ছোট ছোট পরাজয় দিয়ে মনকে আরো বড় করে গড়ে তুলতে পারি। ছোট ছোট ত্যাগ দিয়ে বড় ত্যাগের জন্য নিজেকে তৈরি করতে পারি।

ছোট কখনো ছোট নয়। ছোটর মধ্যে বড়ত্ব আছে। গৌরব আছে। নিজেকে বোঝার জাদুকরি শক্তি আছে। মানুষ যখন ছোট হয়ে মাথাটা মাটিতে নুইয়ে দেয়, তখন মানুষ এতটা বড় হয়ে উঠে যে, তা পৃথিবীর বড়ত্বের বড় বড় সীমাকেও ছাড়িয়ে যায়। বড় যদি হতে চাও ছোট হও তবে— এটাই আমাদের প্রকৃতি প্রতিদিন শেখায়। তাড়িত করে। তবে সেটা যখন আত্মাকে দগ্ধ করে বিশুদ্ধ করে তুলবে, হয়তো সেদিন মানুষ ছোটত্বের বোঝা মাথায় নিয়ে বড় হয়ে উঠবে।

 

সুত্রঃ বাংলাদেশ প্রতিদিন