ছোটগল্প ‘রাহাতের বন্দি ইচ্ছেগুলো’

সিল্কসিটিনিউজ সাহিত্য ডেস্ক:

‘রাহাতের বন্দি ইচ্ছেগুলো’

-মনিরুজ্জামানা শেখ রাহুল

বাড়িতে নতুন মেহমানের আগমন। ব্যাপক শোরগোল। ঘুম ভেঙে যায় রাহাতের। বড় হা করে হাম তোলে। এরপর তাকায় বাইরের দিকে। অনেক হাসাহাসির শব্দ ভেসে আসে তার কানে। বিছানা ছেড়ে উঠে দেখতে যায় বাইরে।
মেহমান এসেছে। দাদীর দুর সম্পর্কের আত্মীয়। একটু সামনে যেতেই তার মা আসিয়া তাকে পরিচয় করে দেয়। রাহাত সালাম দেয়। সালামের উত্তর নিয়ে আত্মীয়দের একজন বলে উঠে, আসিয়া তোমার ছেলে অনেক বড় হয়ে গেছে। কিন্তু তোমার মত হয় নি।
বলে রাখা ভালো রাহাতের বয়স নয় বছর। চুল কোকড়া, গায়ের রং শ্যামলা, সামনের দুটি দাঁত বড়, কঙ্কালসার দেহ অতিথিদের মনে নেতিবাচক মনোভাবের জন্ম দেয়। সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টি। তবুও কিছু মানুষ যে কেন এই সৃষ্টিকে অন্য দৃষ্টিতে দ্যাখে তা বোঝা খুবই দুর্বিষহ।
অতিথিরা এসেছে হাসপাতালে রোগি দেখাতে। রাহাতদের বাড়ির পাশে হাসপাতাল। তাই কয়েকদিন এখানেই থাকবে। ত থাকুক। সমস্যা কি? রাহাতের দাদি বিথি বেগম দয়ার হাত বাড়িয়ে দেয়।
আজ শুক্রবার। দিনটিতে ধনী শ্রেণির পরিবারগুলোতে বিশেষ রীতি চালু আছে। ওই দিনে দুপুরের খাবার আয়োজনে গরু বা মুরগির মাংস থাকা চাই। তবে গরিব মানুষের নিকট এসব আয়োজন যেনো রাজভোগের সমান। শহরে থাকলেও রাহাত দরিদ্র পরিবারেই হয়েছে। প্রতিদিনের খাবারের রুটিনে থাকা ভাতের সাথে আলু ভর্তা, শাক ভাজি ও সবজিতে সে যেনো কোন স্বাদ পায় না। একটু ভিন্ন হলে ভালো হয়। তবে সপ্তাহে একবার রুই বা সিলভার কার্প মাছ কেনা হয়। কিন্তু সেই মাছ শুধু শুক্রবারের জন্য। এই মাছই রাহাতদের কাছে রাজভোগের মতো।

সকাল বেলা তার বাবা বাজার করে আনলে অনেক আগ্রহ নিয়ে ব্যাগের দিকে তাকায়। সেখানে শাক-সবজি ছাড়া কিছুই নেই। তার মন উদাস হয়ে যায়। আশা তো করেছিল বাজারের ব্যাগে মাংস থাকবে। মাংস না থাকুক, মাছ তো থাকবে। এগুলোর কোনটাই ছিল না। যদিও পরিবারের অসমার্থ্যতা তাকে নতুন করে বোঝানোর প্রয়োজন নেই। সবই ভালোভাবে বুঝে। তেমন জেদাজেদিও করে না। তবে সে লোভি প্রকৃতির নয়। ছোট মানুষ। একটু ভালো কিছু খাওয়ার ইচ্ছে মনে জাগতেই পারে। ছোট বয়সে কি আর সবকিছু থেকে সংযম থাকা যায়। মন মানতে চায় না। তারপরেও সে সবজি দিয়েই ভাত খায়।

বইয়ে পড়েছে মাংস বেশী খাওয়া ভালো না। অসুখ হতে পারে। তাই সে মাংস খাবে না, মাছও খাবে না। এই বলে সে নিজের মনকে রাজভোগ থেকে দুরে রাখে। কতক্ষণ আর সান্তনা দিবে? দাদীর ঘর থেকে রান্না করা মাংস রান্নার ঘ্রাণ ভেসে আসে। ভুনা মাংস’র হাঁড়ির ঢাকনা খুলেছে। অতিথিদের আপ্যায়ন করাটা সবচেয়ে বেশী জরুরী দাদির কাছে। বাড়ির কে কি খেল তা দেখাটা আবশ্যক নয়। তাদের ঘরের দরজা দিয়ে দাদির ঘর দেখা যায়। সেজন্য রাহাতের নজর পড়ে মাংসের হাঁড়ির দিকে। কয়েক টুকরো খাওয়া যায়, খেলে অসুখ হবে না। মনে কিছুটা আশ্বাস পায়। দাদি হয়ত তাকে কয়েকটা টুকরো মাংস দিয়ে যাবে। রাহাতের ভাত খাওয়া প্রায় শেষ। তবুও কয়েকটা ভাত হাত দিয়ে নাড়েচাড়ে আর দাদির ঘরের দিকে তাকায়।
তার মা বিষয়টি দেখতে পেয়ে বলে, এদিক ওদিক তাকাস ন্যা, রাহাত। ভাত খ্যায়ে তাড়াতাড়ি ঘুমিয়্যা পড়।
রাহাত মা-বাবার দিকে তাকিয়ে বলে, দ্যাখো, দাদী গরুর মাংস রান্না কর‌্যাছে। তুমি জানো গরুর মাংস আমি খাই ন্যা। স্যার বল্যাছে বেশি মাংস খ্যালে শরীলের ক্ষতি হয়। তাই খাবো না। মাংস না খ্যালে কি হবে? এ্যাগলেই ভালো।
কথাগুলো রাহাত মুখে বলে ঠিকই, কিন্তু মনটা তার পড়ে আছে মাংসের হাঁড়ির দিকে। কিন্তু কত সময় অবধি সে এই অভিনয় করে যাবে?

পাশের বাড়ির সবুজ কিছুদিন আগে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে যেয়ে পড়ে গেছে। ধনীর দুলাল বলে কথা। তাই তার বাবা তার জীবনের সাদকা দেয়ার জন্য পাড়ার সবাইকে আজ বিকালে খিচুড়ি খাওয়াবে। তবে এটা অনুষ্ঠান নয়। যে যে খাবে তার বাড়ি থেকে নিজস্ব থালা নিয়ে আসবে, দরজার সামনে সেই ভদ্রলোকের বাড়ির কেউ হাড়ি নিয়ে থাকবে। এক এক করে আসলে সবার থালাতে খিঁচুড়ি তুলে দিবে। খিঁচুড়িতে মাংস থাকবে। কিন্তু সেটা খুবই নগন্য। এসব আসলে কিছুই না। লোক দেখানো আয়োজন মাত্র। তার ছেলের জন্য সে দোয়ার ব্যবস্থা করতে পারত। তা না করে লোক দেখানো খিঁচুড়ি খাওয়ানোর আয়োজনে মেতে উঠেছে।

এদের জ্ঞান যে নাই, তা নয়। আসলে এরা সবসময় সমাজের মানুষের উচ্চ শ্রেণির মানুষ হিসেবে নিজেকে প্রকাশ করতে চায়। বড় লাইনে সবাই দাঁড়িয়ে থেকে এসে খাবার নিয়ে যাবে। এসবে আনন্দ পায় এসব ভদ্র নামক শ্রেণির মানুষেরা। রাহাত শুনতে পেরেছে। তাহলে দেরি কিসের? কাসার থালাটা ভালোভাবে ধুয়ে নিয়ে যায় খিঁচুড়ি আনতে। দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে থাকার পর থালাতে খিঁচুড়ি নিয়ে যায় বাড়িতে। থালাতে ভালোভাবে নেড়ে চেড়ে দেখে ছোট্ট একটুরো মুরগির মাংস আছে। অনেক দিন পর এইরকম সুস্বাদু খাবারের গন্ধ পেয়েছে রাহাত। মাকে বলে খাবারটা রেখে দিয়েছে, রাতে খাবে। রাতে খেতে বসার সময় সে মাংস দিয়ে খাবে, আর তার মা-বাবা খাবে না। তা কি করে হয়। ওই মাংসের টুকরোকে অর্ধেক করে তার মা-বাবাকে দিয়ে দেয়। মা-বাবা নিতে রাজি হয় না। রাহাত বলে……
-খিচুড়ি তো মাংস দিয়্যাই রান্না কর‌্যাছে। তাই খিচুড়িতে মাংসের স্বাদ আছে। খিচুড়ি খ্যালে মাংস খাওয়া হয়। একটু মাংস খ্যালে শরীলের কিচ্ছু হবে না।
মা বলে……
-তুই খ্যা। আমি মাংস খাবো না।
-আমি কষ্ট কর‌্যা অনেক বড় লাইনে দাঁড়িয়ে থ্যাকে লিয়ে এ্যাসেছি। খ্যায়ে ল্যাও। ত্যাহেলে আমি দাঁড়িয়ে থ্যকালাম ক্যান?
-না, তুই খ্যা। যেদিন বেশী পাবি সেদিন আমাদেরকে দিবি।
এই বলে মা-বাবার পাতের মাংসের টুকরাগুলো রাহাতের থালায় দেয়। কিন্তু সে তারপরেও কথা শুনে না। খিচুড়িকে তিন ভাগে ভাগ করে বলে……….
-ত্যাহেলে এই দুই ভাগ লিতে হবে।
-তুই এইরকম করিস ক্যান রাহাত? আমরা খাবো না। তুই খা।
তারপর খিচুড়ি পুরোটাই খেয়ে ফেলে রাহাত।

বাল্যকালে যেমনটি হয়। মুখরোচক টাইপের কিছু দেখলে খেতে ইচ্ছে করে। কিন্তু রাহাতের পক্ষে তা সম্ভব হয়ে উঠে না। বাড়ি থেকে একটু হাটলেই স্কুল। খুব কম দিনই টিফিনে টাকা দেয়া হয়। পরের দিন তার বাবার সাথে স্কুলে যায়। স্কুলে যেয়ে আইসক্রিমওয়ালাকে দেখে। তার বাবাকে বলে টাকা আছে তোমার কাছে? বাবা উত্তরে বলে, আছে, ক্যান কি করবি? রাহাত আইসক্রিমের দিকে আঙ্গুল দিয়ে দেখায়। বাবা তাকে একটা আইসক্রিম কিনে দেয়। অনেক স্বাদ করে খায়। পরিতৃপ্ত স্বাদ প্রকাশ করতে চোখ বড় করে মাথা নাড়ায়। মুখে হাসির রেখাটাও ফুটে উঠেছে। এই হাসি কোটি টাকা দিয়েও পাওয়া যায় না। বাবা তাকে স্কুলে দিয়ে চলে আসে।

স্কুল থেকে বাড়িতে আসার পর দ্যাখে মেহনমানদের একজন তাদের এক কোনায় মুরগি জবাই করছে। অন্যজনের হাতে আছে আরো দুইটি মুরগি। এবার আর তার সন্দেহ থাকে না। মেহমান দিয়ে বাড়িতে লোকসংখ্যা নয় জন। তিনটি মুরগি দিয়ে ভালোভাবেই দুপুরের খাবার হয়ে যাবে। শুধু হবে? ভুরিভোজ হবে। রাহাতের মনে আবার আশা জাগে। এবার হবেই। দুপুরে কোন দিন পড়তে বসে না। আজ চিন্তা করল, দুপুরে খেয়েই সে পড়তে বসবে। তাড়াতাড়ি গোসল করে ঘরে ঢুকল। তারপর খাবারের ঢাকনাগুলো উঠিয়ে উঠিয়ে দেখছে। কিন্তু কি যেন সে খুজে পাচ্ছে না। ঘরের মেঝেতে থাকা খাবারগুলো না, সে খুজছে অন্যকিছু। খাটের তলেও দেখে। না, খুজে পেল না। আবারও খুজা শুরু করল। এরমধ্যে সে আবারও রান্না করা মাংসের ঘ্রাণ পায়। হাসপাতালের রোগির জন্য মাংস নিয়ে যাবে। ঘর থেকে বের হয়ে দেখে, দাদি বক্সে ভাত ও মাংসের তরকারী তুলে দিচ্ছে। একবার ঢোক চেপে চলে আসে। আর চিন্তা করে সে কি রোগি। না, একজন সুস্থ মানুষ। এসব তো রোগির জন্য নিয়ে যাচ্ছে। তাহলে তার তো এসব না খেলেও চলবে। এই বলে, আবারো খেতে বসে।

রোগি এখন পুরোপুরি সুস্থ। তারা তাদের বাড়িতে দিকে রওনা দিবে। দাদি রাহাত বলে মেহমানদের মোটা ভারি ব্যাগটি মোড়ের দিকে নিয়ে যেতে। হায়রে মানবতা। ছোট মানুষটি ভারি ব্যাগটি নিয়ে যাবে কি করে সেটা দাদির বোধগম্যে আসল না। রাহাত রেলওয়ে স্টেশনে দেখেছে যারা যাত্রীদের ব্যাগ বহন করে তাদের টাকা দেয়। দশ বা কুড়ি টাকা। অনেক দিন থেকেই তার চিপস থেকে খুব ইচ্ছে করে। চিপসের দাম দশ টাকা। এজন্য তার বাবা মাকে বলতে পারে না। ব্যাগটি বহন করলে তাকে যদি ভালোবেসে কিছু টাকা দেয়, সেই টাকা দেয় চিপস কিনে খাবে। এই ভেবে ব্যাগটি ঘাড়ে উঠিয়ে নিয়ে যেতে শুরু করে রাহাত। যেতে যেতে রাস্তায় পড়ে যেতে লাগে। তবে চিপস খাওয়ার ইচ্ছাশক্তি তাকে আরো সবল করে তোলে। ব্যাগটি নিয়ে মোড়ে যায় রাহাত। মেহমানরা রিক্সায় উঠে ব্যাগটি নিয়ে চলে যায়। রাহাত হা করে তাকিয়ে থাকে তাদের দিকে। কি হল এটা! মেনে নিতে পারে না সে। চিপস খাওয়া ত হলো না তার। তাহলে মাঝেমধ্যে একবেলা স্টেশনে যেয়ে কুলির কাজ করলেও তো হয়। অন্য মানুষ তো বেঈমানি করবে না। যাই হোক দুই মাস পর ঈদ। ঈদের দিন তো অনেকেই পরবী দেয়। ঈদের দিনই না হয় চিপস খাবে। এক প্যাকেট কেন পাঁচ প্যাকেট খাবে। বাড়ির সবাইকে খাওয়াবে।
কিছুদিন পর শুরু হয় ক্রিকেট বিশ্বকাপ খেলা। আজ বাংলাদেশ বনাম সাউথ আফ্রিকার উত্তেজনাপূর্ণ একটি ম্যাচ। পুরো মুখে লাল-সবুজ রঙে পাগলা ভক্তের মত সাজবে রাহাতের বন্ধু মহলের সকলে। রাহাতও সাজবে। কিন্তু কিভাবে লাগাবে বা কে দিবে তাকে রং? বন্ধুরা কেউ দিবে না। আসলে সমাজে দরিদ্র মানুষদের ত নিচু চোখে দেখা হয়। সেসব ধনীর ধন কি নিতে যায় দরিদ্ররা? তবে কেন যে তারা এমন করে, তা বোঝা বড় দায়। বাড়িতে টিভি নেই। খেলা দেখবে বলে পাশের বাড়ির জানালার কাছে যায় রাহাত। রঙ্গীন এলইডি টিভিতে খেলা দেখে তার চোখ জুড়িয়ে যায়। মুশফিক বড় বড় ছক্কা হাকাচ্ছে। তার সঙ্গী মাহমুদুল্লাহ স্ট্রাইকে যেয়ে সমান তালে বলকে বাউন্ডারির ওপারে ঠেলে দিচ্ছে। ভালোই বোঝাপড়ার মধ্যে দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। ঘরের মধ্যে বাড়িওয়ালা দেখে জানালার পাশে কে যেন দাঁড়িয়ে আছে। জানালের কাছে যেয়ে বলে………
-কে, ওখানে?
-আমি রাহাত।
-কি হল? (একটু উচ্চস্বরে)
– খেলা দ্যাখছি।
– তো এখানে ক্যান? আমি কি সিনেমা হল খুল্যা র‌্যাখেছি। যাও, চল্যা যাও।
– চাচা, মুশফিকের সেঞ্চুরি দ্যাখে চল্যা যাবো। একটু দেখতে দ্যান না চাচা। (অনুরোধের স্বরে)
– না, হবে না। চল্যা যাও।

এই বলে থাই কাচের জানালাটা লাগিয়ে তার ওপর পর্দা দিয়ে দেয়। দেখলে সমস্যা কি হত? টিভি কি ক্ষয় হতে যেত? থাক না হয়। মোড়ের দিকে হাঁটা দেয় রাহাত। সেখানে বড় পর্দায় খেলা সারসরি সম্প্রচার করা হয়। মোড়ে যেয়ে দেখে দাঁড়ানোর বা বসার কোন জায়গা নেই। একটু ঘুরে দেখে পাশেই একটা মাঝারি ধরনের কড়াই গাছ। গাছের উপর উঠে একটি ডালে বসে রাহাত। কিছুক্ষণ পর পর মশা, পিঁপড়া কামড়াচ্ছে। কিন্তু খেলার দিকে তার গভীর মনোযোগ। তাই এই কামড় মনোযোগের বিভক্তি করাতে পারে না। মাঝেমধ্যে হাত দিয়ে আরেক হাত চুলকাচ্ছে, পা চুলকাচ্ছে। কিন্তু চোখ হাত-পায়ের দিকে নয়, পর্দার দিকে। অতঃপর বাংলাদেশের জয়। আনন্দ উল্লাস শুরু হয় দেশজুড়ে। রাহাতও আনন্দে নাচতে শুরু করল। নৃত্যকারের মত নাচতে হবে এমন কোন নেই। হাত-পা এলোমেলোভাবে ছুড়াছুড়ি করে নাচতে শুরু করল। বন্ধুরা একটু দুরে নাচছে। এটা দেখে সে আনন্দে যায় তাদের দিকে। কিন্তু বন্ধুরা নাচানাচি করতে করতে রাহাতের মাথায় আঘাত করে, লাথি মারে। মাটিতে পড়ে যায় রাহাত। এসব করে আবারো নাচানাচি শুরু করে তারা। ছলছল চোখে তাদের দিকে, আর বলে………
-আমাকে কে ম্যারলো?
কারো কোন উত্তর নেই। সবাই নাচছে। আবারো বলে
-আমাকে ম্যারলা ক্যান?
-কে ম্যারলো কে জানে। আমরা ত মারি নাই। তুমি দ্যাখেছো? (ওদের মধ্যে একজন)
-না, দ্যাখিনি, কিন্তু আমি জানি তোমাদের মধ্যে থ্যাকেই কেউ আমাকে ম্যারেছে। এইরকম করো ক্যান গো? বুঝি ন্যা।
একথা বলেই চোখ মুছতে মুছতে হাঁটা দেয় বাড়ির দিকে। হাঁটার সময় তার স্যান্ডেল ছিঁড়ে যায়। এখন কি হবে? তার তো একটাই স্যান্ডেল। কাল স্কুলে কি পায়ে দিয়ে যাবে? দ্রুত বাড়িতে যেয়ে কুপি বাতিটা বের করে। আগুন জ্বালায় এবং স্পঞ্জের স্যান্ডেলটির ছিঁড়ে যাওয়া দুটি অংশ আগুনে দেয়। কয়েক সেকে- ধরে রাখার পর আগুন থেকে বের করে দুটি অংশ জোড়া লাগিয়ে দেয়। অবশ্য লাগাতে যেয়ে সে আঙ্গুলে আঁচ লাগে। কিন্তু কি আর করার। স্যান্ডেলটা তো ঠিক করতে হবে। নইলে পায়ে কি দিবে? গত ঈদের পরবির টাকা জমিয়ে কিনেছিল একজোড়া স্যান্ডেল। খালাতো ভাইয়ের শ্বশুর বাড়ির দাওয়াতে যেয়ে ভালো স্যান্ডেল জোড়া হারিয়েছে। এখন এই স্পঞ্জের স্যান্ডেলটি তার অন্ধের যষ্টি।

বর্তমানে তার চাচী সাত মাসের অন্ত:সত্ত্বা। তবে একটা অনুষ্ঠানের মধ্যে দিয়ে গর্ভবতী মায়েদের মায়ের বাড়িতে পাঠানোর নিয়ম চালু আছে কিছু জায়গায়। বাড়ির সবার দাওয়াত। আজকে বাড়ির সকল সদস্য একসঙ্গে খাবে। তাহলে এবার তো কোন সমস্যা নাই। অনুষ্ঠানের খাবারের হাড়িতে কি থাকে তো সবাই জানে। রাহাত অনুষ্ঠানের কথা শুনে মুচকি হাসে। অনেকদিনই তো হলো শুধু মাংসের ঘ্রাণ নিয়ে এসেছে। কিন্তু এবার সুস্বাদু মাংসের টুকরো গলধ:করণ করবে। চাচীর মায়ের বাড়ি থেকে আসে সবজি, মসলা ও ইলিশ মাছ। এটা তো অন্য মাছ না। মাছের রাজা ইলিশ। সবাই একসাথে খেতে বসল। বসার কোন জায়গা নেই। নিজেকে কোনঠাসা করে ছোট্ট একটা জায়গায় বসে রাহাত। সরষে ইলিশ রান্না করা হয়েছে। রান্না করা মাছের ধোঁয়ার সাথে সাথে তার ক্ষুধার মাত্রাটাও বাড়তে থাকে। প্রথমে চাচীর মায়ের বাড়ির সকলকে ইলিশ মাছের টুকরো দেয়। ক্রমানুসারে আসার পর রাহাতের পাতে তুলে দেয় সবজি। সবজি খেতে শুরু করে। পরে মাছ দিবে। খেতে খেতে দেখে মেহমানদের থালায় দাদী দুই-তিন টুকরো মাছ তুলে দিচ্ছে। তারা নিতে চাচ্ছে না। কিন্তু দাদী জোর করে তুলে দিচ্ছে। রাহাতের খাওয়া প্রায় শেষ। কিন্তু তার খাবারের থালায় এখনো ইলিশ মাছ উঠেনি। ইলিশ মাছ আছে নাকি দাদীকে জিজ্ঞাসা করে রাহাত। উত্তরে না দিয়ে দাদী না শোনার অভিনয় করে। মেহমানদের একজন রাহাতকে মাছ দিতে বললেও দাদী তাকে মাছ দিতে নারাজ। বলে আগে আপনাদের হলে তারপরে রাহাতদের।

যেখানে একটু মাছ অনায়াশে রাহাতদেরকে দিতে পারত সেখানে মাছ পাতে না দিয়ে কি প্রমান করতে চাইলো দাদি সেটা রাহাতের বোধগম্যে আসল না। এক চোখে নুন আর চোখে তেল। এই রকম মানুষের বিবেক মানুষ হতে পারে! রাহাতের নেত্রযুগল আবারো অশ্রুতে ভরে যায়। রাহাত বলে দেয় ইলিশ মাছে সে খায় না, ওই মাছে অনেক কাঁটা। কাঁটা ভালোমতো তুলতে না পারলে যদি গলাতে আটকে যায়, তাহলেই ত বিপদ। তার নাকি এ্যালার্জি আছে, সেজন্যও সে ইলিশ খায় না- এই রকম অভিব্যক্তি প্রকাশ করে উপস্থিত সকলের নিকট। তবে তার মা-বাবা তার কথা শুনেই বুঝতে পারে সে কেন এইরকম কথা বলছে। মা আবারো রাহাতকে বলে ভাত নিতে ও দাদীকে বলে তার থালায় মাছের ঝোল দিতে। রাহাত বলে ঝোলেও নাকি মাছের কাঁটা থাকে, তাই সে ঝোলও খাবে না। এই বলে হাত ধুয়ে উঠে যায়। এরপর বিষন্ন মন নিয়ে বাড়ির বাইরে যায়। পায়ে হেঁটে উপস্থিত হয় মোড়ে। মোড়ে অবস্থিত রেস্টুরেন্টটি জমকালো সাজে সজ্জিত হয়েছে। ভেতর থেকে গানের আওয়াজ ভেসে আসছে। বিভিন্ন মানুষের শব্দও শোনা যাচ্ছে। রেস্টুরেন্টের পাশে এক কোনায় বসে উদাস মন নিয়ে তাকিয়ে থাকে আকাশপানে। হেমন্তের এই ক্ষণে যেন আকাশ ফেটে বজ্র নামছে। সকল আশা আকাঙ্খা যেন ধীরে ধীরে দুরে সরে যাচ্ছে। চেষ্টার কোন ক্রটি না রাখলেও যেন হতাশা নিয়ে জীবনের আগামী দিনগুলোর মুখোমুখি হতে হচ্ছে। এরমধ্যেই দেখে তার পাশে কিছু বিড়াল চেঁচামেচি করছে। রেস্টুরেন্ট এক লোক এসে বিড়ালের সামনে কয়েক টুকরো ইলিশ মাছ দিলো। বিড়ালগুলো মাছ খেতে খেতে যেন মাছের মধ্যে ঢুকে যাবে, এই রকম অবস্থা। রাহাত এসব দেখে মুচকি হাসি হাসে।

লেখক:  মনিরুজ্জামান শেখ রাহুল ছোটগল্পটি তার শ্রদ্ধেয় শিক্ষক প্রভাত চন্দ্র সাহাকে উৎসর্গ করেছেন।