ছুটির ‘ঘণ্টা বাজিয়েও’ ক্লাস চালু, উপস্থিতি নিয়ে ‘শঙ্কা’

সিল্কসিটি নিউজ ডেস্ক :

ঘণ্টা বাজিয়ে ছুটি ঘোষণা যেন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের চিরাচরিত রীতি। নামি-দামি সব স্কুলেই রোজ চলে এ রেওয়াজ। গত বুধবারও তেমনি ঘণ্টা বাজিয়ে স্কুল-কলেজে ছুটি হয়েছিল। গ্রীষ্মকালীন ছুটি শুরুর আগে শেষদিন হওয়ায় সেদিনের ঘণ্টায় হয়তো দু-চারবার বেশিই আঘাত পড়েছিল। শুধু শিক্ষার্থীরা নয়, গ্রীষ্মকালীন লম্বা ছুটির আমেজে ছিলেন শিক্ষকরাও। তবে সেই আমেজ বেশিক্ষণ স্থায়ী হয়নি। ওইদিন সন্ধ্যার ঠিক আগেই ঘোষণা আসে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গ্রীষ্মকালীন ছুটি বাতিল। রোববার (২৩ জুলাই) থেকে চলবে যথারীতি ক্লাস।

বৃহস্পতিবার (২০ জুলাই) ছিল হিজরি নববর্ষের ছুটি। এরপর শুক্র ও শনিবার (২১ ও ২২ জুলাই) সাপ্তাহিক ছুটি। তিনদিনের ‘ঝটিকা’ ছুটি কাটিয়েই ক্লাসে ফিরতে হচ্ছে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের। ১৪ দিনের গ্রীষ্মকালীন ছুটি বাতিলে ভেস্তে গেছে অনেকের অবকাশের পরিকল্পনা। এতে ভীষণ মন খারাপ অনেক শিক্ষার্থীর। বিপাকে পড়েছেন শিক্ষক-অভিভাবকরাও। দীর্ঘ ছুটির ঘণ্টা বাজিয়েও যেন ফিরতে হচ্ছে দ্রুতই। তবে এ ছুটি বাতিলে যদি শিক্ষার জন্য ভালো হয়, তাতে আপত্তি নেই শিক্ষক-অভিভাবক কারও।

রাজধানীর মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের দিবা শাখার ইংরেজি বিষয়ের এক সহকারী শিক্ষক নাম প্রকাশ না করার শর্তে জাগো নিউজকে বলেন, ‘স্ত্রী ও মেয়েকে নিয়ে ঘুরতে যাওয়ার প্ল্যান ছিল। যেদিন রাতে যাবো, সেদিন দুপুরে ঘোষণা এলো ছুটি বাতিল। আর যাওয়া হলো না। সবার একটু মন খারাপ। তবে সরকার যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তার বাইরে যাওয়ার সুযোগ নেই। যদি এতে শিক্ষার্থীরা উপকৃত হয়, তাহলে আমাদের আপত্তি নেই।’

তবে, ছুটি বাতিলের ফলে নিয়মিত ক্লাস চলবে বলে নির্দেশনা দিলেও শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি নিয়ে শঙ্কার কথা জানিয়েছেন শিক্ষকরা। তাদের ধারণা- অনেক শিক্ষার্থী বাবা-মা বা পরিবারের সঙ্গে বেড়াতে গেছে। তারা ফিরতে একটু দেরি করতে পারে। সেক্ষেত্রে প্রথম দুই-তিনদিন ক্লাসে উপস্থিতি আশানুরূপ নাও হতে পারে।

জ্যেষ্ঠ পরিসংখ্যান কর্মকর্তা তরিকুল ইসলাম। তার একমাত্র ছেলে মতিঝিল সরকারি উচ্চ বালক বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণির ছাত্র। তাদের গ্রামের বাড়ি নোয়াখালীর সেনবাগে। ঈদুল আজহাতেও ঢাকাতেই ছিলেন পরিবার নিয়ে। ছেলের স্কুল ছুটি হবে বলে ২০ জুলাই রাতে গ্রামের বাড়ি যাওয়ার জন্য বাসের টিকিট কেনেন। ফলে ছুটি বাতিল হলেও তিনি পরিবার নিয়ে গ্রামে গেছেন।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে এ নিয়ে বিড়ম্বনায় পড়ার কথা জানিয়ে পোস্ট দিয়েছেন তরিকুল ইসলাম। তিনি লিখেছেন, ‘রবি, সোমবার ছুটি নিলাম। ছেলে ও স্ত্রীকে নিয়ে বহুদিন পর গ্রামে এলাম। পরিকল্পনা ছিল ছেলেকে কিছুদিন নানাবাড়ি ও দাদাবাড়িতে গ্রামের পরিবেশে ঘুরতে সুযোগ করে দেবো। আমি মঙ্গলবার ঢাকায় ফিরবো, আর ওদের আরও এক সপ্তাহ গ্রামে রাখবো। কিন্তু ছেলের ছুটি বাতিল হওয়ায় সবাইকে এখন ফিরতে হবে। ওর (ছেলের) ভীষণ মন খারাপ।’

বাড্ডার আলাতুন্নেছা উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণিতে (বালিকা শাখা) পড়ে দেলোয়ার হোসেনের মেয়ে। মধ্যবাড্ডার ময়নারবাগ এলাকার বাসিন্দা তিনি। স্ত্রীর চিকিৎসার জন্য ভারতে যাওয়ার কথা ছিল দেলোয়ার হোসেনের। তবে মেয়ের স্কুলের ছুটি বাতিল হওয়ার কারণে যাওয়া হচ্ছে না।

দেলোয়ার হোসেন বলেন, ‘পাসপোর্ট-ভিসা করিয়েছি দুজনেরই (স্ত্রী ও তার)। মেয়েকে গ্রামে ওর নানির কাছে রেখে ভারতে চিকিৎসার জন্য যেতে চেয়েছিলাম। কিন্তু ছুটি বাতিলের কারণে হচ্ছে না। খুব ইমার্জেন্সিও নয়, সেজন্য কিছুদিন পর যাবো ভাবছি। বাসায় মেয়েকে একা রেখে যাওয়া সম্ভব নয়। আবার একা একা ও বেরিয়ে স্কুলে যেতেও চায় না।’

তবে দ্রুত ছুটি বাতিলের নোটিশ করায় শিক্ষার্থীরা ক্লাসে যথারীতি উপস্থিত থাকবে বলে মনে করেন মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ ফাওজিয়া রাশেদী। তিনি বলেন, ‘এ সিদ্ধান্ত তো সরকারের। যথাসময়ে শিক্ষা কার্যক্রম শেষ করার জন্য ছুটি বাতিলের কথা জানানো হয়েছে। আমরাও দ্রুত নোটিশ করে দিয়েছি। আশা করছি বাচ্চারা (শিক্ষার্থী) যথারীতি ক্লাসে আসবে।’

শিক্ষাপঞ্জি অনুযায়ী, বৃহস্পতিবার (২০ জুলাই) থেকে গ্রীষ্মকালীন ছুটি শুরু হওয়ার কথা ছিল। আগামী ২ আগস্ট পর্যন্ত এ ছুটি ছিল। তবে গত ১৯ জুলাই বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে রাজধানীর সেগুনাবাগিচায় আন্দোলনরত শিক্ষকদের সঙ্গে বৈঠক শেষে শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি জানান, শিক্ষপ্রতিষ্ঠানে এবার গ্রীষ্মকালীন ছুটি বাতিল করা হয়েছে। ডিসেম্বরে শীতকালীন ছুটির সঙ্গে এ ছুটি সমন্বয় করে দেওয়া হবে।

ওইদিন রাতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উপ-সচিব সাইফুর রহমান খানের সই করা আদেশে বলা হয়, আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ২০২৩ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষা কার্যক্রম যথাসময়ে সম্পন্ন করার উদ্দেশ্যে আগেই ঘোষিত ২০ জুলাই থেকে ২ আগস্ট পর্যন্ত শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন মাধ্যমিক/দাখিল, উচ্চ মাধ্যমিক/আলিম এবং কারিগরি/সমমনা পর্যায়ের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গ্রীষ্মকালীন ছুটি বাতিল করা হলো।

এতে আরও বলা হয়, ২০ জুলাই বৃহস্পতিবার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় আগামী ২৩ জুলাই রোববার থেকে শ্রেণিকক্ষে পাঠদান কার্যক্রম যথারীতি চালু থাকবে। বাতিলকৃত গ্রীষ্মকালীন ছুটি আগামী শীতকালীন ছুটির সঙ্গে সমন্বয় করা হবে।

আগামী ৩০ নভেম্বরের মধ্যে নতুন শিক্ষাক্রমে ষষ্ঠ শ্রেণির পাঠদান ও মূল্যায়নসহ অন্যান্য শ্রেণির পাঠদান ও পরীক্ষা কার্যক্রম শেষ করতে হবে বলেও বিজ্ঞপ্তিতে নির্দেশনা দেওয়া হয়।

তবে শুধু গ্রীষ্মকালীন ছুটি বাতিলের জন্য নয়, জাতীয়করণের দাবিতে শিক্ষকদের আন্দোলনের কারণেও ক্লাসে উপস্থিতি নিয়ে শঙ্কা রয়েছে। কারণ, জাতীয়করণের দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষকরা তাদের কর্মসূচি চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। ফলে যারা আন্দোলনে অংশ নিচ্ছেন, তারা ক্লাসে ফিরছেন না। অর্থাৎ বেসরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে যে অচলাবস্থা, তা কাটছে না।

বাংলাদেশ টিচার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএ) সাধারণ সম্পাদক অধ্যক্ষ শেখ কাওছার আহমেদ বলেন, ‘আমাদের আন্দোলন চলবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাক্ষাতের আশ্বাস না পেলে আমরা ফিরছি না। তিনি যত দ্রুত আমাদের ডেকে পাঁচ মিনিট সময় দেবেন, তত দ্রুত আমরা ক্লাসে ফিরে যাবো।’

গ্রীষ্মকালীন ছুটি বাতিল হওয়ায় রোববার থেকে ক্লাস শুরু হচ্ছে- এ প্রসঙ্গে করা এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘শ্রেণিকক্ষে তালা দিয়েই তো গত ১১ জুলাই থেকে আমরা আন্দোলন করছি। ছুটি তো ছিল ২০ জুলাই থেকে। তার আগেই আমরা ক্লাস বর্জন করে প্রেস ক্লাবের সামনে বসেছি। ছুটি বাতিল করে আন্দোলন দমানোর চেয়ে দাবি আদায়ে সুস্পষ্ট আশ্বাস দিলে তা শিক্ষার জন্য বেশি উপকারী সিদ্ধান্ত হতো। আশা করি সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা দ্রুত এ বিষয় বুঝবেন এবং কার্যকর সিদ্ধান্ত নেবেন।’