চোর-পুলিশ খেলায় করোনার জয়!

নিজস্ব প্রতিবেদক:


কথায় আছে চোর-পুলিশ খেলা। করোনা ভাইরাসের লকডাউন কার্যকরে এই প্রবাদটি সকলের মুখে মুখে ছিলো। পুলিশ আসলে ফাঁকা, গেলে ভরপুর। এমন অবস্থা ছিলো সবক্ষণে। ফাঁকি আর উদাসীনভাবে চলেছে সবাই। পরিমানে শুনতে হয়েছে মৃত্যুর খবর। করোনায় আক্রান্ত যে মানুষটির মৃত্যুর খবর শুনেছি, তিনি আমার আত্মীয় নন, প্রতিবেশি। তবে আগামিকাল যে মানুষটি করোনায় মরতে বসেছেন তিনি হয়তো আত্মীয়!

এই করোনায় মৃত্যু হয়েছে- পুলিশের, সাধারণ থেকে সব শ্রেণির মানুষের। এমন চোর-পুলিশ খেলায় করোনার জয়।

সর্বশেষ রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে করোনায় ১৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। সোমবার (২১ জুন) সকাল থেকে আজ মঙ্গলবার (২২ জুন) সকালে ছটা পর্যন্ত এর মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। মৃত ১৩ জনের মধ্যে রাজশাহীর ১২জন ও নাটোরের একজন রয়েছেন। করোনা চিত্রে দেখা যায়, মৃত ১৩ জনের মধ্যে ৬ জন মারা গেছেন আইসিউতে। আর ৭ জন মারা গেছেন করোনা ওয়ার্ডে চিকিৎসারত অবস্থায়।

সংক্রম রোধে চলেছে লকডাউন। কখনও সেই লকডাউন কঠোর হিসেবে ঘোষণা এসেছে প্রশাসনের পক্ষ থেকে। যত কঠোর হোক না কেনো তাকে কি হয়েছে! বাড়ির বাইরে যে বের হতেই হবে। হ্যাঁ বিষয়টা ঠিক তাই ছিলো। লকডাউনে শুধু মাত্র- গুরুত্বপূর্ণ পেশার মানুষগুলো বেইরে বের হবে প্রয়োজনে। সবাই থাকবে ঘরে।

কিন্তু বাস্তব চিত্র ছিলো ভিন্ন। লকডাউন চলাকালে রাজশাহীতে গুরুত্বপূর্ণ ছাড়া একটি মানুষও ছিলেন না। কারণ সবাই বাইরে এসেছে। খেলেছে চোর-পুলিশ খেলা। আর যে মানুষগুলো চেক পোস্টে ধরা খেয়েছেন- তাদের ছিলো না অজুহাতের শেষ। এনিয়ে এক পর্যায়ে পুলিশের সাথে জড়িয়েছেন তর্কে। ও নতুন কিছু নয়।

করোনার সংক্রম রোধে প্রশাসন ও স্থানীয় পর্যায়ে অনেকগুলো উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। মাস্ক বিতরণ, খাদ্য বিতরণ (যদিও করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে রাজশাহীতে খাবার বিতরণ করতে দেখা যায়নি) লকডাউন, গুরুত্বপূর্ণ সড়ক ও মোড়ে মোড়ে পুলিশের চেক পোস্ট। মাইকিং ছিলো অব্যাহত। তবুও মানুষকে বাইরে দেখা গেছে। এই মানুষগুলোর মধ্যে কেউ বের হয়েছেন- জীবিকার তাগিদে। কেউ বা তামাশায়।

আশরাফ আলী (৪১)। পেশায় দিনমজুর। তিনি জানালেন- ‘আমরা মনে করতাম, আমাদের করোনা হবে না। কিন্তু এক সাথে কাজ করতাম। সে করোনায় মারা গেছে। তার পর থেকে আমার মধ্যে ভয় ঢুকে যায়। তবুও অনেকেই বলতো- যারা এসিতে থাকে, দামি দামি গাড়িতে চড়ে, বড় লোক তাদের করোনা হবে। কিন্তু কই! সবাইর তো করোনা হচ্ছে। তিনি আরও জানান- ‘করোনায় প্রথম বার অনেকেই ত্রাণ দিয়েছিলো। এবার কেউ দেয়নি। তাই নিজের সংসার চালাতে কাজে এসেছি। বাড়িতে খাবার থাকলে কাজে আসতাম না। মৃত্যুর ভয় সবারই আছে।’

দেশে করোনা ধরা পড়ে ২০২০ সালের মার্চে। আক্রান্ত ও মৃত্যু হয়েছে হাজারও মানুষের। সচেতনত করতে সরকারি-বেরকারি ভাবে নানা উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। তা চলমান রয়েছে। এনিয়ে এক বছরের বেশি সময় কেটেছে বিশ্বাস আসতে- আশরাফ আলীর মতো দিন মজুরদের। তার ধারনা পাল্টেছে- করোনায় শুধু বড় লোকরাই মৃত্যু হয় না। এটি একটি মহামরি, এই করোনা হলে তারও মৃত্যু হতে পারে।

রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শামীম ইয়াজদানী জানান, পরিস্থিতি ভয়াবহ, মানবেতর ও বিপর্যয়কর। রাজশাহীতে এখন করোনার তাণ্ডব চলছে। সংক্রমণ এখন চূড়ায় উঠে গেছে। একদিন সামান্য কমলে পরের দিন বেড়ে যাচ্ছে। রাজশাহী মেডিকেলে আক্রান্তদের চিকিৎসা নিশ্চিতে সব চেষ্টা করা হচ্ছে। অক্সিজেন, উপকরণ ও জনবল কয়েকগুণ বাড়িয়েও কুলিয়ে ওঠা যাচ্ছে না। কারণ, সক্ষমতার তুলনায় কোভিড রোগীর সংখ্যা অনেক বেশি। যারা হাসপাতালে আসছেন, তাদের ৯৯ শতাংশকেই অক্সিজেন সাপোর্ট দিতে হচ্ছে।

তিনি আরও বলেন, রাজশাহীর গ্রামে গ্রামে ছড়িয়ে পড়েছে করোনা। শেষ মুহূর্তে হাসপাতালে আসায় গ্রামের রোগীরাই বেশি মারা যাচ্ছেন।

রাজশাহী সিভিল সার্জন অফিসের তথ্যমতে, রোববার (২০ জুন) রাজশাহীতে ১ হাজার ১০১টি নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে। এরমধ্যে ৩৭৭ জনের মধ্যে করোনা শনাক্ত হয়েছে। শনাক্তের হার ২৫.১২ শতাংশ। এদিন ( রোববার) সিটি করপোরেশন এলাকায় ১ হাজার ২০২টি নমুনা পরীক্ষার মধ্যে ২৯২ জনের করোনা শনাক্ত হয়েছে।

জেলার ৯টি উপজেলা ও সিইএস অফিসসহ ২৯৯টি নমুনা পরীক্ষার মধ্যে ৮৫ জন করোনা আক্রান্ত হয়েছে। বাঘা উপজেলায় নমুনা দিয়েছে ৫৬ জন করোনা শনাক্ত হয়েছে ১১, চারঘাটে নমুনা দিয়েছে ৩৩ জনের মধ্যে পজিটিভ হয়েছে ১২ জন, পুঠিয়ায় ৪৫ জনের মধ্যে পজিটিভ ১১ জন, দুর্গাপুরে ৩৯ জনের মধ্যে পজিটিভ ১৯ জন, বাগমারায় ৩৯ জনের মধ্যে পজিটিভ ১৪ জন, মোহনপুরে ৩২ জনের মধ্যে ৮ জন পজিটিভ, তানোরে ১৩ জনের মধ্যে ৬ জন পজিটিভ, পবায় ২৪ জনের মধ্যে ২ জন পজিটিভ, গোদাগাড়ীতে ১২ জনের মধ্যে ২ জন পজিটিভ।

রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আইসিইউ ইনচার্জ আবু হেনা মোস্তফা কামাল বলেন, জুন মাসের শুরু থেকে তাঁরা ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ গ্রামের সাধারণ রোগী আইসিইউতে পাচ্ছেন; যাঁরা করোনায় আক্রান্ত হবেন, এমনটা ভাবতেও পারেননি।

স/আ