চুকনগর : আরেক জালিয়ানওলাবাগ

জীবন থেমে থাকে না, কখনও থাকেনি। করোনাযুদ্ধের ভয়াবহতায় এরই মধ্যে বাতিল হয়েছে বাংলাদেশের রক্তাক্ত ইতিহাসের অনেক বড় বড় মাইলফলকের স্মরণ, অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিজয়ের উদযাপন।

 

কেবল আমরা নই, গোটা বিশ্বকেই হয়তো এখন থেকে ঘাতক ভাইরাসটিকে সঙ্গে নিয়ে জীবনযাপনের কৌশল রপ্ত করতে হবে, থমকে যাওয়া জীবনকে সচল রাখার প্রত্যয় ঘোষণা করতে হবে। অতএব সঙ্গত কারণেই এ লেখাটিতে আমাদের জাতীয় ইতিহাসের বিয়োগান্তক ও অন্যতম নৃশংস একটি অধ্যায়কে স্মরণ করার যৌক্তিকতা খুঁজে পাই।

২৫ মার্চ ১৯৭১ ঢাকা নগরীতে ‘অপারেশন সার্চলাইট’ শুরু করার পর থেকে দেশের সব অঞ্চলে প্রকাশ্য ঘাতকের বেশে ছড়িয়ে পড়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনী। নির্বিচার বাঙালি হত্যার নীলনকশা হাতে রাষ্ট্রীয় ঘাতক বাহিনী সর্বত্র দাপিয়ে বেড়াতে থাকে। জেনারেল ইয়াহিয়া খান ও তার সরকারের নির্দেশে তারা নির্বিচার হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে বাঙালির স্বাধীনতার স্পৃহাকে চিরতরে নস্যাৎ করে দিতে মনস্থির করে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর না করার কূটকৌশল হাতে নেয়।

নির্বিচার হত্যাকাণ্ড এবং পরিকল্পিত নারী নির্যাতনসহ জ্বালাওপোড়াও নীতির ফলে মার্চ মাসের শেষ থেকেই প্রাণভয়ে ভারতের সীমান্ত অতিক্রম করতে শুরু করে লাখো মানুষ, যা ছিল বিশ্ব ইতিহাসের সবচেয়ে বড় দেশান্তরের ঘটনা।

ভিটেমাটি, সহায়সম্বল ফেলে শিশু, নারী, বৃদ্ধ, যুবাদের দেশত্যাগ সম্ভব হয়েছিল তখনকার ভারত নেত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী সরকারের সময়োচিত সিদ্ধান্তে। ভারত সরকার বর্ডার খুলে দেয়, লাখো শরণার্থীকে আশ্রয় এবং তাদের নিরাপত্তা দান করে।

ঠিক সে সময়েই ঘটে খুলনার দামুরিয়ার চুকনগরের নৃশংসতম গণহত্যা, যাকে হতাহতের সংখ্যার দিক থেকে মুক্তিযুদ্ধের সবচেয়ে বড় ও ভয়ংকর ট্রাজেডি বলে চিহ্নিত করা যায়। কারণ একদিনে, একটিমাত্র জায়গায় এবং ঠাণ্ডা মাথায় যে বিপুলসংখ্যক মানুষকে হত্যা করা হয়, তার নজির ইতিহাসে খুব বেশি নেই।

এই হত্যাকাণ্ড ঘটে ২০ মে, যা ছিল ঘটেছিল এক পাকিস্তানি সেনাকর্মকর্তার নির্দেশ ও উপস্থিতিতে। এতে জড়িত ছিল সেনাবাহিনীর সঙ্গে রাজাকার সদস্যরা, যারা হালকা মেশিনগান, সেমি-অটোমেটিক রাইফেলসহ বিভিন্ন আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করে ৮ থেকে ১০ হাজার মানুষের প্রাণ হরণ করে। বেশির ভাগ মানুষ মারা যায় ঘটনাস্থলেই। গুরতর আহতদের মধ্যে কেউ কেউ আজও বেঁচে আছেন সেই ভয়াবহ স্মৃতি নিয়ে। চুকনগর ভারতের সীমান্তের কাছাকাছি। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বর্বরতা বেড়ে যাওয়ায় ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে খুলনা, বাগেরহাট, যশোর, সাতক্ষীরা ও গোপালগঞ্জ অঞ্চলের বহু মানুষ তখন সীমান্ত অতিক্রম করতে শুরু করেছে। এলাকাজুড়ে সদ্য প্রতিষ্ঠিত রাজাকার বাহিনীর সদস্যরা ত্রাস সৃষ্টি করেছে। জামায়াতের অন্যতম শীর্ষনেতা মওলানা ইউসুফের নেতৃত্বে রাজাকার বাহিনী গড়ে ওঠে ৫ মে।

এরপর থেকে খুলনা শহরসহ জেলার বিভিন্ন এলাকায় ত্রাসের মাত্রা বেড়ে যায়। রাজাকাররা মুক্তিবাহিনীর সদস্য সন্দেহে যাকে-তাকে ধরে এনে ‘কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে’ নিয়ে অত্যাচার চালায়, হত্যা করে, হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের ঘরবাড়ি লুটসহ হত্যা, নির্যাতন ও নারী নিগ্রহ চালাতে থাকে। এরই মধ্যে আসে ১৫ মে। খবর ছড়িয়ে পড়ে পাকিস্তানি সৈন্যরা আসছে লোকজন ধরতে, ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দিতে।

ফলে ভয়ের মাত্রা দ্বিগুণ হয়। সবকিছু ফেলে হাজার হাজার গ্রামবাসী নদী পেরিয়ে প্রাণভয়ে জড়ো হয় চুকনগর বাজার, পাতখোলা ও ভদ্রা নদীর চারপাশে, যাতে তারা সাতক্ষীরার সড়ক ধরে বর্ডার পাড়ি দিতে পারে। কিন্তু পথে সেনাদের মুখোমুখি হওয়ার ভয়ে তারা কোথাও যেতে পারে না। ফলে বিশাল এক জনগোষ্ঠীর সম্মিলন ঘটে এলাকায়। ২০ মে সকাল সাড়ে ১০টার দিকে তিনটি ট্রাক ও জিপে চেপে এগিয়ে আসে এক মিলিটারি কনভয়, সঙ্গে পথপ্রদর্শক রাজাকার। হাতে লাইট মেশিনগান ও সেমি-অটোমেটিক রাইফেলসহ নানা মারণাস্ত্র। তারা চুকনগর বাজারের পাশে ঝাউতলায় এসে দাঁড়ায়, এবং এটিও নিশ্চিত হয় যে, অবরুদ্ধ এই জনগোষ্ঠীর কেউ সশস্ত্র নয়, বরং দেশ ছেড়ে পালাতেই তারা সমবেত হয়েছে।

অতএব শুরু হয় নির্বিচার গুলিবর্ষণ। থেমে থেমে এই গুলিবর্ষণ চলে বেলা ৩টা পর্যন্ত। প্রত্যক্ষদর্শী, যারা কোনোভাবে বেঁচে গেছেন, তাদের বয়ান এরকম : ওরা পশুপাখির মতো গুলি করে মানুষ মেরেছে, উন্মত্ত মাতালের মতো গুলি ছুড়েছে।

অসহায় হয়ে, মাটিতে শুয়ে সে দৃশ্য দেখতে হয়েছে আমাদের, ভাগ্যগুণে বেঁচে গেছি। শুধু এই নয়, সৈন্যদের নির্বিচার গুলি থেকে বাঁচতে বহু মানুষ নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ে বাঁচার আশায়। নদীতেও নির্বিচার গুলি চালায় উন্মত্ত সৈন্যরা- রক্তাক্ত হয়ে ওঠে নদীর পানি। চারদিকে তখন কেবল লাশের স্তূপ, রক্তের স্রোত, যা নামতে থাকে নদীর পানিতে। বাতাস ভারী হয়ে ওঠে হাজারও নারী-পুরুষ-শিশু-বৃদ্ধের আর্তনাদে।

এ হত্যাকাণ্ডে সর্বাধিক মারা গেছে হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা, যারা পরিবার-পরিজন নিয়ে দেশত্যাগের চেষ্টা করেছিল। সৈন্যরা চলে যাওয়ার পর স্থানীয়রা শত শত লাশ নিক্ষেপ করেছে পানিতে, মাটি চাপা দিয়েছে।

একাধিক গবেষক দল, সাংবাদিক, অনুসন্ধান ও গণহত্যা পর্যবেক্ষক পরবর্তীকালে বিস্তারিত বিবরণ খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করেন চুকনগর গণহত্যার। প্রতিটি অনুসন্ধানে লোমহর্ষক নৃশংসতার বিবরণ মেলে। সে বিবরণ এতটাই হৃদয়বিদারক যে চুকনগরের গণহত্যাকে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর হাতে পাঞ্জাবের জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সহজেই তুলনা করা চলে, চুকনগরে মৃত ও আহতের সংখ্যা যদিও অনেক বেশি।

১৯৭১ সালের ২০ মে যেমন বাংলাদেশের একটি কাল দিন, তেমনি ১৯১৯ সালের ১৩ এপ্রিল ব্রিটিশ ভারতের কাল দিন। বিনা পরওয়ানায় গ্রেফতার হন শীর্ষ স্বাধীনতা সংগ্রামী ডা. সত্যপাল ও সাইফুদ্দিন কিসলু। ‘বৈশাখী’ নববর্ষের দিনে অমৃতসরের মার্গে সমবেত হন কয়েক হাজার নারী-পুরুষ ও শিশু শান্তিপূর্ণ সমাবেশ করতে। কিন্তু ইংরেজ ব্রিগেডিয়ার জেনারেল রেগিনাল্ড ডায়ারের নির্দেশে নিরস্ত্র জনতার ওপর চালানো হয় গুলি। নিহত হয় শিশু ও নারীসহ অন্তত ৪০০ মানুষ। মহাত্মা গান্ধী ডায়ারকে ‘কসাই’ বলে অভিহিত করলেন, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ তার ‘নাইট’ উপাধি পরিত্যাগ করলেন। অবশ্য এর ২১ বছর পর এ হত্যাকাণ্ডের মূল পরিকল্পনাকারী পাঞ্জাবের তখনকার গভর্নর জেনারেল মাইক্যাল ডায়ারকে প্রাণ দিতে হয় স্বাধীনতা সংগ্রামী উধান সিংহের বুলেটে, খোদ লন্ডনের মাটিতে।

চুকনগরে স্মৃতিসৌধ গড়ে উঠেছে। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য, আমরা পারিনি সেই গণহত্যাকারীদের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে। এমনকি সেই পাকিস্তানি ব্রিগেডিয়ার মোহাম্মদ হায়াত, যে ব্যক্তি ঘাতক দলটিকে নেতৃত্ব দিয়েছিল, সেও ফিরে গেছে পাকিস্তানের মাটিতে।

হারুন হাবীব : মুক্তিযোদ্ধা, লেখক ও মুক্তিযুদ্ধ গবেষক

 

সুত্রঃ যুগান্তর