চীনের লংমার্চ রকেটের ৪০০তম উৎক্ষেপণ ও প্রসঙ্গকথা

মহাকাশ-গবেষণায় রকেট তথা পরিবাহক-রকেট অত্যাবশ্যকীয় একটি উপাদান। কথায় বলে: ‘মহাকাশ শিল্পের উন্নয়ন মূলত নির্ভর করে পরিবাহক-রকেটের বহনক্ষমতার ওপর’।

বস্তুত, রকেটের সাহায্যেই কৃত্রিম উপগ্রহ, মহাকাশযান ইত্যাদিকে মহাশূন্যে পাঠানো হয়। রকেটের বহনক্ষমতা তাই গুরুত্বপূর্ণ।

বিশ্বেমহাকাশ-গবেষণার শুরুর দিকে রকেটের বহনক্ষমতা ছিল কম। পরে এই ক্ষমতা ক্রমশ বেড়েছে। চীনের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। চীন তার নিজস্ব প্রযুক্তিতে তৈরি লংমার্চ সিরিজের প্রথম রকেট ‘লংমার্চ ১’ (Long MarchⅠ) উৎক্ষেপণ করেছিল ১৯৭১ সালের এপ্রিলে।

‘লংমার্চ ১’-এর বহনক্ষমতা ছিল মাত্র ৩০০ কিলোগ্রাম। অন্যভাবে বললে, এই রকেট পৃথিবীর নিকটতম কক্ষপথ (low earth orbit) পর্যন্ত ৩০০ কিলোগ্রাম ওজনের যন্ত্রপাতি বহন করে নিয়ে যেতে সক্ষম ছিল।
এই রকেট চীনের প্রথম কৃত্রিম উপগ্রহ তুংফাংহুং-১-কে বহন করে নিয়ে গিয়েছিল মহাকাশে। আর এর মাধ্যমে চীন, বিশ্বের পঞ্চম দেশ হিসেবে, নিজস্ব প্রযুক্তিতে তৈরি পরিবাহক-রকেট ব্যবহার করে পৃথিবীর কক্ষপথে কৃত্রিম উপগ্রহ স্থাপনের সক্ষমতা অর্জন করে।

এরপর চীনকে আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। এখন পর্যন্ত চীন প্রায় কুড়ি ধরনের লংমার্চ পরিবাহক-রকেট তৈরি করেছে। এর মধ্যে অনেকগুলো ধরন এখন আর ব্যবহার করা হয় না। তবে, ১১ ধরনের লংমার্চ রকেট এখনও ব্যবহৃত হচ্ছে বিভিন্ন মিশনে।

এখন পর্যন্ত চীন মহাকাশে যত মিশন পাঠিয়েছে, সেগুলোর ৯২ শতাংশের বেশি মিশনে ব্যবহৃত হয়েছে লংমার্চ পরিবাহক-রকেট। এই ৯২ শতাংশ মিশনে লংমার্চ রকেট দেশি-বিদেশি ৭ শতাধিক কৃত্রিম উপগ্রহ মহাকাশে স্থাপন করেছে। আর লংমার্চ পরিবাহক-রকেটের সাফল্যের হারও বেশি—৯৬.২৫ শতাংশ।

গত ১০ ডিসেম্বর শুক্রবার ছিল লংমার্চ পরিবাহক-রকেট সিরিজের জন্য একটি উলে­খযোগ্য দিন। এদিন সকালে এ রকেটের ৪০০তম উৎক্ষেপণসম্পন্ন হয়।

লংমার্চ-৪বি নামক এ রকেট মহাকাশে বহন করে নিয়ে যায় একাধিক কৃত্রিম উপগ্রহ। এ পরিবাহক-রকেটের নির্মাতা শাংহাই একাডেমি অব স্পেসফ্লাইট টেকনোলজি। ১০ ডিসেম্বর পর্যন্ত যে ৪০০ লংমার্চ রকেট উত্ক্ষেপণ করা হয়েছে, সেগুলোর মধ্যে ১৪৮টি নির্মাণ করেছে শাংহাইয়ের উক্ত প্রতিষ্ঠান। আর বাকি ২৫২টি রকেট নির্মাণ করেছে বেইজিংয়ে অবস্থিত চায়না একাডেমি অব লঞ্চ ভিকিকল টেকনোলজি।

বলা বাহুল্য, এ দুটো প্রতিষ্ঠানই চায়না এরোস্পেস সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি কর্পোরেশানের অঙ্গ-প্রতিষ্ঠান।

লংমার্চ পরিবাহক-রকেটের শততম উৎক্ষেপণের জন্য অপেক্ষা করতে হয়েছিল দীর্ঘ ৩৭ বছর। এর পরের মাইলফলকগুলো অর্জনে সময় কমতে থাকে জ্যামিতিক হারের চেয়েও দ্রুত গতিতে। সাড়ে সাত বছর লেগেছে পরবর্তী এক শতটি লংমার্চ রকেট উৎক্ষেপণে।

প্রায় চার বছরে তৃতীয় এক শত রকেট মহাকাশে উৎক্ষেপণকরে চীন। আর শেষ এক শত রকেট উৎক্ষেপণে চীন সময় নেয় মাত্র দুই বছর নয় মাস। চাঁদ থেকে নমুনা সংগ্রহ করে আনা হয়েছে যে-মিশনে, সেখানেও ব্যবহার করা হয়েছে লংমাচ রকেট; চীনের মঙ্গল অভিযানেও এই রকেট ব্যবহার করা হয়েছে।

লংমার্চ পরিবাহক-রকেট চীনকে মহাকাশ-গবেষণায় শক্তিশালী দেশে পরিণত করতে রেখেছে ও রাখছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা।

লংমার্চ পরিবাহক-রকেটের সাফল্যের প্রেক্ষাপটটি বুঝতে আমাদেরকে একটু পিছন ফিরে তাকাতে হবে। বিংশ শতাব্দির নব্বইয়ের দশকে চীনা মহাকাশ-বিজ্ঞানীরা উপলব্ধি করেন যে, মহাকাশের গভীরে অনুসন্ধান চালাতে হলে, আরও অগ্রসর, শক্তিশালী, ও বর্ধিত বহনক্ষমতাসম্পন্ন পরিবাহক-রকেট তৈরি করতে হবে। এ উপলব্ধি থেকে একটি পরিকল্পনাও তৈরি করা হয়।

২০০১ সালে সেই পরিকল্পনা অনুমোদিত হয়। চীনা বিজ্ঞানীরা তখন থেকেই নতুন প্রজন্মের নন-টক্সিক, দূষণমুক্ত, ও  উন্নত পরিবাহক-রকেট তৈরির জন্য গবেষণা শুরু করেন।

তবে, সেই গবেষণার ফল পেতে এক দশকের বেশি সময় অপেক্ষা করতে হয়। ২০১৫ সালের ২০ সেপ্টেম্বর চীন নতুন প্রজন্মের প্রথম পরিবাহক-রকেট ‘লংমার্চ ৬’-এর সফল উৎক্ষেপণকরে।

থাই ইউয়ান উপগ্রহ উৎক্ষেপণকেন্দ্র থেকে রকেটটি একসঙ্গে ২০টি কৃত্রিম উপগ্রহ মহাশূন্যে বহন করে নিয়ে যায়। চীন সেবারই প্রথম একটি রকেটে একাধিক কৃত্রিম উপগ্রহ মহাশূন্যে পাঠায়। এর ক’দিন বাদে, ২৫ সেপ্টেম্বর, চিউছুয়ান উপগ্রহ উৎক্ষেপণকেন্দ্র থেকে উৎক্ষেপণকরা হয় ‘লংমার্চ ৯’।

এটি ছিল চীনের প্রথম সলিড রকেট (solid rocket)। ২০১৬ সালের ২৫ জুন মাঝারি আকৃতির পরিবাহক-রকেট ‘লংমার্চ ৭’ উৎক্ষেপণকরা হয়। নতুন প্রজন্মের এই রকেটটি পৃথিবীর নিকট কক্ষপথে ১৪ টন ওজনের সাজ-সরঞ্জাম বহন করে নিয়ে যায়।

চীনের বৃহত্তম ও উচ্চ বহনক্ষমতাসম্পন্ন পরিবাহক-রকেট ‘লংমার্চ ৫’-এর সফল উৎক্ষেপণসম্পন্ন হয় ২০১৬ সালের ৩ নভেম্বর। এটি প্রযুক্তিগত দিক দিয়ে এ পর্যন্ত চীনের সবচেয়ে অগ্রসর পরিবাহক-রকেট। এটি তৈরিতে চীনা বিজ্ঞানীদের সময় লেগেছে প্রায় দশ বছর। এতে আড়াই শতাধিক নতুন প্রযুক্তি ব্যবহার করেছেন তাঁরা। এর মধ্যে ১২টি ‘মূল প্রযুক্তি (coretechnologies) এবং ২৪৭টি ‘বুনিয়াদি প্রযুক্তি’।

তবে, হাইনান প্রদেশের ওয়েনছাং উপগ্রহ উৎক্ষেপণকেন্দ্র থেকে রকেটটির উৎক্ষেপণকাজ শতভাগ মসৃণ ছিল না।

সেদিন স্থানীয় সময় বিকেল সাড়ে পাঁচটায়—নির্ধারিত উৎক্ষেপণসময়ের ঠিক আধা ঘন্টা আগে—রকেট বুস্টারে কিছু সমস্যা ধরা পড়ে। ফলে, উৎক্ষেপণপিছিয়ে দেওয়া হয় ৭টা ১ মিনিট পর্যন্ত। এর পর, অন্য দু’তিনটি ছোট-খাটো সমস্যার কারণে, আরও দু’বার উৎক্ষেপণের সময় পেছানো হয়। এর মধ্যে একবার কাউন্টডাউন শুরুর এক মিনিট আগে উৎক্ষেপণস্থগিত করা হয়।

অবশেষে, রাত আটটা ৪৩ মিনিটে—নির্ধারিত সময়ের ১৬৩ মিনিট পর—রকেটটি উৎক্ষেপণকরা হয়। লংমার্চ ৫-এর সফল উৎক্ষেপণের ফলে চীনের মহাকাশ-গবেষণা এক নতুন পর্যায়ে প্রবেশ করে; যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার পর চীন আবির্ভূত হয় পরিবাহক-রকেট খাতে নতুন পরাশক্তি হিসেবে।

লংমার্চ ৫-এর বহনক্ষমতা সর্বোচ্চ ২৫ টন। অন্যভাবে বললে, এই রকেট পৃথিবীর নিকটতম কক্ষপথে ২৫ টন পর্যন্ত মালামাল বহন করে নিয়ে যেতে সক্ষম।

যেমনটি আগেই উল্লেখ করেছি, চীন বিগত দেড় দশকে বিভিন্ন ধরনের নতুন প্রজন্মের আধুনিক পরিবাহক-রকেট তৈরি করেছে। এসব রকেটের সাহায্যে পৃথিবীর নিকট , মধ্যম, ও উচ্চ কক্ষপথে বিভিন্ন ধরনের উপগ্রহ বা মহাকাশযান পাঠানো যায়।

২০২০ সালের মে মাসের শুরুতে চীন সাফল্যের সঙ্গে লংমার্চ ৫বি রকেট উৎক্ষেপণকরে। এটি ছিল লং মার্চ পরিবাহক-রকেটের ৩৩১তম উৎক্ষেপণ।

চীনের পরিবাহক-রকেট পরিবারের সদস্যসংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে। পরিকল্পনা অনুসারে, ২০২০ সালের ২২ ডিসেম্বর ‘লংমার্চ ৮’ প্রথম বারের মতো উৎক্ষেপণকরা হয়। এটি ছিল লংমার্চ রকেট পরিবারের ৩৫৬তম ফ্লাইট। ৫০.৩ মিটার লম্বা রকেটটি উৎক্ষেপণের১৫ মিনিট পর পৃথিবীপৃষ্ঠ থেকে ৫১২ কিলোমিটার উঁচুতে পৌঁছায় এবং ‘নিউ টেকনোলজি ডেমোন্সট্রেটর ৭’ নামক একটি পরীক্ষামূলক উপগ্রহ ও অন্য ৪টি ছোট প্রাইভেট উপগ্রহ কক্ষপথে স্থাপন করে।

এই রকেট পৃথিবীপৃষ্ঠ থেকে ৭০০ কিলোমিটার উঁচুতে প্রায় সাড়ে ৪ টন মালামাল বহন করে নিয়ে যেতে সক্ষম। এটি বিভিন্ন ধরনের কৃত্রিম উপগ্রহ মহাকাশে বহন করে নিয়ে যেতে পারে। ‘লংমার্চ ৮’ তৈরি করা হয় মূলত লংমাচ-৩এ এবং লংমার্চ-৭ রকেটের ডিজাইন ও প্রযুক্তির ওপর ভিত্তি করে। এই রকেট কার্যকর ও নির্ভরযোগ্য।

আর ১৪০ টন ওজনের সাজ-সরঞ্জাম বহনক্ষমতাসম্পন্ন হেভি-লিফ্ট ‘লংমার্চ ৯’ পরিবাহক-রকেটের নির্মাণকাজও দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে। আশা করা হচ্ছে, লংমার্চ ৯-এর সফল উৎক্ষেপণের মাধ্যমে চীনের পরিবাহক-রকেটব্যবস্থা মোটামুটি সম্পন্ন হবে। এসব রকেট চীনের চাঁদে মানুষ পাঠানোর স্বপ্ন পূরণে সাহায্য করবে। পাশাপাশি, এগিয়ে যাবে চীনের গভীর মহাকাশ নিয়ে গবেষণার কাজ।

চীন পুনর্ব্যবহারযোগ্য পরিবাহক-রকেট ও মহাকাশ পরিবহন প্লাটফর্ম নিয়েও গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছে। এ খাতে গবেষণার কাজ এখনও প্রাথমিক পর্যায়ে রয়ে গেছে। তবে, মহাকাশ-গবেষণায় অর্জিত চীনের সাফল্য থেকে এ ধারণা করা অমূলক নয় যে, এক্ষেত্রেও দেশটির বিজ্ঞানীরা সফল হবেন। আর তাঁরা সফল হলে গড়ে উঠবে চীনের নিজস্ব টেকসই মহাকাশ পরিবহনব্যবস্থা। আশা করা হচ্ছে, চীনের প্রথম পুনর্ব্যবহারযোগ্য পরিবাহক-রকেটের উদ্বোধন হবে ২০২৫ সালে।

এদিকে, চীনা বিজ্ঞান একাডেমির রকেট কোম্পানি সিএএস স্পেস (ঈঅঝ ঝঢ়ধপব) তৈরি করছে বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী সলিড-প্রপেলেন্ট পরিবাহক-রকেট। রকেটের নাম রাখা হয়েছে ‘জেডকে টু’। ৩৯.৭ মিটার লম্বা এই রকেট ৩.৫৫ টন ওজনের কৃত্রিম উপগ্রহ পৃথিবীপৃষ্ঠ থেকে ৭০০ কিলোমিটার উঁচু কক্ষপথে স্থাপন করতে পারবে। এই পরিবাহক-রকেট স্থলের পাশাপাশি সমুদ্র থেকেও উৎক্ষেপণকরা যাবে।

তরল জ্বালানিসমৃদ্ধ রকেট সমুদ্র থেকে উৎক্ষেপণকরা যায় না। সবকিছু ঠিকঠাক এগুলে, ‘জেডকে টু’ পরিবাহক-রকেট মহাকাশে যাবে ২০২২ সালের শেষ দিকে। যখন এই লেখা লিখছি, তখন চীন তার লংমার্চ পরিবাহক-রকেটের ৪০৫তম উত্ক্ষেপণও সম্পন্ন করে ফেলেছে।

গত ৩০ ডিসেম্বর লংমার্চ-৩বি রকেট মহাকাশে বহন করে নিয়ে যায় একটি নতুন যোগাযোগ উপগ্রহ। তারও আগে, গত ২৩ ডিসেম্বর, চীন মহাকাশে পাঠায় তার সবচেয়ে লম্বা পরিবাহক-রকেট লংমাচ-৭এ। এ রকেটের উচ্চতা ৬০.৭ মিটার। এর বহনক্ষমতা ৫৭৩ টন। ঘটনাক্রমে, ২৩ ডিসেম্বরের উৎক্ষেপণছিল চলতি বছর লংমার্চ পরিবাহক-রকেটের ৪৫তম উৎক্ষেপণ।

বলা বাহুল্য, চলতি বছর লংমার্চ পরিবাহক-রকেটের প্রতিটি মিশন ছিল সফল।

লেখক: বার্তাসম্পাদক, চায়না মিডিয়া গ্রুপ (সিএমজি)

 

সূত্রঃ যুগান্তর