চিকিৎসা ফি বৃদ্ধির গ্যাঁড়াকলে রাজশাহীর রোগীরা

নিজস্ব প্রতিবেদক:

রাজশাহীতে হঠাৎ বৃদ্ধি করা চিকিৎসা ফি নিয়ে বিপাকে পড়ছেন বাইরের ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক সেন্টারে চিকিৎসা নিতে আসা রোগী ও তাদের স্বজনরা। এ নিয়ে রোগী ও তাদের স্বজনদের মাঝে ক্ষোভ প্রচণ্ড আকারে দানা বাধলেও বিষয়টি নিয়ে কেউ কোনো প্রতিবাদ করারও সাহস পাচ্ছেন না।

এই সুযোগে অব্যাহতভাবে চিকিৎসা ফি বেড়েই চলেছে। শুধুমাত্র বাইরে চিকিৎসাসেবা দিয়ে একেকজন চিকিৎসক মাসে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিলেও নিঃশ্ব হতে হচ্ছে গরিব ও নিম্ন আয়ের রোগীদের।

  • বলা যায়, অতিরিক্ত চিকিৎসা ফি বৃদ্ধি গ্যাঁড়া কলে পড়ে হিমশিম খেতে হচ্ছে রোগী এবং তাদের স্বজনদের।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, সরকারি হাসপাতালে সঠিক বা সুবিধামতো চিকিৎসা না পেয়ে বা পাওয়া যাবে না-এমন শঙ্কায় ধনিদের পাশাপাশি এখন প্রতিদিন হাজার গরিব ও মধ্যবিত্ত পরিবারের রোগীদেরও বাইরের ক্লিনিকে বা প্যাথলোজিতে চিকিৎসার জন্য ছুটে আসছেন।

  • আবার হাসপাতাল থেকেও অনেক রোগীকে ভাগিয়ে নিয়ে গিয়ে বাইরের ক্লিনিকে বা ডায়াগনস্টিক সেন্টারে চিকিৎসা নিতে বাধ্য করা হচ্ছে। আর এই সুযোগে রাজশাহীর কিছু নামি-দামি চিকিৎসকরা হাতিয়ে নিচ্ছেন প্রতি মাসে লাখ লাখ টাকা।

আবার অনেক অখ্যাত চিকিৎসকরাও রোগী ভাগিয়ে নিয়ে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক সেজে আদায় করছেন অতিরিক্ত অর্থ।
অনুসন্ধানে আরো জানা গেছে, ৪-৫ মাস আগেও রাজশাহীতে একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসককে বাইরের ক্লিনিক বা চেম্বারে দেখাতে সর্বোচ্চ খরচ হতো ৫০০ টাকা করে। সেখানে বর্তমানে দিতে হচ্ছে ৭০০ টাকা করে।

  • রাজশাহী হাসপাতালের এবং অবসরপ্রাপ্ত অন্তত শতাধিক চিকিৎসক হঠাৎ করে রোগীদের চিকিৎসা ফি ২০০ টাকা বাড়িয়ে ৭০০ টাকা করেছেন। তিন মাসের মধ্যে একই রোগীকে চিকিৎসার জন্য এসব চিকিৎসক আদায় করছেন এখন ৫০০ টাকা করে। আবার তিন মাস ফি বেড়ে গিয়ে হচ্ছে ৭০০ টাকা।

অথচ ৬ মাস আগেও রাজশাহীতে একজন রোগী দেখাতে সর্বোচ্চ ফি দিতে হতো ৫০০ টাকা করে। আর তিন মাসের মধ্যে দিতে হতো ৩০০ টাকা করে। দুই বছর আগে তার চেয়ে আরো কম ছিল। তখন একজন রোগীর জন্য এখানকার চিকিৎসকদের চিকিৎসা ফি সর্বোচ্চ ৪০০ টাকা দিলেই হতো।
নগরীর লক্ষীপুরে অবস্থিত পপুলার ডায়াগনস্টিক সেন্টারে নিজের শিশু সন্তানকে চিকিৎসা করাতে আসা তানোরের আদিবাসি পল্লী এলাকার সুশান্ত মারান্ডি বলেন, ‘দাদা দুই-তিন কাম করলে বড় জোর ৭০০ টাকা হয়। আবার সেই টাকা দিয়্যাই তো সংসার চালাতি হয়। আর এখানে বাচ্চাকে একবার দেখতেই দিতে হলো ৭০০ টাকা। এখন বাড়ি গিয়ে খাবো কি?

তিনি আক্ষেপ করে আরো জানান, এতো টাকা নিলেও ৬-৭ ঘন্টা বসে রাখা হয় তাকে এবং তার স্ত্রীসহ শিশু সন্তানকে। এরপরই সুশান্ত মারান্ডির শিশু সন্তানকে চিকিৎসাসেবা দেন ওই চিকিৎসক।
একই প্রতিষ্ঠানে রোগী দেখেন নিউরো মেডিসিন বিভাগের একজন চিকিৎসক। তিনিও রোগী প্রতি ৭০০ টাকা করে আদায় করেন। তবে তার নিকট সিরিয়াল দিতে সকাল থেকেই রোগীকে অপেক্ষা করতে হয় লাইনে দাঁড়িয়ে। এরপর বিকেল চারটার পরে রোগী দেখা শুরু হয়। চলে রাত ১২ থেকে একটা বা দুই টা পর্যন্ত। যতক্ষণ রোগী থাকেন, ততক্ষণ চলে চিকিৎসা।
নগরীর মাইক্রোপ্যাথ ডায়াগনস্টিক সেন্টারে বসে রোগী দেখেন রাজশাহী হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের একজন চিকিৎসক।

  • গত বৃহস্পতিবার রাত ১১ টার দিকে তার চেম্বারের সামনে গিয়ে দেখা যায়, তখনো চেম্বারের সামনে অন্তত ৫০ জন রোগী। বিকেল চারটার দিক থেকে ওই চিকিৎসক রোগী দেখা শুরু করে রাত একট-দুইটা পর্যন্ত রোগী দেখেন। এর মধ্যে প্রতিদিন তিনি ২০০-৩০০ রোগী দেখেন। আর প্রত্যেক রোগীর নিকট থেকেই আদায় করেন ৭০০ টাকা করে। অথচ ছয় মাস আগেও একই চিকিৎসক আদায় করতেন ৫০০ টাকা করে।

এখানে নিজের চিকিৎসা করাতে আসা আনিছুর রহমান নামের এক রোগী বলেন, সকালে এসে সিরিয়াল দিয়েছি। সিরিয়াল হয়েছে ১২৫। সকাল থেকে বসে থাকার পরে শেষে রাত ১০টার দিকে ওই রোগীকে দেখেন একজন চিকিৎসক।
তিনি অভিযোগ করে বলেন, হাসপাতালে গেলেও ঠিকমতো চিকিৎসা পাওয়া যায় না। তদবির না করলে চিকিৎসকরা রোগী দেখেন না। আবার বাইরে চিকিৎসা নিতে এলেও ভোগান্তি আর অতিরিক্ত টাকা গুনতে হচ্ছে। মানুষ চিকিৎসা নিতে তাহলে যাবে কোথায়?

  • একইভাবে রাজশাহীর অন্তত শতাধিক চিকিৎসক প্রতিদিন লাইনে দাঁড় করিয়ে কমপক্ষে ১০০-১৫০ রোগী দেখে লাখ টাকা আদায় করলেও চিকিৎসা ফি দিনের পর দিন বৃদ্ধি করেই চলেছেন। এতে করে তাদের নিকট চিকিৎসা নিতে আসা গরিব ও মধবিত্ত পরিবারের রোগী এবং তাদের স্বজনরা পড়ছেন বেকায়দায়।

চিকিৎসকদের ফি দিতে গিয়ে পরে অষুধ না কিনেই বাড়িতে ফিরতে হচ্ছে অনেক গরিব রোগীদের-এমনটিও জানিয়েছেন ভূক্তভোগী রোগী ও তাদের স্বজনরা।
অন্যদিকে রামেক হাসপাতাল থেকে দালালদের মাধ্যমে রোগী ভাগিয়ে নিয়ে নগরীর বেশ কয়েকজন অখ্যাত চিকিৎসকও রাতারাতি আঙ্গুল ফুলে কলাগাছে পরিণত হচ্ছেন বলেও অভিযোগ উঠেছে। এদের মধ্যে একজন রয়েছেন নগরীর তালাইমারী এলাকায় নিজেই চেম্বার খুলে বসা একজন জিকিৎসক, নগরীর লক্ষীপুর বোর্ড অফিসের সামনে বসা আরেক জন চিকিৎসক, নগরীর লক্ষীপুর মোড়ের সিডিএম হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া কথিত এক চিকিৎসকসহ অন্তত ২০-২৫ জন চিকিৎসক।

  • যাদের কাজই হলো হাসপাতাল বা হাসপাতালে যাওয়ার পথের রোগীদের বিভিন্ন মাধ্যম দিয়ে ভাগিয়ে নিয়ে এসে চিকিৎসা দেওয়া। এইসব চিকিৎসকরা আবার বিভিন্ন পরীক্ষার নামেও কমিশনা বাণিজ্য করে থাকেন বলেও অভিযোগ রয়েছে।

অভিযোগ রয়েছে, নগরীর তালাইমারী এলাকায় চেম্বার খুলে বসে রোগী দেখা রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ওই চিকিৎসক বিভিন্ন উপজেলাতে গিয়েও রোগী দেখে আসেন। উপজেলা গিয়ে রোগী দেখার সময় তিনি রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বর্হিবিভাগের টিকিট দিয়েও থাকেন রোগীদের। ওই টিকিটের মাধ্যমে রোগীরা পরে হাসপাতালে এসে বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করানোর পাশাপাশি প্রয়োজনে অন্য কোনো চিকিৎসককে দিয়েও রোগী দেখাতে পারেন।
তবে চিকিৎসা ফি বৃদ্ধি প্রসঙ্গে জানতে চাইলে কয়েকজন চিকিৎসক বলেন, ‘নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য সামগ্রির দাম বাড়াসহ বিভিন্ন খাতে ব্যয় বৃদ্ধির কারণেই তাঁরাও চিকিৎসা ফি বাড়িয়ে দিয়েছেন।
রাজশাহী রক্ষা সংগ্রাম পরিষদের সাধারণ সম্পাদক জামাত খান বলেন, ‘রাজশাহী হাসপাতালের চিকিৎসকরা ঠিকমতো হাসপাতালে রোগীর চিকিৎসা দিলে কোনো রোগীকে বাইরে চিকিৎসা করাতে হবে না। কিন্তু এখানকার চিকিৎসকরা ধান্দায় থাকেন, কখন তার চেম্বারে যাবেন রোগী। এরপর তার নিকট থেকে গলা কেটে টাকা আদায় করবেন। এমন অবস্থা এখন রাজশাহীর নামি-দামি চিকিৎসকদের ক্ষেত্রেই বিরাজ করছে। এ কারণে সাধারণ রোগীরা প্রতারিত যেমন হচ্ছে, তেমনি বাইরে চিকিৎসা নিতে গিয়েও সিরিয়াল দিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা অপেক্ষা করতে হচ্ছে রোগী ও স্বজনদের।’

স/আর