চিকিৎসাসেবার নামে বাণিজ্যেই নজর

সিল্কসিটি নিউজ ডেস্ক

দেশের ষোলো কোটি মানুষের চিকিৎসাসেবা দিতে সরকারির পাশাপাশি রয়েছে ১৫ হাজারের বেশি নিবন্ধিত বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও ব্লাড ব্যাংক; যার বড় অংশই হয়েছে গত এক দশকে। এসব প্রতিষ্ঠানের অধিকাংশই সেবার চেয়ে বাণিজ্যকে অধিক প্রাধান্য দিচ্ছে। প্রতিষ্ঠানগুলো কতটুকু প্রকৃত সেবা দিচ্ছে, সেবা মানসম্মত কিনা- এসব দেখভালের জন্য স্বাস্থ্য বিভাগের তেমন কোনো তদারকিই নেই বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

মাঠপর্যায়ে ঘুরে দেখা যায়, এসব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে কোনোটিতে নেই পর্যাপ্ত চিকিৎসক; কোনোটির আবার নিবন্ধনের মেয়াদকাল অনেক আগেই ফুরিয়ে গেছে, নবায়ন করা হয়নি। আবার একই পরীক্ষার ফল প্রতিষ্ঠানভেদে ভিন্ন। এতে করে চিকিৎসা ও চিকিৎসক সম্পর্কে বিরূপ ধারণা তৈরি হচ্ছে রোগীর মনে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সাম্প্রতিক সময়ে একের পর এক চিকিৎসায় অবহেলা ও ভুল চিকিৎসার খবর জানাজানি হওয়ার মাধ্যমে মূলত বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবার ভঙ্গুর চিত্র উঠে এসেছে। নিবন্ধন আছে কিনা তা দেখতে মাঝে মধ্যে সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তর অভিযান চালালেও সেবার মান যাচাইয়ে নেই কোনো তদারকি। তারা বলছেন, যথাযথ চিকিৎসাসেবা নিশ্চিতে প্রয়োজন কঠোর পর্যবেক্ষণ। তদুপরি সর্বাধিক গুরুত্ব দিতে হবে চিকিৎসাবিষয়ক শিক্ষায়।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, দেশে বর্তমানে নিবন্ধিত হাসপাতাল, ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক সেন্টার এবং ব্লাড ব্যাংক রয়েছে ১৫ হাজার ২৪৭টি। এগুলোর বড় অংশই চলছে নবায়ন ছাড়া। প্রায় দেড় বছর আগে এসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে জোরালো অভিযান চালিয়েছিল অধিদপ্তর। কিন্তু নিয়মিত তদারকি না থাকায় অধিকাংশই আবার চালু হয়েছে।

৪২ বছর আগের সামরিক শাসনামলে জারিকৃত নীতিমালার আওতায় চলছে দেশের বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা খাত। ১৯৮২ সালের ওই আইনটি রহিত করে ২০১৮ সালে নতুন আইন করার উদ্যোগ নেয় সরকার। তবে গত ছয় বছরেও এ আইন আলোর মুখ দেখেনি। বর্তমানে নিবন্ধন পেতে ৭টি শর্ত মানতে হয়। সম্প্রতি কক্সবাজারে গিয়ে বেসরকারি একটি হাসপাতালে সুযোগ-সুবিধা না থাকা সত্ত্বেও চিকিৎসাসেবা দেওয়ার চিত্র সরাসরি দেখেন স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণমন্ত্রী ডা. সামন্ত লাল সেন। পাশাপাশি খতনা করাতে গিয়ে দুই হাসপাতালে দুটি শিশুর মৃত্যুর ঘটনায় আরও বেশি আলোচনায় আসে স্বাস্থ্যসেবার মান। এর পরই বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার হুশিয়ারি দেন তিনি।

সে অনুযায়ী গত ২৭ ফেব্রুয়ারি থেকে দেশব্যাপী অভিযান চালাচ্ছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। এ অভিযানে গতকাল পর্যন্ত ১০৬ প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে অর্ধেকেই নিবন্ধন ও নবায়ন না থাকায় বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। সতর্ক ও জরিমানা করা হয়েছে বহু প্রতিষ্ঠানকে।

গতকাল শনিবার এক অনুষ্ঠানে স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, ‘সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি হাসপাতালও থাকবে। তবে নিয়ম মেনে, শর্ত পূরণ করে চললে আপত্তি নেই। আমরা সুন্দর স্বাস্থ্যব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে চাইছি, যেখানে আস্থার সংকট থাকবে না। আমরা মানুষের জীবন নিয়ে কাজ করি। যে অভিযান চালাচ্ছি তা চলবে, বন্ধ হবে না। প্রয়োজনে আমিও যাব।’

দুজন চিকিৎসক দিয়ে চলছে ৫০ শয্যার হাসপাতাল

রাজধানীর রামপুরার বনশ্রীর জাপান-বাংলাদেশ সরকারের যৌথ প্রতিষ্ঠান ঢাকা-ইয়ামাগাতা হাসপাতাল। ৫০ শয্যার এই হাসপাতালে দায়িত্বরত চিকিৎসক মাত্র দুজন। নেই প্রয়োজনীয়সংখ্যক নার্স। এমনকি পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য নমুনা সংগ্রহের পৃথক কোনো কক্ষও নেই।

প্রতিদিন দেশি-বিদেশি রোগীরা এতে চিকিৎসা নিলেও এসব ঘাটতি নিয়েই সেবা দিয়ে আসছে প্রতিষ্ঠানটি। গত বৃহস্পতিবার সরেজমিন গিয়ে এমন অনিয়মের চিত্র দেখতে পান স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা। এ ক্ষেত্রে শুধু কারণ দর্শানোর নোটিশ প্রদান ছাড়া আর কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

শুধু তাই নয়, একই অংশীদারত্বের ইউকি ডায়াগনস্টিক সেন্টার প্রথম সারির হলেও সেখানে সিটিস্ক্যানের ব্যবস্থা পর্যন্ত নেই। নিবন্ধনও নবায়ন করা হয়নি।

শুক্রবার হাসপাতালটিতে গিয়ে দেখা যায়, হাসপাতালের ভেতরটা পরিষ্কার থাকলেও বাইরের অবস্থা খুবই নাজুক। তবে পরিবেশ নিয়ে কথা বলতে নারাজ হাসপাতালের কর্মকর্তারা।

প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপক মো. আবু হানিফ বলেন, ‘অনলাইনে ৫০ শয্যা হলেও বাস্তবে হাসপাতালটি ২০ শয্যার। ভবিষ্যতে ৫০ শয্যা করার পরিকল্পনা আছে, তাই এটি করা হয়েছে। সে অনুযায়ী ডাক্তার পাঁচজন থাকার কথা, সেটি নেই।’

একই পরীক্ষার ফল প্রতিষ্ঠানভেদে ভিন্ন

আজিমপুরের গৃহবধূ কাকলি আক্তার জানুয়ারির শেষ দিকে বুকে ব্যথা নিয়ে ঢাকার দুই সরকারি হাসপাতাল হয়ে গিয়েছিলেন ইব্রাহিম কার্ডিয়াক হাসপাতালে। সেখানে ইকো করানোর সময় চিকিৎসক তাকে বলেছিলেন, হার্টঅ্যাটাক হয়েছে। দ্রুত এনজিওগ্রাম করে কয়টা ব্লক আছে জানতে হবে। পরের দিন সব প্রস্তুতি নিয়ে ওই হাসপাতালে যাওয়ার পর তিনি জানতে পারেন, আগের দিন যিনি ইকো করেছিলেন তিনিই এনজিওগ্রাম করবেন। গৃহবধূ কাকলি আক্তার আস্থার সংকট থেকে ওই চিকিৎসক দিয়ে এনজিওগ্রাম করাননি। পরে ইটিটি পরীক্ষা করে ওই হাসপাতালের আরেকজন চিকিৎসককে দেখালে হার্টের কোনো সমস্যা নেই বলে জানান তিনি। এমনকি হার্টের কোনো ওষুধও দেননি তিনি। দুই মাস পর আবার চিকিৎসকের সঙ্গে দেখা করতে বলেন। বর্তমানে কাকলি আক্তার স্বাভাবিক জীবনযাপন করছেন।

সাত মাস আগে স্তনের পাশে ব্যথা নিয়ে সিরাজগঞ্জ জেলার বেসরকারি একটি হাসপাতালে যান মোনছে আরা খাতুন (৫৭)। পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে জানানো হয় কোনো সমস্যা নেই। পরে সিরাজগঞ্জ খাজা ইউনুস আলী মেডিক্যালে নিলে ক্যানসার শনাক্ত হয়। এতে আস্থা রাখতে পারেননি রোগী ও স্বজনরা। ঢাকার আহছানিয়া ক্যানসার হাসপাতালে নিলে সেখানেও তার ক্যানসার শনাক্ত হয়। কিন্তু নামকরা আরেকটি প্রতিষ্ঠানে পরীক্ষার পর বলা হয়, তার ক্যানসার হয়নি। পরে তিনি নিজ জেলায় ফিরে যান। সেখানে টিউমার অপারেশন করাতে গিয়ে ক্যানসার শনাক্ত হয়। শুধু ক্যানসার শনাক্ত করতেই তার ব্যয় হয়ে গেছে দুই লাখ টাকা।

মোনছে আরার ছেলে সোহাগ গাজী বলেন, ‘নানা চিকিৎসক নানান পরীক্ষা দেন, নানান কথা বলেন। কোথাও বলা হয় ক্যানসার; আবার অন্য কোথাও গেলে বলা হয়, কোনো সমস্যাই নেই। আমরা কাকে বিশ্বাস করব, কোথায় যাব?

বেসরকারিতেও সেবা পেতে ভোগান্তি

লিভার সিরোসিসে আক্রান্ত মোক্তাদির (৫৭) দীর্ঘদিন ধরে চিকিৎসা নিচ্ছেন দেশের নামকরা বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ল্যাবএইডে। লিভার চিকিৎসায় সুপরিচিত একজন চিকিৎসকের নিয়মিত রোগী তিনি। নরসিংদীর এই বাসিন্দা গত ১৯ ফেব্রুয়ারি যান চিকিৎসা নিতে। রাত ৭টায় ডাক্তার দেখানোর কথা। সময়মতো চেম্বারে হাজির হলেও চিকিৎসকের দেখা পান রাত ১১টায়, যা নিয়ে চরম ক্ষোভ প্রকাশ করেন তার স্ত্রী রাবেয়া বেগম। তিনি বলেন, ‘দুই হাজার টাকা ভিজিট দিয়ে নরসিংদী থেকে দেখাতে এসেছি। চার ঘণ্টা বসিয়ে রেখে ডাক্তার এসেছেন। টাকা দিয়েও সেবা পেতে এমন ভোগান্তি খুবই দুঃখজনক।’

এই অভিজ্ঞতা শুধু মোক্তাদিরের নয়, এই চিকিৎসকের অধীনে সেবা নেওয়া অধিকাংশ রোগীর। ল্যাবএইড কর্তৃপক্ষ ও ওই চিকিৎসকের পুরনো রোগীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বছরের প্রায় প্রতিদিনই তিনি রাত ৩টা পর্যন্ত রোগী দেখেন। ঘণ্টার পর ঘণ্টা রোগীকে বসিয়ে রাখেন। তবে এ নিয়ে কেউ প্রকাশ্যে কথা বলতে নারাজ।

দুই বছরেও করা যায়নি ক্যাটাগরি

বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবার মান বাড়াতে প্রায় দুই বছর আগে ক্যাটাগরি করার উদ্যোগ নেয় সরকার। তবে নানা জটিলতায় সেটি এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে রয়ে গেছে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলছে, বেসরকারি হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোকে তিন ক্যাটাগরিতে ভাগ করা হবে। এমআরআই, সিটিস্ক্যানসহ সব ধরনের রোগ নির্ণয়ের সক্ষমতা আছে এমন প্রতিষ্ঠানকে প্রথম সারির ধরে পর্যায়ক্রমে দ্বিতীয় ও তৃতীয় ক্যাটাগরি করা হবে। সে অনুযায়ী রোগ নির্ণয়ের মূল্য নির্ধারিত হবে। তবে ২০২২ সালের শুরুতে নেওয়া এমন পদক্ষেপের অগ্রগতি নেই বললেই চলে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আহেমদুল কবির আমাদের সময়কে বলেন, ‘যে কোনো উদ্যোগ নিলে নানা দিক চিন্তা করতে হয়। ক্যাটাগরি করার বিষয়টি নিয়ে শীর্ষ পর্যায়ে আলোচনা হয়েছে। তবে খুব বেশি একটা অগ্রগতি হয়নি।’

কঠোর মনিটরিং বাড়াতে পারে সেবার মান

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ডা. মো. কামরুল হাসান বলেন, ‘বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা এখন সরকারির চেয়েও বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে। ব্যবসার উদ্দেশ্যে এসব প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠলেও সেবার বিষয়টিকে প্রাধান্য দিতে হবে। এ জন্য দরকার কঠোর তদারকি। কিন্তু সেই সক্ষমতা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নেই। মাঝে মধ্যে অভিযান চালিয়ে এসব অনিয়ম ঠেকানো যাবে না। এ জন্য প্রয়োজনে অধিদপ্তরের বাইরে আলাদা উইং করতে হবে।’

তিনি বলেন, ‘বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে চিকিৎসার পরিবেশের অনেক ঘাটতি রয়েছে। ফলে মানুষ আস্থা পাচ্ছে না। রোগী চায় ডাক্তার তার কথা মনোযোগ দিয়ে শুনুক। কিন্তু সেটি খুব একটা দেখা যায় না। এ ছাড়া অনেক জায়গায় বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, টেকনিশিয়ান এবং ল্যাব না থাকার পরও চলছে। এতে করে মানুষ সেবা নিতে গিয়ে প্রতারিত হচ্ছে।’

আস্থা বাড়াতে চিকিৎসা শিক্ষায় গুরুত্ব দিতে হবে

স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের (স্বাচিপ) সাবেক সভাপতি অধ্যাপক ডা. ইকবাল আর্সলান বলেন, ‘সরকারি কিংবা বেরকারি-যেটাই হোক- আস্থা ফেরাতে হলে মেডিক্যাল চিকিৎসা শিক্ষায় গুরুত্ব দিতে হবে। প্রতিবছর মেডিক্যাল কলেজের সংখ্যা ও আসন বাড়িয়ে আত্মতুষ্টি আমাদের ভয়ংকর খারাপের দিকে নিয়ে যাবে। বর্তমানে প্রশিক্ষণ ছাড়াই গ্র্যাজুয়েট হয়ে বের হচ্ছে। যার কারণে সেবা দিতে গিয়ে ভুল চিকিৎসার ঘটনা ঘটছে। ডাক্তার বানানোর এই মেশিন এখনই থামানো না গেলে সামনে আরও ভয়ংকর রূপ নেবে।’