চালকেরা কি শোধরাবেন না?

সিল্কসিটিনিউজ ডেস্ক:

গতকাল রোববার রাতে ফেসবুক খুলে আঁতকে উঠি। সহকর্মী অনুজপ্রতিম কমল জোহা খানের দেওয়া স্ট্যাটাস রীতিমতো ভয়ংকর। পরে কমলের মুখ থেকেই পুরো ঘটনাটি জানলাম।

প্রেসক্লাবে যাওয়ার উদ্দেশ্যে কারওয়ান বাজার থেকে নিউভিশনের বাসে ওঠেন কমল। সঙ্গে সহধর্মিণী। ওই সময় বাস ছিল খানিকটা ফাঁকা। পরপর কয়েকটি জায়গা থেকে যাত্রী তোলার পর বাসটি পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে। নামার বিড়ম্বনার কথা মাথায় রেখে কমল আগে থেকেই বাসের সহকারীকে কয়েকবার মনে করিয়ে দেন, প্রেসক্লাবের সামনে এলে যেন থামানো হয়। ঢাকার যাত্রীবাহী বাসগুলোর প্রেসক্লাবের সামনে নিয়মিতই দু-চার মিনিট থেমে থাকে। কিন্তু কমলকে বহন করা বাসটি সে নিয়ম মানেনি। কমল এ ব্যাপারে বাসচালককে অনুনয়-বিনয় করেও সাড়া পাননি।

বাসটি বেশ খানিকটা দূরে পুরানা পল্টনে গিয়ে থামে। এ সময় বাসচালক আচমকা উত্তেজিত হয়ে কমলের ওপর চড়াও হন। তাঁর মুখ ও পায়ে আঘাত করেন। কমল নেমে গিয়ে সাদাপোশাকে থাকা ট্রাফিক সার্জেন্টকে বিষয়টি জানান। তিনি এসে বাসটি থামানোর চেষ্টা করলে চালক তাঁর নির্দেশ অমান্য করে বাসটি চালিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেন। এ সময় বাসটির ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে যায় এবং পুনরায় তা চালু হয়নি। সার্জেন্ট চালককে পাকড়াও করে শাহবাগ থানায় হস্তান্তর করেন। এ ঘটনায় ওই চালকের বিরুদ্ধে শাহবাগ থানায় মামলাও হয়েছে। চালক এখন শ্রীঘরে।
কমল বলেন, চালক ওই বাসটি তাঁর ওপর দিয়ে এমনকি ওই সার্জেন্টের ওপর দিয়ে চালানোর চেষ্টা করেন। এতই আক্রোশ! ওই বাসটির বন্ধ হওয়া ইঞ্জিন যদি ওই সময় চালু হতো, চালক যদি অন্ধ আক্রোশে বাসটির চাকাগুলো সবেগে সচল করতে পারতেন, তাহলে কী হতো?

হয়তো আজ ওই লেখার বদলে অন্য একটা শোক-বিধুর লেখা লিখতে হতো। যা ঘটেনি, তা নিয়ে বেশি কথা না বলাই ভালো। তবে বাসচালকদের ওই দুর্বিনীত আচরণ, ঔদ্ধত্য আর অবলীলায় এই প্রাণহানি ঘটানোর মতো দুঃসাহস আর কত দিন সইতে হবে আমাদের? আজকের এই নিরাপদ সড়ক দিবসে এটা সবচেয়ে বড় প্রশ্ন বলে মনে করি। বাসচালক তাঁর নাম রাসেল বলে জানিয়েছেন। তাঁর ড্রাইভিং লাইসেন্স নেই এবং ওই গাড়ির ফিটনেস সার্টিফিকেট নেই। বাস চালনায় অনিয়মের কারণে একাধিক মামলা রয়েছে চালকটির বিরুদ্ধে। এমন ঘটনা অহরহই ঘটছে। ভারী হচ্ছে প্রাণহানির পাল্লা।
মাত্র মাস দুয়েক আগে, ২৯ জুলাই ঢাকার কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের সামনের বিমানবন্দর সড়কে বাসচাপায় মিম ও আবদুল করিম নামের দুই শিক্ষার্থী নিহত হলো চালকের বেপরোয়া বাস চালনার ফলে। এ নিয়ে দেশজুড়ে সোচ্চার হয়েছিল বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা। বিশেষ করে, কোমলমতি ছোট শিক্ষার্থীদের স্বতঃস্ফূর্তভাবে রাস্তায় নেমে এসে সুশৃঙ্খলভাবে গাড়ি চালানোর ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখার বিষয়টি ছিল প্রশংসনীয়। কর্তৃপক্ষের চোখে আঙুল দিয়ে তারা বুঝিয়ে দিয়েছিল, কোনো রকম অভিজ্ঞতা ছাড়াই কেবল সদিচ্ছা আর চেষ্টা দিয়ে কীভাবে যানবাহন পরিচালনায় নিয়ম-শৃঙ্খলা বজায় রাখা যায়। দেশবাসীর মনে বিপুল আশার সঞ্চারও ঘটে যে এবার নিশ্চয়ই সড়কে সুষ্ঠু পরিবেশ ফিরে আসবে। চালকেরা যাঁরা বেপরোয়াভাবে গাড়ি চালান, তাঁরা ফিরে আসবেন লাইনে। আসুরিক প্রবৃত্তিকে হটিয়ে মানবিক মনোবৃত্তির জয় হবে। কিন্তু বাস্তবে এর প্রতিফলন কোথায়?

এই তো, আজ সকালে অফিসে এসেই পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে হলো চাঁদপুরের হাজীগঞ্জের দুর্ঘটনার খবরের। সোমবার ভোর রাতে চাঁদপুরের হাজীগঞ্জ উপজেলায় সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছে তিনজন। রোববার রাতে মোহাম্মদপুর থানার কাছে সিটি হাসপাতালের সামনে নাবিলা নামের এক শিশুকে পিষে মারে এক বেপরোয়া পিকআপ। এমনই সব সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেই চলেছে। ভারী হচ্ছে নিহত মানুষের পাল্লা। প্রথম আলোর হিসাব অনুযায়ী, ৬০৫ দিনে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত মানুষের সংখ্যা ৫ হাজার ছাড়িয়েছে। এই মৃত্যুর মিছিলের যেন শেষ নেই। এ যেন মহামারিকে হার মানাতে চলেছে। দেখে মনে হয়, এতে কারও কিছু যায়-আসে না। সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে, পটাপট প্রাণ যায়, স্বজনেরা বুক চাপড়ে আহাজারি করেন, তারপর সব হজম হয়ে যায়।

এসব দুর্ঘটনার মধ্যে কিছু ঘটনায় হত্যার জোরালো অভিযোগ রয়েছে। গত ২৭ আগস্ট দুপুরে চট্টগ্রাম নগরের প্রবেশমুখ সিটি গেটের পাশে গ্ল্যাক্সো কার্যালয়ের সামনে রেজাউল করিমকে বাস থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে হত্যা করা হয়। মাস তিনেক আগে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিবিএ পঞ্চম বর্ষের শিক্ষার্থী সাইদুল রহমান পায়েলকে বাস থেকে নদীতে ফেলে দিয়ে হত্যা করা হয়। এখনো এই মামলার বিচার শুরু হয়নি।

এপ্রিলে রাজধানীতে দুই বাসের রেষারেষিতে হাত খুইয়ে তরুণ রাজীবের মৃত্যুর ঘটনাও কি এ ধরনের নয়? মে–তে দুই বাসের রেষারেষির ঘটনায় ঢাকা ট্রিবিউনের বিজ্ঞাপন বিভাগের জ্যেষ্ঠ নির্বাহী নাজিম উদ্দিনের মৃত্যুর ঘটনাও কি হত্যাকাণ্ড নয়?

এই লেখাটি যখন লিখছি, ঠিক এ সময় এল আরেকটি মর্মান্তিক দুর্ঘটনার খবর। রাজধানীর যাত্রাবাড়ীতে রাস্তা পার হওয়ার সময় দুই বাসের মাঝে চাপা পড়ে মো. সেলিম (২২) নামের একজন নিহত হয়েছেন। বেলা একটার দিকে এই দুর্ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় আহত হন একজন।

মানুষ যখন কোনো অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা, অপরাধ বা এ ধরনের কোনো ঘটনার প্রতিকার না পায়, প্রত্যাশিত শৃঙ্খলা ফিরে না আসে, তখন নিরুপায় হয়ে নিয়তির ওপর নির্ভর করে। তবে কি বলব সড়ক দুর্ঘটনা আমাদের নিয়তির বাগানে কুল ভরা এমন এক গাছ যে নিয়তি ইচ্ছেমতো গাছ ঝাঁকাবে, আর পাকা কুলের মতো টুপটাপ করে মানুষের প্রাণ ঝরে পড়বে?