চারজনের লাশ মিলেনি, স্বীকৃতিও অধরা

শাহিনুল আশিক: 

মাটির দোচালা টিনের বাড়িতে দুই ছেলে ও এক মেয়েকে নিয়ে বসবাস করছেন মুক্তিযুদ্ধকালে নিহত আবদুস সালামের স্ত্রী রাজিয়া বেগম (৮৫)। বয়সের ভারে অনেকটাই নুইয়ে পড়েছেন। চলাফেরা ঠিকঠাক করতে পারেন না। মুক্তিযুদ্ধকালে নিহত সালামের স্ত্রী রাজিয়া বলেন, সেদিন সম্ভবত রোববার। বিকালে চা-পান খেতে মোড়ে গিয়েছিলেন স্বামী সালাম। সেখান থেকে তাকে (আবদুস সালাম) ও রুস্তমকে ধরে নিয়ে যায় পাক হানাদার বাহিনীর সদস্যরা। তাদের বেলপুকুর এলাকায় একটি বটগাছের সঙ্গে দড়ি দিয়ে বেঁধে হাতে হ্যান্ডকাপ পরিয়ে আটকে রাখে। তার পরে গুলি করে তাদের হত্যা করে হানাদার বাহিনী।
তার পরের দিন বিকেলে পাশের গ্রামের এক ছেলে এসে বলে আপনার স্বামীকে গুলি করে হত্যা করেছে খানেরা। মৃত্যু খবর শুনেই আমার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো। ছোট ছোট ছেলে-মেয়েকে নিয়ে আমি তখন দিশেহারা। এলাকার লোকজনকে অনেক জিজ্ঞাসা করেছি, তারা কোন খোঁজ দিতে পারেনি। খুঁজেছি গোপনে ও প্রকাশ্যে। দেখা পাইনি। লাশটা পেলও মনকে সান্ত¦না দিতাম। মৃত্যুর পরেও মরা মুখটাও দেখতে পাইনি।
বুধবার এভাবেই ১৯৭১ সালের ভয়াবহ দিনের কথা বলছিলেন তিনি। তিনি রাজশাহীর পবা উপজেলার কাটাখালী পৌরসভা এলাকার কাপাশিয়া এলাকায় বসবাস করে। যুদ্ধের সময় শুধু সালামই নয়, মায়ের ভাষার জন্য জীবন দিয়েছেন অনেকেই। তবে তাদের ঠাঁই হয়নি সরকারের কোনো সহযোগিতার খাতায়। এখনও কষ্টের মধ্যে দিন পার করতে হচ্ছে তাদের।

রাজশাহীর পবা উপজেলার কাটাখালী পৌরসভা এলাকার কাপাশিয়া এলাকায় মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সদস্যরা

নিহত মুক্তিযোদ্ধাদের পরিবার ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, ’৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি সেনাদের গুলিতে বেলপুকুরে পাঁচজন মারা যায়। এর মধ্যে চারজনের মরদেহ এখনো খুঁজে পাইনি পরিবার। তারা হলেন, তরফ খাঁ এর ছেলে রুস্তম খাঁ। তিন ছেলে, দুই মেয়ে তার। দেশ স্বাধীনের পরে স্ত্রী মারা যায়। সামাদ মন্ডলের ছেলে আবদুস সালাম। দুই ছেলে এক মেয়ে ও স্ত্রী ছিলো তার। বর্তমানে সালামের স্ত্রী রাজিয়া বেগম জীবিত আছেন। এছাড়া মৃত তমিজ উদ্দিনের ছেলে হারেজ উদ্দিন। দুই ছেলে-মেয়ে। স্ত্রী পরে মারা যায়। আলিমুদ্দিনের ছেলে ইয়াকুব আলী। তার দুই মেয়ে ও স্ত্রী পরে মারা যান।
এছাড়া নূরু মন্ডলের ছেলে ইন্তা মন্ডল বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে ‘জয় বাংলা’ বলে স্লোগান দেয়। এসময় পাকিস্তানি সেনারা ইন্তাকে ব্রাসফায়ার করে হত্যা করে। মালেক সরদারের ছেলে নসির সরদার, তিনি যুদ্ধ চলাকালে পাক সেনাদের গুলিতে আহত হন। দেশ স্বাধীনের দীর্ঘদিন পরে মারা যান তিনি।
’৭১ সালের যুদ্ধের সময়কার কিছু কথা শোনালেন, স্থানীয় মনসুর রহমান, জিল্লুর রহমান, গোলাম রাব্বানি ও হাসিবুল হক। তারা জানায়, ’৭১ সালে বেলপুকুর এলাকায় মুক্তিবাহিনীর সদস্যরা খানসেনাদের বাঁধা দিতে দূর্গ গড়ে তোলে। সেই সময় খানসেনাদের অতর্কিত হামলায় নিহত হন বেস কয়েকজন। তাদের অনেকেরই মরদেহ পাওয়া যায়নি।
মুক্তিযুদ্ধে নিহত পরিবারের সদস্যরা জানায়, স্বাধীনতার পরে বঙ্গবন্ধু সরকার তখন এক হাজার টাকা ও এক বান্ডিল টিন দিয়েছিলেন। তার পরে আর কোনো খবর নেয়নি কেউ। অনেক সরকার এলোগেলো যুদ্ধে নিহত পরিবারগুলোর পাশে কেউ দাঁড়ায়নি। এমনকি খোঁজও নেয়নি।
মুক্তিযোদ্ধা আকবর আলী বলেন, তারা অনেক কষ্ট করে বসবাস করছে। সরকার তাদের পাশে দাঁড়ালে এই অসহায় মানুষগুলোর উপকার হতো।
তিনি বলেন, এই এলাকায় বেশ কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে। সেখানে নেই শহিদ মিনার। বিভিন্ন দিবসে মুক্তিযোদ্ধার পরিবারের লোকজনরা শ্রদ্ধা জানানোর জয়গা পাই না। এলাকাবাসীর দাবি এই কাপাশিয়ার একটি শহিদ মিনার স্থাপনের।
রাজশাহী জেলা প্রশাসক হামিদুল হক বলেন, বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে দেখা হচ্ছে। পরিবারের সদস্যরা প্রয়োজনীয় কাগজপত্র নিয়ে যোগাযোগ করলে যাচাই-বাচাই করে দেখা যাবে।

স/আ