চামড়াজাত পণ্যে প্রতারণা

সিল্কসিটিনিউজ ডেস্ক:

‘চামড়ার মানিব্যাগ ১০০ টাকা, চামড়ার মানিব্যাগ ১০০ টাকা। বাইছ্যা লন, দেইখ্যা লন ১০০ টাকা’- রাজধানীর ফুটপাতে হাঁটলে অথবা বাসে চড়লে প্রায়ই কানে আসবে এমন শব্দ। সাধারণত হকাররা এভাবেই মানিব্যাগ বিক্রি করেন।

মানিব্যাগগুলো যে চামড়ার সেটা বোঝাতে ক্রেতার সামনেই আগুন দিয়ে পরীক্ষা করে দেখানো হয়। এতে সন্তুষ্ট হয়ে দাম কম বলে অনেকে মানিব্যাগ কিনে নেন।

অনেকের মনে প্রশ্ন জাগে আসলেই মানিব্যাগগুলো চামড়ার কিনা? এর উত্তর হচ্ছে, ‘না’। চামড়ার মানিব্যাগের নামে ক্রেতার সঙ্গে প্রতারণা করা হচ্ছে। এসব মানিব্যাগ রেক্সিন দিয়ে তৈরি। যেগুলোকে কৃত্রিম লেদার বলা হয়। দেখতে হুবহু চামড়ার মতো। সাধারণ চোখে দেখে বোঝার উপায় নেই যে এগুলো কৃত্রিম চামড়া বা রেক্সিন।

তবে হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া করলেই বোঝা যায় এগুলো যে কৃত্রিম চামড়া দিয়ে তৈরি। আর ব্যবহারের ফলে ধীরে ধীরে রেক্সিনের ওপরের আস্তরণ উঠে যায়। রেক্সিনের তৈরি মানিব্যাগই চামড়ার বলে প্রতারণা করা হয়। শুধু হকার নয়, বড় বড় শপিংমলেও এসব মানিব্যাগ চড়া দামে বিক্রি করা হয়। এগুলো পুরান ঢাকার বিভিন্ন কারখানা তৈরি।

রাজধানীর গুলিস্তান ও মতিঝিলের ফুটপাত ঘুরে দেখা গেছে, এসব জায়গায় নানা দামের চামড়ার মানিব্যাগ বিক্রি হয়। ১০০ থেকে ১১শ’ টাকার মধ্যে মানিব্যাগ পাওয়া যায়। কম দামে মানিব্যাগে সবচেয়ে বেশি প্রতারণা হয়। আর যেগুলো বেশি দামে বিক্রি হয়, সেগুলো শুধু ওপরেই চামড়া থাকে।

শুধু মানিব্যাগই নয়, পুরুষের বেল্ট, মহিলাদের ভ্যানিটি ব্যাগ, অফিসিয়াল ব্যাগ, জ্যাকেট ও স্যান্ডেল- সবই বানানো হয় রেক্সিন দিয়ে। ফুটপাত থেকে শুরু করে বড় বড় শপিংমলে রেক্সিনের তৈরি এসব পণ্য বিক্রি হয়। ফুটপাতে ১০০ থেকে ৩০০ টাকায় বেল্ট বিক্রি হয়।

এসব বেল্ট চামড়া দিয়ে বানানো বলে ক্রেতাদের প্রতারিত করা হয়। বেল্টের ওপরে চামড়া সদৃশ্য পাতলা রেক্সিন ও ভেতরে টিউব ব্যবহার করা হয়। বেল্টের মাথায়, যেখানে বকলেস লাগানো হয় সে প্রান্তে খেয়াল করলে বোঝা যায় যে এগুলো রেক্সিল দিয়ে তৈরি। একই অবস্থা মহিলাদের ভ্যানিটি ব্যাগে।

যদিও ভ্যানিটি ব্যাগের বেশিরভাগই চীন থেকে আমদানি করা। সবচেয়ে বেশি প্রতারণা হয় ‘স্যান্ডেলে’। চামড়ার স্যান্ডেলের বদলে রেক্সিনের তৈরি স্যান্ডেল বিক্রি হয়। দামে সস্তা হওয়ায় ক্রেতাদের খুব বেশি ভ্রুক্ষেপও থাকে না। রাজধানীর বংশালে রেক্সিন মার্কেট ঘুরে দেখা গেছে, বিভিন্ন রঙের চামড়া সদৃশ্য রেক্সিন বিক্রি হচ্ছে।

এগুলোকে অনেকে আর্টিফিসিয়াল লেদার বা চায়না চামড়া বলে। গজ অথবা রোল হিসেবে বিক্রি করা হয়। প্রতি গজের দাম ১৫০ টাকা থেকে শুরু করে ৫০০ টাকা পর্যন্ত আছে। একটু ভালো মানের রেক্সিন দেখতে হুবহু চামড়ার মতো। যে কোনো রঙের রেক্সিন পাওয়া যায়।

ফলে কারখানাগুলোতে মানিব্যাগ, বেল্ট, জুতা, শোপিস, সোফা, মোবাইল ফোনের কভার, ব্যাগ এসব পণ্য তৈরির ক্ষেত্রেও চামড়ার বদলে রেক্সিন ব্যবহার করা হয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে আংশিক চামড়া ও রেক্সিন ব্যবহার করা হয়।

কিন্তু প্রচার করা হয় পুরো চামড়া বলে। ব্যবসায়ীরা জানান, ৩ ধরনের ব্যবসায়ীরা রেক্সিনের ক্রেতা। বংশাল ও আশপাশের এলাকায় অসংখ্য কারখানা রয়েছে, যেখানে রেক্সিন দিয়ে মানিব্যাগ, পুরুষের বেল্ট, মহিলাদের ভ্যানিটি ব্যাগ, অফিসিয়াল ব্যাগ, জ্যাকেট ও স্যান্ডেল তৈরি হয়।

তারা বলেন, উন্নতমানের রেক্সিন দিয়ে পণ্য তৈরি করলে টেকনিক্যাল লোক ছাড়া সাধারণ মানুষ বুঝতেই পারবে না যে, এটা কৃত্রিম চামড়া। অথচ এগুলোই চামড়ার পণ্য বলে বিক্রি হয়। দাম কম বলে মানুষ বেশ কেনে এগুলো।

তাদের দাবি, চামড়ার চেয়ে দামে সস্তা ও সহজেই ডিজাইন করা যায় বলে দিন দিন রেক্সিনের ব্যবহার বাড়ছে। বর্তমানে চামড়ার মতো রেক্সিনের সোফা তৈরি হচ্ছে। এ বিষয়ে চামড়া ও রেক্সিন জাতীয় পাদুকা প্রস্তুতকারক সমিতির সহ-সভাপতি মো. শামীম বলেন, দেশের বাজারে বিশেষ করে মতিঝিল, গুলিস্তান ও নিউমার্কেটের ফুটপাতে যেসব স্যান্ডেল বিক্রি করা হয়, তার বেশিরভাগই রেক্সিন দিয়ে তৈরি।

স্থানীয় ব্যবসায়ীরা চীন, থাইল্যান্ড থেকে এসব স্যান্ডেল আমদানি করেন। চীন থেকে রেক্সিনের মাইক্রো ফাইবার আমদানি করা হয়, যা দেখতে হুবহু চামড়ার মতো। তবে এসব ফুটপাতে অরিজিনাল চামড়ার তৈরি স্যান্ডেলও বিক্রি হয়।

কারণ একমাত্র বাংলাদেশেই সস্তায় চামড়ার তৈরি পণ্য কিনতে পাওয়া যায়। বাংলাদেশে যে চামড়ার জুতা সাড়ে ৩ থেকে ৪ হাজার টাকায় পাওয়া যায়, এ জুতাই ইতালি, ফ্রান্সে ১২-১৫ হাজার টাকায় বিক্রি হয়। ১০০ টাকায় চামড়ার মানিব্যাগ বিক্রি সম্ভব কিনা- জানতে চাইলে তিনি বলেন, ১০০ টাকায় চামড়ার মানিব্যাগ তৈরি করা সম্ভব।

কারণ এসব মানিব্যাগে যে চামড়া ব্যবহার করা হয়, সেগুলো ওয়েস্টেজ থেকে আসে। ছোট ছোট ব্যবসায়ীরা কেজি দরে এসব চামড়া বড় বড় কোম্পানির কাছ থেকে কেনেন। তবে হকাররা যেসব মানিব্যাগ বিক্রি করে সেগুলো চামড়ার কিনা তা কেনার আগে ভালোভাবে দেখে নেয়ার পরামর্শ দেন তিনি।

তিনি জানান, প্রতি বছর প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকার রেক্সিন আমদানি করা হয়। এসব রেক্সিন দিয়ে সোফা, গাড়ির সিট, মানিব্যাগ, পুরুষের বেল্ট, মহিলাদের ভ্যানিটি ব্যাগ, অফিসিয়াল ব্যাগ, জ্যাকেট ও স্যান্ডেল বানানো হয়। দিন দিন রেক্সিনের বহুমুখী ব্যবহার বাড়ছে।