চাপে শেয়ারবাজার

সিল্কসিটি নিউজ ডেস্ক :

সামনে রাজনৈতিক অস্থিরতার আশঙ্কা। এর মধ্যেই যুক্তরাষ্ট্রের ভিসানীতি বাস্তবায়নের খবর। রিজার্ভে পড়েছে নেতিবাচক প্রভাব। ধারাবাহিকভাবে কমছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। আবার তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর পারফরমেন্সে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। অনেক কোম্পানির কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। এমনকি কোম্পানির প্রধান কার্যলয় অন্য প্রতিষ্ঠানের দখলে থাকার ঘটনাও আছে। সবকিছু মিলে এক ধনের চাপে রয়েছে দেশের শেয়ারবাজার।

এতে প্রতিনিয়ত বিনিয়োগ করা পুঁজি হারাচ্ছেন সাধারণ বিনিয়োগকারীরা। ফলে বিনিয়োগকারীদের হতাশা বাড়ছে। সেইসঙ্গে বাজারের ওপর থেকে আস্থা হারাচ্ছেন বিনিয়োগকারীরা। ধীরে ধীর লেনদেনের গতিও কমে যাচ্ছে। এরই মধ্যে লেনদেন কমে দেড় মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন পর্যায়ে চলে গেছে।

বাজারের এ পরিস্থিতি সম্পর্কে বিশ্লেষকরা বলছেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে বিনিয়োগকারীদের খুবই বিচক্ষণতার পরিচয় দিতে হবে। হুজগে বা গুজবে বিনিয়োগ না করে, সার্বিক তথ্য খুব ভালো করে পর্যালোচনা করে বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত নিতে হবে। পাশাপাশি আর্থিক ভিত শক্তিশালী ও নিয়মিত ভালো পারফরমেন্স করছে এমন কোম্পানিতে বিনিয়োগ করা উচিত। এতে সাময়িকভাবে লাভ পাওয়া না গেলেও, ভবিষ্যতে ভালো লাভ পাওয়া যেতে পারে।

তারা বলছেন, সামনে জাতীয় সংসদ নির্বাচন। এ নির্বাচন নিয়ে বিপরীত অবস্থানে রয়েছে দেশের বড় দুই রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি। আওয়ামী লীগ চাচ্ছে— যে কোনোভাবে আগামী জানুয়ারির মধ্যে নির্বাচন সম্পন্ন করতে। অপরদিকে, বর্তমান সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচন হতে দেওয়া হবে না বলে বিএনপির পক্ষ থেকে হুঁশিয়ারি দেওয়া হচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে সামনে রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

রাজনৈতিক অস্থিরতার পাশাপাশি বৈদেশি মুদ্রার রিজার্ভে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। মূল্যস্ফীতিও বাড়ছে। আবার যুক্তরাষ্ট্রের ভিসানীতির বিষয়ও রয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোও ভালো পারফরমেন্স করতে পারছে না। সবকিছু মিলেই শেয়ারবাজারে নেতিবাচক প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। আগামী জাতীয় সংসদ পর্যন্ত শেয়ারবাজারের চরিত্র বোঝা বড়ই কঠিন হবে।

তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, করোনা মহামারি শুরু হলে ২০২০ সালের শুরু থেকেই শেয়ারবাজারে নেতিবাচক প্রবণতা শুরু হয়। বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়া মহামারি করোনাভাইরাস বাংলাদেশে প্রথম আঘাত হানে ২০২০ সালের ৮ মার্চ। করোনার প্রকোপ ঠেকাতে ২৬ মার্চ থেকে ৩০ মে পর্যন্ত টানা ৬৬ দিন সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে সরকার। অপরদিকে, শেয়ারবাজারে বড় ধস নামলে ফ্লোরপ্রাইস নিয়ে আসে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)।

করোনার প্রকোপে ২০২০ সালে শেয়ারবাজারে যে নেতিবাচক প্রবণতার শুরু হয় গত তিন বছরেও সেই নেতিবাচক অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি বাজার। করোনার ধকল কাটিয়ে ওঠার আগেই বিশ্বজুড়ে নতুন সংকট সৃষ্টি তৈরি করে রাশিয়া-ইউক্রেন। গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর থেকে বিশ্বজুড়ে অর্থনৈতিক অবস্থার অবনতি হয়েছে। সেইসঙ্গে বেড়েছে বিভিন্ন পণ্যের দাম। ফলে মূল্যস্ফীতির চাপে পড়েছে সবাই।

শুধু বৈদেশি মুদ্রার রিজার্ভ নয়, নেতিবাচক প্রভাব রয়েছে তালিকাভুক্ত কোম্পানির আর্থিক অবস্থাতেও। সম্প্রতি যেসব প্রতিষ্ঠান প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, তার বেশিরভাগের আর্থিক অবস্থায় নেতিবাচক প্রবণতা পড়ার চিত্র উঠে এসেছে। এর সঙ্গে বেশকিছু প্রতিষ্ঠানের কারখানা বন্ধ থাকার চিত্র বেরিয়ে এসেছে।

ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) থেকে সম্প্রতি কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের কারখানা ও প্রধান অফিস পরিদর্শন করে পরিদর্শক দল। ডিএসইর পরিদর্শনে উঠে এসেছে- নর্দার্ন জুট ম্যানুফ্যাকচারিং, উসমানিয়া গ্লাস শীট, দুলামিয়া কটন, ফ্যামিলিটেক্স এবং রিজেন্ট টেক্সটাইলের উৎপাদন বন্ধ রয়েছে। এছাড়া নর্দার্ন জুটের প্রধান কার্যালয় ‘ওএমসি লিমিটেড’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান ব্যবহার করছে বলে দেখতে পায় ডিএসইর পরিদর্শন দল।

একদিকে রিজার্ভে নেতিবাচক প্রবণতা, অন্যদিকে তালিকাভুক্ত কোম্পানির আর্থিক দুর্বলতার তথ্য প্রকাশের মধ্যেই গত ২২ সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তর থেকে ভিসানীতি সংক্রান্ত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়। এতে বলা হয়, আজ পররাষ্ট্র বিভাগ বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক নির্বাচনী প্রক্রিয়াকে ক্ষুণ্ন করেছে বা এর জন্য দায়ী কিছু বাংলাদেশি নাগরিকের ওপর ভিসানীতি বাস্তবায়নে পদক্ষেপ নিচ্ছে। এ ব্যক্তিদের মধ্যে রয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য, ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল ও রাজনৈতিক বিরোধী দল।

এ ভিসানীতির খবর প্রকাশ হওয়ার পর গত দুই সপ্তাহ ধরেই শেয়ারবাজারে নেতিবাচক প্রভাব বিরাজ করছে। তবে ভিসানীতির সঙ্গে শেয়ারবাজারের সরাসরি কোনো সম্পর্ক নেই বলে অভিমত দিচ্ছেন কোনো কোনো বিশ্লেষক ও বাজার সংশ্লিষ্টরা। তাদের অভিমত কোম্পানির দুর্বল পারফরমেন্স ও অর্থনৈতিক অবস্থা বাজারে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।

এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক আবু আহমেদ বলেন, আমি মনে করি ভিসানীতির সঙ্গে শেয়ারবাজারের সরাসরি কোনো সম্পর্ক নেই। এখন শেয়ারবাজারে যে নেতিবাচক প্রবণতা দেখা যাচ্ছে এর মূল কারণ অর্থনীতির খারাপ অবস্থা এবং তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর খারাপ পারফরমেন্স। কোম্পানিগুলো যে প্রতিবেদন প্রকাশ করছে, তার বেশিরভাগের আর্থিক অবস্থার অবনতি হয়েছে। আবার রিজার্ভ ধারাবাহিকভাবে কমে যাচ্ছে।

বাংলাদেশ মার্চেন্ট ব্যাংকার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমবিএ) সভাপতি মো. সায়েদুর রহমান বলেন, আমার ব্যক্তিগত মতামত ভিসানীতির সঙ্গে শেয়ারবাজারের কোনো সম্পর্ক নেই। কারণ কাউকে ওই দেশে যেতে দেবে বা দেবে না, ওটার সঙ্গে আমাদের শেয়ারবাজারের ফিন্যান্সের কোনো সম্পর্ক নেই।

এদিকে দরপতনের সঙ্গে শেয়ারবাজারে লেনদেনেও খরা যুক্ত হয়েছে। বৃহস্পতিবার (৫ অক্টোবর) প্রধান শেয়ারবাজার ডিএসইতে লেনদেন কমে ৪০০ কোটি টাকার নিচে চলে এসেছে। এর মাধ্যমে প্রায় দেড় মাস পর বা গত ২০ আগস্টের পর ডিএসইতে সর্বনিম্ন লেনদেন হয়েছে।

বাজারের এ পরিস্থিতি সম্পর্কে বিনিয়োগকারী মিজানুর রহমান বলেন, যখনই ভাবি বাজার ভালো হবে, তখনই কোনো না কোনো নেতিবাচক সংবাদ আসে। সম্প্রতি বাজার যখন একটু ভালো হওয়ার লক্ষণ দেখা যাচ্ছিল, তখনই যুক্তরাষ্ট্রের ভিসানীতির খবর আসে। এরপর থেকে ধারাবাহিকভাবে দরপতন চলছে। প্রতিদিন শেয়ারের দাম কমছে। আর লোকসান বাড়ছে।

সাইফুল ইসলাম নামে আরেক বিনিয়োগকারী বলেন, এখন শেয়ারবাজারের যে আচরণ তাতে আস্থা ধরে রাখা কঠিন। কোনো শেয়ারের দাম একটু উঠলেই পরক্ষণেই দরপতন হচ্ছে। আমরা যারা সাধারণ বিনিয়োগকারী রয়েছি, তারা প্রতিনিয়ত লোকসান গুনছি। বাজার এভাবে চলতে থাকলে বিনিয়োগকারীদের আস্থা বলে কিছু থাকবে না।

ডিএসইর এক সদস্য বলেন, এখন নানা ইস্যুতে শেয়ারবাজারে নেতিবাচক প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। ভিসানীতির যেমন প্রভাব রয়েছে, তেমনি রাজনৈতিক পরিস্থিতিরও প্রভাব আছে। আবার রিজার্ভ কমে যাওয়া, খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়া, নীতি সুদহার বাড়ানোর ঘোষণাসহ সবকিছুই শেয়ারবাজারে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। শেয়ারবাজারের ওপর এখন যে চাপ সৃষ্টি হয়েছে, তা কখন কাটবে বলা মুশকিল।

তিনি বলেন, সামনে জাতীয় সংসদ নির্বাচন। এ নির্বাচনের প্রভাবও আছে শেয়ারবাজারে। তবে, এখন বাজারে নেতিবাচক প্রবণতা দেখা গেলেও সামনে বাজার ভালো হওয়ার খুব ভালো সম্ভাবনা রয়েছে। তাই বিনিয়োগকারীরা আতঙ্কি না হয়ে ভালো কোম্পানি বাছাই করে উচিত। এতে ভবিষ্যতে ভালো মুনাফা পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

শেয়ারবাজারে এখন যে নেতিবাচক প্রবণতা দেখা যাচ্ছে, তার পেছনে কি কারণ রয়েছে জানতে চাইলে বিএমবিএ সভাপতি সায়েদুর রহমান বলেন, এটা অনেক কিছুর ওপর নির্ভর করে। এটা আসলে দৃষ্টি ভঙ্গির ওপর নির্ভর করছে। আপনি দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা কীভাবে দেখছেন। যেমন কালকে বাংলাদেশ ব্যাংক নীতি সুদের হার বাড়িয়েছে। এটা আপনার মূল্যায়ন এবং আমার মূল্যায়ন এক নাও হতে পারে।

তিনি বলেন, কিছুক্ষণ আগে আমার কাছে অনেকগুলো বিনিয়োগকারী এসেছিলেন। তাদের সঙ্গে বিস্তারিত আলোচনা হলো শেয়ার দাম কমে যাচ্ছে। আরে ভাই দাম কমে যাচ্ছে মানেটা কি? আপনি কম দামে বিক্রি করছেন, এ জন্য কমে যাচ্ছে। আপনি কম দামে বিক্রি করা বন্ধ করে দেন। বিনিয়োগকারীদের পেনিক (আতঙ্ক) হলো বাজারের জন্য সব থেকে খারাপ।

রাজনৈতিক পরিস্থিতির কোনো প্রভাব আছে কি? জানতে চাইলে তিনি বলেন, নির্বাচন যখন আসে তখন একটা অনিশ্চয়তা তৈরি হয়, এটা স্বাভাবিক বিষয়। কি হবে? নির্বাচন কখন হবে? নির্বাচন পরবর্তী সরকার কাঠামো কেমন হবে, এসব বিষয় নিয়ে স্বাভাবিকভাবেই বিনিয়োগকারীদের মধ্যে চিন্তা-ভাবনা থাকে। এটাকে নেতিবাচকভাবে দেখার কোনো কারণ নেই।