চাঁপাইনবাবগঞ্জে স্কুলের ১৬ বিঘা জমি বিক্রি করে দিলেন প্রধান শিক্ষক-সভাপতি

নিজস্ব প্রতিবেদক:
যেন পুকুর চুরিকেও হারানো মানার গল্প। আবার গল্পও নয়, বাস্তবেই ঘটেছে সেটি। আর ঘটনাটি হলো- চাঁপাইনবাবগঞ্জের গোমস্তাপুরের একটি স্কুলের সরকারি প্রায় ১৬ বিঘা জমি বিক্রি দিয়েছেন প্রধান শিক্ষক ও সভাপতি। জমি বিক্রির প্রায় কোটি টাকা বগলদাবা করেছেন প্রধান শিক্ষক হেমন্ত কুমার ও বিদ্যালয় পরিচালনা পর্সদের তৎকালীন সভাপতি এসএম নূরুল হক।

আবার জমিগুলো কিনেছেন চাঁপাইনবাবগঞ্জের অটোরাইচ মিল ব্যবসায়ী ও জামায়াত নেতা নজরুল ইসলাম। তবে তিনি তাঁর নামে জমিগুলো দলিল করে নেননি। তিনি তাঁর স্ত্রী মনোয়ারার নামে প্রায় কোটি টাকার ওই সম্পতি মাত্র ৪৭ লাখ টাকার দলিল মূল্যে কিনে নিয়েছেন।

এমনই চাঞ্চল্যকর ঘটনাটি ঘটেছে ওই উপজেলার দেওপুরা উচ্চ বিদ্যালয়ে। ভয়াবহ এই দুর্নীতির ঘটনাটি জানাজানি হওয়ার পরে স্থানীয়দের পক্ষ থেকে দর্নুীতি দমন কমিশন (দুদক) ও রাজশাহী শিক্ষা বোর্ডে লিখিত অভিযোগ করা হয়েছে। অভিযোগের পরে প্রধান শিক্ষক ৩০ লাখ টাকা ফেরতের জন্য লিখিতভাবে মুচলেকা দিয়েছেন স্থানীয়দের কাছে। এ নিয়ে চরম ক্ষোভ বিরাজ করছে ওই স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মাঝে। তারা স্কুলের জমি ফেরত না পেলে আন্দোলনে যাবেন বলেও হুমকি দিয়েছেন।

গোমস্তাপুর উপজেলা সাবরেজিস্ট্রার অফিসে সম্পাদিত দলিল সূত্র মতে, গত বছরের ২৪ জুলাই চাঁপাইনবাবগঞ্জের গোমস্তাপুর উপজেলা সাবরেজিস্ট্রারের কার্যালয়ের মাধ্যমে ওই উপজেলার দেওপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের নামে সরকারি ১৫ দশমিক ৭১০০ একর জমি বিক্রির দলিলটি সম্পাদন হয়। যার নম্র ৪৪৯৯/১৮। এই জমির দলিলদাতার নামের স্থানে লিখা আছে দেওপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের পক্ষে প্রধান শিক্ষক হেমন্ত কুমার। দলিলের সনাক্তকারী হিসেবে রয়েছেন ওই স্কুলের তৎকালীন সভাপতি এসএম নূরুল ইসলাম। দলিলটি দাখিল করেছেন মইদুল ইসলাম নামের একজন দলিল লেখক (যাঁর সনদ নম্বর ২১)। আর দলিলটি সম্পাদন (রেজিস্ট্রি) করেন সাবরেজিস্ট্রার আশরাফ আলী।

তিনটি দাগে সর্বমোট ৫ দশমিক ৭ হাজার ১০০ একর (আনুমানিক ১৬ বিঘা) জমিগুলো মাত্র ৪৭ লাখ ১৪ হাজার টাকা মূল্য দেখিয়ে বিক্রি করে দেওয়া হয়। তবে স্থানীয় বাজার দর অনুযায়ী ওই জমির মূল্য কম দেখিয়ে রেজিস্ট্রি করা হয়েছে বলেও অভিযোগ করা হয়েছে। মূল্য কম দেখিয়ে বাকি টাকা লুটপাট করেছেন দলিল লেখক, সাবরেজিস্ট্রার, প্রধান শিক্ষক ও স্কুলের তৎকালীন সভাপতি।

স্থানীয় ইমিতয়াজ নামের এক ব্যক্তি অভিযোগ করে জানান, স্কুলের সম্পত্তি বিক্রি করার কোনো এখতিয়ার রাখেন না প্রধান শিক্ষক। স্কুলের সম্পত্তি মানে সরকারের সম্পত্তি। কিন্তু তৎকালীন সভাপতির সঙ্গে যোগসাজস করে সেই কাজটিই করেছেন প্রধান শিক্ষক হেমন্ত কুমার। এটি ভয়াবহ দুর্নীতি। আবার সেই টাকার অধিকাংশই তারা নিজেরা লুটপাট করেছেন। পরে বিষয়টি জানাজানি হলে প্রধান শিক্ষক ৩০ লাখ টাকা ফেরতের মুচলেকা দিয়েছেন। আর বাকি প্রায় ১৫ লাখ টাকা তিনি স্কুলের ভবন নির্মাণকাজে ব্যয় করেছেন বলে দাবি করেছেন। এই কাজটিও তিনি করতে পারেন না। তাঁর এই অনিয়মের ঘটনায় স্থানীয়দের পক্ষ থেকে তিনি নিজেই রাজশাহী শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান ও দুদকের কাছে লিখিত অভিযোগ করেছেন। অভিযোগের কথা শুনে প্রধান শিক্ষক জমি বিক্রির ৩০ লাখ টাকা ফেরত দিতে চেয়েছেন।

স্থানীয়রা আরো জানান, জমির দলিল গ্রহীতা মনোয়ারার বেগমের স্বামী নজরুল ইসলাম জামায়াতের নেতা বলে পরিচিতি। দীর্ঘদিন ধরে জামায়াতের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত থাকলেও প্রভাবশালী এই ব্যক্তিকে স্থানীয়রা নজরুল জামায়াতি বলেই ডাকেন। এই নজরুলই স্কুলের জমি কিনে নেন প্রধান শিক্ষকের নিকট থেকে। তবে পরবর্তিতে উপজেলা ভূমি অফিস থেকে জমিগুলো খারিজ (নামজারি) করতে গেলে তাতে আপত্তি জানায় ভূমি অফিস। ফলে এখনো স্কুলের নামের ওই জমিগুলো নিজের স্ত্রীর নামে খারিজ করতে পারেননি নজরুল ইসলাম।

জমি বিক্রির কথা স্বীকারো করেছেন প্রধান শিক্ষক হেমন্ত কুমার। তিনি গতকাল রবিবার কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ওই সময় ম্যানেজিং কমিটির অনুমোদন নিয়েই স্কুলের জমি বিক্রি করেছি। জমিি বিক্রির কিছু টাকা দিয়ে বিদ্যালয়ের ভবন নির্মাণ করেছি। আর বাকি টাকা আমার কাছে আছে। সেগুলো ১২ আগস্টের মধ্যে ফেরত দিতে চেয়েছি।

জমি বিক্রির দলিলে সনাক্তকারী ও তৎকালীন সভাপতি এসএম নূরুল ইসলামের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি।

তবে স্কুলের জমি নিজের স্ত্রীর নামে কেনার কথা স্বীকার করেন জামায়াত নেতা নজরুল ইসলাম। তিনি বলেন, স্কুল থেকে আমার স্ত্রীর নামে রেজিস্ট্রি করে দেওয়া হয়েছে। আমি কিনে নিয়েছি। এখানে আমাদের কোনো অপরাধ নাই।’

অন্যদিকে তৎকালীন সাবরেজিস্ট্রার আশরাফ আলী কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘হয়ত স্কুলের পক্ষ থেকে রেজুলেশন ছিল। তাই দলিলটি সম্পাদন করে দিয়েছি। কিন্তু দলিলটি না দেখলে আমি এ নিয়ে কিছু বলতে পারব না।’

আরেক প্রশ্নের জবাবে ওই কর্মকর্তা বলেন, ‘সরকারি জমি স্কুলের প্রধান শিক্ষক বিক্রি করেছেন রেজুলেশনের বলে। তিনি সেটি পারেন কিনা জানি না।’

এদিকে রাজশাহী শিক্ষা বোর্ডে চেয়ারম্যান মকবুল হোসেন বলেন, স্কুলের নামে কোনো জমি থাকলে সেটি সরকারি সম্পত্তি। এই সম্পত্তি বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের পক্ষে বিক্রি করা সম্ভব নয়। সরকার থেকে অনুমতি না নিয়ে তিনি বিক্রি করতে পারেন না। এটি চরমভাবে অনিয়ম। এই ধরনের অভিযোগ আমি এখনো আমি পাইনি। নতুন যোগদান করেছি। পেলে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের প্রধানের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

 

স/আর