চল্লিশ বছর আগে নিখোঁজ নেপালিকে নাটকীয়ভাবে পাওয়া গেলো ভারতে

১৯৭৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে নেপালের ইলাম জেলার একাতপা গ্রামের তরুণ দীপক যোশী তিমসিনা বাড়ি থেকে বেরিয়েছিলেন, কিন্তু তিনি আর বাড়ি ফিরে যাননি।

শেষ পর্যন্ত পরিবারের সদস্যরা তাকে দেখতে পেলো হারিয়ে যাওয়ার ৪০ বছর পর গত মাসে, কলকাতার দমদম কেন্দ্রীয় সংশোধনাগারে।

তার এক চাচাত ভাই প্রকাশ চন্দ্র তিমসিনা এসে কলকাতায় তার সাথে সাক্ষাৎ করেছেন।

অথচ বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় ডাল বিক্রির জন্য বের হচ্ছেন বলে জানিয়েছিলেন তিনি।

তখন নিজ গ্রামেই টুকটাক কাজ করতেন আর জ্যোতিষ চর্চা ছিল তার নেশা।

প্রকাশ চন্দ্র তিমসিনা বিবিসিকে নেপাল থেকে টেলিফোনে বলছিলেন, “আমরা তো ধরেই নিয়েছিলাম যে দাদা মারা গেছে। নেপালের সব জায়গায় খুঁজেছিলাম আমরা। কিন্তু কোনও হদিশ পাইনি”।

তিনি বলেন, “সেই সময়ে দার্জিলিং-এ গোর্খাল্যান্ড আন্দোলন চলছিল। সেই আন্দোলনের মধ্যে পড়ে গিয়ে হয়তো দাদা মারা গেছে, এটাই ভেবে নিয়েছিলাম আমরা। এত বছর পরে যে দাদার খোঁজ পাব, তা ভাবতেও পারিনি।”

এদিকে প্রায় ৪০ বছর ধরে দীপক যোশী তিমসিনা পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলে থেকেছেন বিচারাধীন বন্দী হিসাবে। চার দশকেও তার বিচার শেষ হয়নি।

বুধবার তার মামলাটা উঠবে কলকাতা হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতির ডিভিশন বেঞ্চে।

আদালত ঠিক করবে মুক্তি পেয়ে দীপক নেপালে ফিরতে পারবেন কী না।

দার্জিলিংয়ের একটি আদালতের আদেশের কপি

৪০ বছর ধরে দীপক যোশীর জীবনটা থমকে থাকলেও গত কয়েকমাসে ঘটতে শুরু করে নাটকীয় কয়েকটি ঘটনা।

গতবছর ফেব্রুয়ারি মাসে দমদম কেন্দ্রীয় সংশোধানাগারে বদলি হয়ে আসেন নন্দীগ্রাম থেকে দশ বছর আগে মাওবাদী সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত থাকার অভিযোগে পুলিশের হাতে ধরা পড়া রাধেশ্যাম দাস।

এর আগে ২০১৬ সালেও একবার মি. দাস দমদম সংশোধানাগারে ছিলেন কিছুদিন।

“গতবছর ফেব্রুয়ারিতে যখন আমাকে দমদমে আনা হল, তখন আগের পরিচিত দীপকবাবুর সঙ্গে আবারও দেখা হল। জেলে মানসিকভাবে অসুস্থ যারা থাকেন, তাদের সঙ্গে নিজের ইচ্ছাতেই আমি আলাপ করতাম। সেইভাবেই দীপকের সঙ্গে আলাপ। কথায় কথায় জানতে পারি যে তিনি ৪০ বছর ধরে জেলে আছেন, অথচ কোনও বিচার হয়নি তার,” বিবিসিকে বলছিলেন রাধেশ্যাম দাস।

সংশোধনাগার থেকে জামিনে মুক্তি পেয়ে মি. দাস যোগাযোগ করেন পশ্চিমবঙ্গ অ্যামেচার রেডিও ক্লাবের সঙ্গে। এটি হ্যাম রেডিও অপারেটরদের একটি সংগঠন।

“রাধেশ্যাম দাসের কাছ থেকে যখন শুনি যে একজন ৪০ বছর ধরে জেলে আছেন বিনা বিচারে, আমি চমকে গিয়েছিলাম। আমরা কারা দপ্তরে যোগাযোগ করি। তারাও প্রথমে বিশ্বাস করতে চাননি। কিন্তু পরে খোঁজ নিয়ে তারাও নিশ্চিত হন যে ঠিকই, দীপক যোশী তিমসিনা নামের ওই বন্দী ১৯৮১ সাল থেকে আটক আছেন এবং তার বিচার এখনও হয়নি,” জানাচ্ছিলেন রেডিও ক্লাবের সচিব অম্বরীশ নাগ বিশ্বাস।

দীপক যোশীর সঙ্গে দেখা করার অনুমতি চান মি. নাগ বিশ্বাস এবং তার ক্লাবের আরও কয়েকজন। কিন্তু পরিবারের সদস্য না হওয়ায় ক্লাব সদস্যদের মধ্যে শুধুমাত্র হীরক সিনহাই মি. যোশীর সঙ্গে দেখা করার অনুমতি পান, কারণ তিনি কলকাতা হাইকোর্টের একজন উকিল।

দীপক যোশীর মায়ের সাথে ভাই প্রকাশ

মি. সিনহা বলছিলেন, “আমার প্রথমে সন্দেহ হয়েছিল যে দীপক যোশী মানসিক ভাবে অসুস্থ কী না। কারণ আমরা নানা আদালত থেকে যেসব নথি যোগাড় করেছিলাম, তাতে সেরকমই ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তার সঙ্গে কথা বলার সময়ে আমার কখনই মনে হয়নি যে তিনি মানসিকভাবে অসুস্থ। তবে নিশ্চিতভাবেই একটা ট্রমার মধ্যে তিনি ছিলেন। আমি নেপালি ভাষা খুব ভাল জানি না, কিন্তু একটু বুঝতে পারি। সেভাবেই কথা চালাচ্ছিলাম তার সঙ্গে। কথার মাঝেই তিনি কাগজ কলম চেয়ে কয়েকটা শব্দ লিখে দেন। দেবনাগরীতে লেখা ওই শব্দগুলো বিচ্ছিন্ন মনে হলেও আসলে সেগুলো ছিল তার পরিচয়। একটা গ্রামের নাম, বাবা-মায়ের নাম, স্কুলের নাম।”

যেসব নথি যোগাড় করা গিয়েছিল মি. যোশীর সম্বন্ধে, তা থেকে জানা যায় যে ১৯৮১ সালে দার্জিলিং থেকে একটি খুনের মামলায় গ্রেপ্তার হন তিনি।

“নেপাল থেকে এসে দার্জিলিং-এর কোনও চা বাগানে কাজ করছিলেন তিনি। কেউ একজন তাকে চাকরি করিয়ে দেওয়ার কথা বলে, পরিবর্তে তাকে একটা খুন করতে বলা হয়। সেই কথায় একজনকে খুন করে ফেলেন দীপক। ধরাও পড়েন। তারপর থেকেই তিনি জেলবন্দী,” জানাচ্ছিলেন অম্বরীশ নাগ বিশ্বাস।

ধরা পড়লেও কোনও আদালতেই হাজির করানো হয়নি। কখনও বহরমপুর সংশোধনাগার, কখনও আলিপুর সংশোধনাগার, কখনও মানসিক হাসপাতাল – এভাবেই কেটে গেছে চারটে দশক।

আদালত বারবার নির্দেশ দিয়েছে দীপক যোশীর মানসিক স্বাস্থ্য পরীক্ষার। কিন্তু সেই রিপোর্ট কখনও আদালতে জমা পড়েনি।

হ্যাম রেডিও অপারেটরদের সংগঠনটি কলকাতায় নেপালি উপদূতাবাসে যোগাযোগ করেন তার ঠিকানা খুঁজে বার করার জন্য।

“নেপালে ২০১৫ সালে যে বড় ভূমিকম্প হয়েছিল, সেই সময়ে সেখানে কাজ করতে গিয়ে স্থানীয় হ্যাম অপারেটরদের সঙ্গে আমার আলাপ হয়েছিল। তাদের মধ্যেই একজন হলেন নেপাল সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী সতীশ রিশনা খারেল। আমি রেডিওতে ম্যাসেজ দিই নাইন নভেম্বর ওয়ান আলফা আলফা আর নাইন নভেম্বর ওয়ান চার্লি আলফা – নেপালের এই দুজন হ্যাম অপারেটরকে। প্রথমটা মি. খারেলের কল সাইন আর দ্বিতীয়টা অরুণ নামে এক হ্যাম অপারেটরের। এদের বিষয়টা জানাই। তারপর তারা খোঁজ করতে শুরু করেন দীপক যোশীর লিখে দেওয়া জায়গার নাম ধরে,” বলছিলেন মি. নাগ বিশ্বাস।

ইলাম জেলার চুলাচুলি গ্রামের একটি স্কুলে পড়তেন মি. যোশী, এরকমটাই জানিয়েছিলেন তিনি।

সেই গ্রামে গিয়ে জানা যায় ভূমিকম্পে স্কুলটি ধ্বংস হয়ে গেছে। স্থানীয়রা জানতে চান যে কার খোঁজ করছেন হ্যাম অপারেটররা।

“দীপকের নাম বলতেই তারা বলেন যে তিনি তো মারা গেছেন। কিন্তু তার এক ভাই ওই স্কুলেই পড়ান। কিন্তু স্কুলটা অন্য একটা জায়গায় স্থানান্তরিত হয়েছে। সেখানে গিয়ে খুঁজে পাওয়া যায় প্রকাশ চন্দ্র তিমসিনাকে। তিনিও আঁতকে ওঠেন দাদা বেঁচে আছেন শুনে। তারপর দীপকের মায়ের কাছে নিয়ে যান তিনি – সেটা পাহাড়ের ওপরে খুব দুর্গম এলাকায়,”জানাচ্ছিলেন আইনজীবী হীরক সিনহা।

“নেপালের হ্যাম বন্ধুদের কাছে আমরা যা শুনেছি, যখন মা ধনমায়া তিমসিনাকে ছেলের কথা তারা জিজ্ঞাসা করে, তখন প্রায় নব্বই বছরের ওই নারী আকাশের দিকে দেখিয়ে বলেন দীপক তো পাখি হয়ে গেছে। ঘরে নিয়ে গিয়ে দেখান যে দেবতাদের ছবির সঙ্গেই একটা ঝাপসা হয়ে যাওয়া ছবি রাখা আছে – সেটাই দীপক যোশী,” বলছিলেন অম্বরীশ নাগ বিশ্বাস।

এদিকে কলকাতা হাইকোর্ট জানতে পারে বিষয়টি। স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে আদালতই একটি জনস্বার্থ মামলা দায়ের করে। প্রধান বিচারপতির ডিভিশন বেঞ্চ নির্দেশ দেয় নেপাল উপদূতাবাসকেও মামলায় যোগ দিতে।

মামলায় সামিল করা হয় রাজ্য লিগ্যাল এইড সার্ভিসকেও। দুস্থ বন্দীদের আইনি সহায়তা দিয়ে থাকে লিগ্যাল এইড সার্ভিস।

লিগ্যাল এইডের পক্ষে হাইকোর্টে এই জনস্বার্থ মামলায় সামিল হয়েছে আইনজীবী জয়ন্ত নারায়ণ চ্যাটার্জী।

তিনি বলছিলেন, “৪০টা বছর একজনের বিচারই হল না! কীভাবে এটা সম্ভব! কার যে গাফিলতি সেটাই বোঝা যাচ্ছে না। মনে হচ্ছে ধীরে ধীরে চোখের আড়ালেই চলে গেছে মামলাটা। মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন এটা। বিচার হলে তার হয়তো শাস্তি হত, কিন্তু বেকসুর খালাসও তো হতে পারতেন এই ভদ্রলোক। কিন্তু তার বদলে ৪০টা বছর তাকে একটা বিদেশি সংশোধনাগারে কাটাতে হল।”

দাদার সঙ্গে দেখা করতে নেপাল থেকে কলকাতায় এসেছিলেন দীপক যোশীর ভাই প্রকাশ চন্দ্র।

“কলকাতায় যাওয়ার আগে মা বলে দিয়েছিলেন দাদার একটা ছবি আনতে। কিন্তু জেলের নিয়ম অনুযায়ী আমাদের ছবি তুলতে দেওয়া হয়নি। কিন্তু প্রায় ৪০ বছর পরে দাদাকে দেখে যে কী অনুভূতি হচ্ছিল, তা বলে বোঝাতে পারব না,” বলছিলেন প্রকাশ চন্দ্র তিমসিনা।

ফোনটা ছাড়ার আগে তিনি জানতে চাইছিলেন, “দাদা মুক্তি পাবে তো? ফিরতে পারবে তো চার দশক আগে ছেড়ে যাওয়া গ্রামে, মায়ের কাছে, পরিবারের কাছে?”

সূত্র:বিবিসি