চন্দ্রাবতী: স্রোতের বিপরীতে চলা বাংলার প্রথম মহিলা কবির উপাখ্যান

সিল্কসিটিনিউজ ডেস্ক:

বিভিন্ন চাকরির পরীক্ষা কিংবা ভর্তি পরীক্ষার জন্য এই একটি প্রশ্ন কমবেশি আমরা সবাই পড়ে থাকি- বাংলা সাহিত্যের প্রথম মহিলা কবি কে?

উত্তর- চন্দ্রাবতী ।

কিন্তু চন্দ্রাবতীর কবি হয়ে উঠার পেছনের গল্পটা আর বিরহের প্রেম কাহিনীটি বর্তমান প্রজন্মের অনেকের কাছে আজো অজানা। কিংবদন্তী রমণীর অনুরাগের উপাখ্যানটি জানার পর আজো আমরা অনুরণিত হই। আসুন জেনে নেওয়া যাক ষোড়শ শতকের কিংবদন্তী চন্দ্রাবতীর উপাখ্যান :-

কিশোরগঞ্জের কবি সরকার জসীম উদ্দিনের ‘কিশোরগঞ্জ স্পেশাল’ কবিতায় চন্দ্রাবতী ধরা পড়েছে এভাবে,

কিশোরগঞ্জ কিশোরী

রূপে-গুণে মিশরী

চন্দ্রাবতী নাম

নয়ান চাঁদের সেই পুঁথিটি কি অমূল্য দাম।[1]

কবি চন্দ্রাবতীর পরিচয় প্রথম দৃষ্টিগোচর হয় সংগ্রাহক চন্দ্রকুমার দে’র ১৯১৩ সালে সৌরভ পত্রিকায় প্রকাশিত প্রবন্ধের মাধ্যমে। কয়েক খণ্ডে প্রকাশিত পূর্ববঙ্গ গীতিকায় সংগৃহীত ঊনচল্লিশটি পালার মধ্য থেকে দশটি পালা নিয়ে ১৯২৩ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হয় দীনেশচন্দ্র সেন সংকলিত-সম্পাদিত মৈমনসিংহ গীতিকা।  [2] মূলত নয়ান চাঁদ ঘোষের ‘চন্দ্রাবতী পালা’র কেন্দ্রীয় চরিত্র ‘চন্দ্রাবতী’, যিনি মনসামঙ্গলের কবি দ্বিজ বংশীদাসের কন্যা ও রামায়ণের রচয়িতা। ১২টি অধ্যায়ে ৩৫৪টি ছত্রের লোকগাথাটি চন্দ্রাবতীর জীবনীর তথ্যভিত্তিক লিখিত প্রামাণ্য দলিল। বর্তমান কিশোরগঞ্জের পাতুয়ার/পাটুয়ারী গ্রামে দাঁড়িয়ে থাকা চন্দ্রাবতীর স্মৃতিবিজড়িত বাড়ি আর শিবমন্দিরটি চন্দ্রাবতীর অস্তিত্বের ঐতিহাসিক সত্ত্বা প্রমাণ করে।[3] ‘মৈমনসিংহ গীতিকায়’ চন্দ্রাবতীর পালা প্রকাশিত হওয়ার পর থেকে সুধী সমাজ চন্দ্রাবতী সর্ম্পকে নতুন করে জানতে পারে ।

‘মৈমনসিংহ গীতিকা’ বাংলা লোকসাহিত্যের এক ঐতিহাসিক দলিল

মৈমনসিংহ গীতিকা অনুযায়ী, ১৫৫০ সালের দিকে তার জন্ম, আর মৃত্যু ১৬০০ সালে, ৫০ বছর বয়স পর্যন্ত তিনি বেঁচে ছিলেন।[4] চন্দ্রাবতী একাধারে কবি এবং বাংলা সাহিত্যের সার্থক ট্র্যাজিক নায়িকা হিসেবে কিংবদন্তী হয়ে আছেন।

কিশোরগঞ্জ জেলার সদর উপজেলার মাইজকাপন ইউনিয়নের ফুলেশ্বরী নদী তীরের পাতুয়ার/পাটুয়ারী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন চন্দ্রাবতী। চন্দ্রাবতীর পিতা ষোড়শ শতকের প্রখ্যাত মনসামঙ্গল বা পদ্মাপুরাণ রচয়িতা কবি দ্বিজবংশী দাস (ভট্টাচার্য)। চন্দ্রাবতীর মায়ের নাম ছিল সুলোচনা। আচার্য দীনেশ চন্দ্র সেনের মতে, “পিতা ও কন্যা একত্র হইয়া মনসা দেবীর ভাসান (১৫৭৫ খৃঃ) রচনা করিয়াছিলেন”।

কালের সাক্ষী হয়ে আজো টিকে আছে চন্দ্রাবতীর বাড়িটি

নয়ানচাঁদ ঘোষের বর্ণনায় বলা হয়েছে যে, সুন্দরী চন্দ্রাবতীর সাথে তার বাল্যসখা জয়ানন্দের বন্ধুত্ব গভীর প্রেমে পরিণত হয় ।

জয়ানন্দ-চন্দ্রাবতী গভীর অনুরাগের একটি দৃশ্যপট

ডাল যে নোয়াইয়া ধরে জয়ানন্দ সাথী।

তুলিল মালতী ফুল কন্যা চন্দ্রাবতী ।।

গভীর প্রেম থেকে দুই পরিবারের সম্মতিতে জয়ানন্দ ও চন্দ্রাবতীর বিয়ে ঠিক হয়। সে বিয়ের আয়োজনও শুরু হয়ে যায়। কিন্তু হঠাৎ ঘটে যায় আরেক অঘটন।

কপালের দোষ , দোষ নহে বিধাতার।

যে লেখা লেখ্যাছে বিধি কপালে আমার।।

মনির হইল মতিভ্রম হাতীর খসে পা

ঘাটে আসে বিনা ঝরে ডুবে সাধুর না ।।

বিয়ের আগমু্‌হূর্তে আসমানি (মতান্তরে কমলা) নামে এক মুসলমান মেয়ের রূপে মুগ্ধ হয়ে তাঁকেই বিবাহ করে চঞ্চলমতি জয়ানন্দ। দৈবাৎ জয়ানন্দের এমন বদলে যাওয়া আচরণ বিদগ্ধ করে চন্দ্রাবতীকে ।

অনাচার কৈল জামাই অতি দুরাচার ।

যবনী করিয়া বিয়া জাতি কৈল মার ।।

অদৃষ্টের সেই ঘাত প্রতিঘাতে চন্দ্রাবতীর কোমল হৃদয় ভেঙে গেল।[5] নাওয়া-খাওয়া ত্যাগ করে চন্দ্রাবতী যেন সবার অচেনা এক রূপ ধারণ করলো। জগত সংসার থেকে ক্রমেই বিচ্ছিন্ন হতে থাকে চন্দ্রাবতী। নয়ান চাঁদের পালায় চন্দ্রাবতীর দুঃসময়ের কথা বলা হয়েছে এভাবে-

“কি কর লো চন্দ্রাবতী ঘরেতে বসিয়া।”

সখিগণ কয় কথা নিকটে আসিয়া ।।

শিরে হাত দিয়া সবে জুড়ায় কান্দন ।

শুনিয়া হইল চন্দ্রা পাথর যেমন ।।

না কান্দে না হাসে চন্দ্রা নাহি বলে বাণী।

আছিল সুন্দরী কন্যা হইল পাষাণী ।।

মেয়ের এ করুণ অবস্থা থেকে পরিত্রাণের জন্য বংশীদাস একমনে শিবের নাম জপ করতে আর রামায়ণ লিখতে উপদেশ দিলেন চন্দ্রাবতীকে । এসময় চন্দ্রাবতী পিতা দ্বিজ বংশীদাশের নিকট দুটি প্রার্থনা করেন- ফুলেশ্বরী নদীর তীরে মন্দির প্রতিষ্ঠা করা এবং অন্যটি চিরকুমারী থাকার ইচ্ছা। [6]

এই সেই শিব মন্দির, যেখানে বসে চন্দ্রাবতী পূজা করতেন

দ্বিজ বংশীদাস মেয়ের দুটি প্রার্থনাই মঞ্জুর করলেন। সেই সময় খরস্রোতা নদী ফুলেশ্বরীর তীরে স্থাপিত হয় চন্দ্রাবতীর শিবমন্দির। চন্দ্রাবতীর শিব মন্দিরটি অষ্টকোণাকৃতির। উচ্চতা ১১ মিটার (৩২‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌) ইঞ্চি। আটটি কোণার প্রতিটি বাহুর দৈর্ঘ্য ১.৭ মিটার (৫-২‌) ইঞ্চি। নীচের দিকে একটি কক্ষ ও যাবার জন্য একটি দরজা রয়েছে। ভেতরে শিব পূজা অনুষ্ঠিত হয়। নিচের সরলরেখায় নির্মিত অংশটি ২টি ধাপে নির্মিত। নিচের ধাপের চারদিকে অর্ধবৃত্তাকার খিলানের সাহায্যে নির্মিত প্রশস্ত কুলুঙ্গি রয়েছে। নিচের দিকে কার্ণিশ পর্যন্ত উচ্চতা ২.৭০ মিটার। কক্ষের ভেতরে ৭টি জানালা সদৃশ কুলুঙ্গি রয়েছে, যার প্রস্থ ৫২ সেন্টিমিটার এবং দৈর্ঘ্য ৯৯ সে.মি। কিছু কারুকাজও আছে। কক্ষের ব্যাস ২.৩৫ মিটার বা ৭‌-৮ ইঞ্চি। কার্নিশ বরাবর অনুচ্চ ছাদ রয়েছে।[7]

চন্দ্রাবতীর শিব মন্দিরের পাশেই রয়েছে আরেকটি শিব মন্দির

চন্দ্রাবতী কায়মনোবাক্যে শিবপূজা করতেন শিব মন্দিরে। কোনোকিছুকে আশ্রয় করে মানুষ বাঁচতে চায়, বিরহী প্রেমের স্মৃতি ভোলার জন্য চন্দ্রাবতী তাই মনে-প্রাণে আশ্রয় নিয়েছিলেন ধর্ম ও সাহিত্যের কাছে। চন্দ্রাবতী শুরু করেছিলেন ধর্ম-সাহিত্য। হাত দিয়েছিলেন ‘রামায়ণ’ রচনায়। মধ্যযুগে হিন্দু সমাজে নারীর হাতে ধর্মকথা রচনার কথা কেউ ভাবতে পারতো না। সেই সময়ে চন্দ্রাবতীর হাতে এই দুঃসাহসিক, বৈপ্লবিক কাজটির যাত্রা হয়েছিলো। চন্দ্রাবতী রচিত রামায়ণের পাণ্ডুলিপিটি বর্তমানে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারে সংরক্ষিত আছে। অনাদি ভবিষ্যতের কোনো অনুসন্ধিৎসু পাঠক হয়তো সেই প্রাচীন পাণ্ডুলিপিটি ঘেঁটে নবরূপে আবিষ্কার করবে বাংলা সাহিত্যের এই প্রথম নারী কবিকে। দীনেশচন্দ্রের মতে, মাইকেল মধুসূদন দত্ত তার মেঘনাদবধ কাব্যের সীতা-সরমার কথোপকথনের অংশটি ‘চন্দ্রাবতীর রামায়ণ’ থেকে গ্রহণ করেছিলেন। তবে তিনি ‘রামায়ণ’ এর কাজটি শেষ করতে পেরেছিলেন বলে জানা যায়নি। অবশ্য লোককাহিনী ‘মলুয়া’, ‘দস্যু কেনারামের পালা’ ইত্যাদির রচয়িতা রূপে চন্দ্রাবতীর কবিত্ব ইতিহাসের পাতায় লিপিবদ্ধ রয়েছে।

“ঠাকুর বলেন কেনা আর কার্য্য নাই ।

স্নান কইরা আস তুমি মুক্তিমন্ত্র দেই ।।

মিছা মায়া এ সংসার কেউ কার নয় ।

পথিকে পথিকে যেমন পরিচয় ।।

টাকাকড়ি ধনজন সঙ্গে নাহি যাবে ।

একাকী এসেছ তুমি একা যেতে হবে”

             (চন্দ্রাবতী কর্তৃক প্রণীত দস্যু কেনারামের পালা কয়েক ছত্র)

চন্দ্রাবতীর বাসগৃহ

বিরহী প্রেমের স্মৃতিময় জীবন কাটানোর জন্য চন্দ্রাবতী যখন সাহিত্যে আর ধর্ম সাধনায় মগ্ন, তখন জয়ানন্দ অনুতপ্ত হয়ে আবার তাঁর কাছে ফিরে আসেন। কিন্তু ততদিনে জয়ানন্দের জন্য চন্দ্রাবতীর মনে ভালোবাসা নামক যে খরস্রোতা নদীটি ছিলো, তা শুকিয়ে মৃত নদীর রূপ ধারণ করে। অভিমানী চন্দ্রাবতী আর জয়ানন্দের সাথে দেখা করেননি । অতঃপর জয়ানন্দ একটি চিঠি পাঠান চন্দ্রাবতীর নিকট। চন্দ্রাবতীর প্রত্যুত্তর না পেয়ে শিব মন্দিরের সামনে অপেক্ষা করতে থাকেন জয়ানন্দ। চন্দ্রাবতীর এই নিদারুণ উপেক্ষায় ব্যথিত জয়ানন্দ মন্দিরের পাশে ফুটে থাকা সন্ধ্যামালতী ফুল নিয়ে মন্দিরের গায়ে চার লাইনের কবিতা লিখে শেষ বিদায় গ্রহণ করেন।

শৈশবকালের সঙ্গী তুমি যৌবনকালের সাথী ।

অপরাধ ক্ষমা কর তুমি চন্দ্রাবতী ।।

পাপিষ্ঠ জানিয়া মোরে না হইল সম্মত ।

বিদায় মাগি চন্দ্রাবতী জনমের মত ।।

চন্দ্রাবতী তখনও ধ্যানে মগ্ন। অন্যদিকে অভিমানে বাড়ির পাশে ফুলেশ্বরী নদীতে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করেন জয়ানন্দ। ধ্যান ভেঙে যখন চন্দ্রাবতী মন্দিরের বাইরে আসে, জয়ানন্দের লেখা দেখে, মন্দির গা অপবিত্র হয়ে গেছে বলে সে জল আনতে ফুলেশ্বরী নদীতে যায়, তখন সে দেখতে পায় জলে ভেসে রয়েছে তাঁর আজীবনের দোসর। জয়ানন্দের মৃতদেহ দেখে, নিজের আবেগ ধরে রাখতে পারলেন না চন্দ্রাবতী৷ তিনিও অচিরেই প্রেমিকের সাথে পরলোকে চিরমিলনের কামনায় ফুলেশ্বরীর জলে ডুবে প্রাণত্যাগ করেন।

অন্য মতে, জয়ানন্দের মৃত্যুর কিছুদিন পরই শোকাভিভূত চন্দ্রাবতীও দেহত্যাগ করেন। ফলে, রামায়ণে সীতার বনবাস পর্যন্ত লেখার পর আর লেখা হয়নি।

তার স্মৃতিবিজড়িত বাড়ি ও শিব মন্দির দেখার জন্য বহু ভ্রমণপিপাসু আর উৎসুক মানুষ গিয়ে থাকেন। কিন্তু কর্তৃপক্ষ নামেমাত্র প্রত্নতাত্ত্বিক সম্পদ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে তাদের কার্য উদ্ধার করেছে, রক্ষণাবেক্ষণের বিশেষ কোনো ব্যবস্থা চোখে পড়ে না বললেই চলে। রক্ষণাবেক্ষণের এমন অবস্থা চলতে থাকলে অচিরেই হয়তো কালের গর্ভে বিলীন হয়ে যাবে মন্দির ও বাড়িটি। বর্তমানে চন্দ্রাবতীর বাড়িতে দুটি পরিবারের বাস, এক পাশে হিন্দু একটি পরিবার এবং আরেক পাশে মুসলমান একটি পরিবারের বাস। বাড়ির ভেতরের অংশ দেখতে হলে তাদের অনুমতি নিয়ে যেতে হবে।

মধ্যযুগের আট-দশজন নারী চরিত্রের সামনে অসাধারণ মনে হয় চন্দ্রাবতীকে। তিনি ছিলেন আধুনিক, স্বতন্ত্র, বৈপ্লবিক এবং স্রোতের বিপরীতে একজন মানুষ। জয়ানন্দ-চন্দ্রাবতী অনুরাগে যে সুধা পান করেছিলেন, সেই সুধায় আজো আমরা করুণ রসে সিক্ত হই। এই সিক্ততার জন্য তিনি অমরাবতী হয়ে আছেন একবিংশ শতাব্দীতে এবং হয়তো টিকে থাকবেন মহাকালের স্রোতধারায়।

তথ্যসূত্র

[1] অধ্যাপক প্রিন্স রফিক খান (২০০৭), নুরসুন্দা পাড়ের ছবি, ইসলামপুর প্রকাশ, কিশোরগঞ্জ

[2]আবু সাঈদ তুলু , কালি ও কলম, চন্দ্রাবতীর অমর প্রেমগাথা

[3]  আবু সাঈদ তুলু, পূর্বোক্ত

[4] শ্রীদীনেশ চন্দ্র সেন ও রায় বাহাদুর(১৯৯৩) মৈমনসিংহ-গীতিকা, প্রথম খন্ড, দ্বিতীয় সংখ্যা, কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রেস, কলকাতা

[5] বাংলা সাহিত্যের প্রথম মহিলা কবি চন্দ্রাবতীর কথা : যতীন সরকার

[6] বাংলাদেশের লোকজ সংস্কৃতি গ্রন্থমালা, কিশোরগঞ্জ(২০১৪)বাংলা একাডেমি

[7] কিশোরগঞ্জ(২০১৪)পূর্বোক্ত