রবিবার , ১৮ আগস্ট ২০২৪ | ১৫ই আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
  1. অন্যান্য
  2. অপরাধ ও দুর্নীতি
  3. অর্থ ও বাণিজ্য
  4. আইন আদালত
  5. আন্তর্জাতিক
  6. কৃষি
  7. খেলা
  8. চাকরি
  9. ছবিঘর
  10. জাতীয়
  11. তথ্যপ্রযুক্তি
  12. দুর্ঘটনা
  13. ধর্ম
  14. নারী
  15. নির্বাচিত খবর

কৃষিতে নির্ভরশীলতা বেশি হলেও ব্যাংকঋণে পিছিয়ে

Paris
আগস্ট ১৮, ২০২৪ ৯:৩৫ পূর্বাহ্ণ

 

সিল্কসিটি নিউজ ডেস্ক:

গোপালগঞ্জের মুকসুদপুর উপজেলার গোপিনাথপুর গ্রামের কৃষক মাসুদ মুন্সি। চাষাবাদ ও গবাদিপশু ক্রয়ের জন্য গত অর্থবছরের জানুয়ারিতে ২ লাখ টাকার কৃষিঋণের জন্য কৃষি ব্যাংকের মুকসুদপুর শাখায় আবেদন করেন। এক বিঘা কৃষিজমি ও পশু পালনের শেড দেখিয়ে তিনি ওই ঋণ নিতে চেয়েছিলেন। তবে শাখাটি তাকে ৩৫ হাজার টাকার বেশি ঋণ দিতে পারবে না বলে জানিয়ে দেয়।

তখন জাগরণী চক্র ফাউন্ডেশন নামে একটি এনজিও থেকে তিনি সহজেই ২ লাখ টাকা ঋণ পেয়ে যান। তবে তাকে অধিক হারে সুদসহ ঋণ পরিশোধ করতে হবে। এ ব্যাপারে মাসুদ মুন্সি  বলেন, আমার টাকার দরকার ছিল, তাই সুদের বিষয়টি চিন্তা করিনি। তবে মুকসুদপুর কৃষি ব্যংকের শাখা ব্যবস্থাপক দেবাশিষ মণ্ডল দাবি করেছেন, এ রকম কোনো ঘটনা তিনি জানেন না।

খাদ্য উৎপাদন, রপ্তানি আয় বৃদ্ধি ও কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে কৃষি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। বর্তমানে মোট শ্রমজীবী মানুষের ৪৫ শতাংশ সরাসরি কৃষির সঙ্গে জড়িত। শিল্প ও সেবা খাতের প্রবৃদ্ধির ক্ষেত্রেও কৃষির পরোক্ষ অবদান রয়েছে। তার পরও ব্যাংকঋণ পাওয়ার ক্ষেত্রে পিছিয়ে আছে কৃষি খাত।

এভাবে বেশি সুদে এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে কৃষকরা প্রকৃত অর্থে লাভবান হয় কিনা- এমন প্রশ্নের জবাবে বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের সাবেক এমডি আলী হোসেন প্রধানিয়া বলেন, এটি নিয়ে বিতর্ক আছে। তবে মূল চিন্তাভাবনা হলোÑ গরিব লোকদের ওপরে সুদের বোঝা যত কমানো যায়, ততই ভালো। কেন্দ্রীয় ব্যাংকও সেটি চায়। একেবারে না পাওয়ার চেয়ে বেশি সুদে হলেও কৃষকের হাতে ঋণ পৌঁছাক। মূলত যেখানে ব্যাংকগুলো সরাসরি ঋণকার্যক্রম করতে পারছে না, সে জায়গায় এনজিওগুলো ভূমিকা রাখছে।

সূত্রগুলো বলছে, প্রতি বছর কৃষিঋণের লক্ষ্যমাত্রা বাড়ানো হলেও ব্যাংকগুলোর ছলচাতুরির কারণে তার উল্লেখযোগ্য অংশ কৃষকের কাছে পৌঁছায় না। ব্যাংকগুলো অন্য খাতে ঋণ দিয়ে তা কৃষিঋণ বলে চালিয়ে দেয়। আবার বিভিন্ন ফরমালিটিসের কারণে ব্যাংক থেকে ঋণ পাওয়া কৃষকের পক্ষে কঠিন। উপরন্তু নেটওয়ার্ক তৈরি করতে না পারায় বেসরকারি ব্যাংকগুলো তাদের কৃষিঋণের অধিকাংশই এনজিও নির্ভরতায় বিতরণ করে। সরকারি ব্যাংকগুলো সরাসরি বিতরণ করলেও তাদের বিরুদ্ধে নানারকম হয়রানি, ভুয়া ঋণ সৃষ্টি ও ঘুষ নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। ফলে এনজিও, মহাজন, জমির মালিক ও আত্মীয়স্বজনের কাছ থেকেই ঋণ নিতে বাধ্য হন গ্রামের প্রান্তিক কৃষকরা। বর্তমানে ব্যাংকের চেয়ে এনজিরও সুদ দ্বিগুণেরও বেশি।

এ বিষয়ে ফরিদপুর সদর উপজেলার অম্বিকাপুর ইউনিয়নের গোবিন্দপুর এলাকার কৃষক বক্তার হোসেন খান আমাদের সময়কে বলেন, সাধারণ কৃষকদের অনেক ব্যাংকই ঋণ দিতে চায় না। ফলে তারা এনজিওসহ বিকল্প উৎস থেকে ঋণ করতে বাধ্য হয়। অথচ কৃষকরা ঋণ নিয়ে সময়মতো ফেরত দেয়। তার পরও ব্যাংকগুলো তেলে মাথায় তেল দেয়। বড় বড় ব্যবসায়ীদের না চাইতেই বড় অঙ্কোর ঋণ তুলে দেওয়া হয়।

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের (বিআইবিএম) সাবেক মহাপরিচালক ড. তৌফিক আহমেদ চৌধুরী বলেন, বিভিন্ন কারণে ব্যাংকগুলো থেকে কৃষকের ঋণ পাওয়া অনেক কঠিন। অন্যদিকে এনজিও থেকে ঋণ পাওয়া যেমন সহজ, তেমনই ঋণটা নিয়ে কৃষক যথাযথ কাজেই ব্যবহার করে। কারণ যখন যে ফসল, সেই ফসলের জন্যই ঋণটি দেয় এনজিওগুলো। এ জন্য কৃষকরা এনজিওদের থেকে ঋণ নিতেই বেশি আগ্রহী। কারণ এখানে ব্যাংকের মতো বিভিন্ন ফরমালিটিস থাকে না।

ব্যাংকের ঋণ পরিস্থিতি: গত অর্থবছরে ৩৫ হাজার কোটি টাকা কৃষিঋণ বিতরণের লক্ষ্যমাত্রা দেওয়া হয়েছিল। ব্যাংকগুলোর নিট ঋণ ও অগ্রিমের আড়াই শতাংশ হিসাব করে এ লক্ষ্যমাত্রা দেওয়া হয়। এর বিপরীতে মে পর্যন্ত ১১ মাসে ব্যাংকগুলো নিজস্ব নেটওয়ার্ক ও এনজিওর মাধ্যমে প্রায় ৩৩ হাজার ২৯৬ কোটি টাকার কৃষিঋণ বিতরণ করেছে, যা লক্ষ্যমাত্রার ৯৫ দশমিক ১৩ শতাংশ। যদিও বাস্তবে এই ঋণের বড় অংশই কৃষকরা পাননি। এ সময়ে অন্তত ১২ ব্যাংক ঋণ বিতরণে তাদের লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় অনেক পিছিয়ে ছিল। এর মধ্যে ১১টিই বেসরকারি ব্যাংক। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের এক পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদনে বলা হয়, মানি মার্কেট শেয়ারের ৭৯ শতাংশ বেসরকারি ও বিদেশি ব্যাংকগুলোর হলেও বেসরকারি ব্যাংকগুলোর কৃষি খাতে ঋণের পরিমাণ মাত্র ২ শতাংশ। আর বিদেশি ব্যাংকগুলোর পরিমাণ মাত্র ১ শতাংশ।

বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. মেজবাউল হক বলেন, অগ্রাধিকার খাত বিবেচনায় প্রতি বছর নীতিমালা জারির মাধ্যমে ব্যাংকগুলোর জন্য কৃষিঋণ বিতরণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ এবং সে অনুযায়ী বিতরণের অগ্রগতি তদারকি করা হয়। কোনো ব্যাংক লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ব্যর্থ হলে অনর্জিত অংশ জরিমানা হিসেবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিবিএডিসিএফ বাধ্যতামূলক জমা করার নির্দেশনা রয়েছে।

সরাসরি ঋণ দিতে অনীহা ব্যাংকের: আগে ব্যাংকগুলোর জন্য এমএফআই লিঙ্কেজে ৭০ শতাংশ পর্যন্ত কৃষিঋণ বিতরণের সুযোগ ছিল। তবে গত অর্থবছরে সেটি কমিয়ে ৫০ শতাংশ করা হয়। সূত্রগুলো বলছে, নীতিমালায় সুযোগ রাখায় নিজস্ব নেটওয়ার্ক থাকার পরও অনেক ব্যাংক কৃষকদের সরাসরি ঋণ বিতরণে অনীহা দেখায়। কারণ ব্যাংক সরাসরি কৃষককে ঋণ দিলে যে সুদ পাবে, একই সুদ পাবে এমএফআই প্রতিষ্ঠানকে তহবিল দিলেও। এর মাধ্যমে সহজেই কৃষিঋণের টার্গেট পূরণ করতে সক্ষম হচ্ছে অনেক ব্যাংক।

এবিবির সাবেক চেয়ারম্যান ও মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের এমডি সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, কৃষকদের সরাসরি ঋণ দিতে ব্যাংকগুলোর অনীহা রয়েছে, বিষয়টি আসলে তা নয়। বরং আমাদের নেটওয়ার্ক কম থাকার কারণে এমএফআইয়ের মাধ্যমে কৃষিঋণ বিতরণের সুযোগ রাখা হয়েছে। তা ছাড়া খরচ বিবেচনায় গ্রামে অবকাঠামো তৈরি ও জনবল নিয়োগ দিয়ে সরাসরি কৃষকের হাতে ঋণ দেওয়াও অনেক ব্যাংকের পক্ষে কঠিন।

সরকারি ব্যাংক থেকে হয়রানি ও ঘুষ ছাড়া মিলে না ঋণ: চুয়াডাঙ্গা জেলার আলমডাঙ্গা থানার নাগদা ইউনিয়নের জহিরুলনগরের কৃষক নজরুল ইসলাম। গবাদিপশু কেনা, বন্ধকী জমি ছাড়ানো ও ফসল চাষের জন্য চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের ঘোলডাড়ী শাখায় ১০ লাখ টাকার কৃষিঋণের জন্য আবেদন করেন। সেই ঋণের জন্য শাখা ব্যবস্থাপক ঘুষ দাবি করলে তিনি বাংলাদেশ ব্যাংকে অভিযোগ করেন। পরে বাংলাদেশ ব্যাংকের হস্তক্ষেপে এক মাসের মধ্যেই চার লাখ টাকার ঋণ পান।

নজরুল ইসলাম বলেন, শাখা ব্যবস্থাপক ঋণটির জন্য খরচপাতি চান। পরে স্থানীয় একজনের সহায়তায় আমি বাংলাদেশ ব্যাংকে অভিযোগ করে ঋণ পেয়েছি। গত ডিসেম্বরে চাঁদপুরের মতলব দক্ষিণ উপজেলার নবকলস গ্রামের কৃষক ইসমাঈল হোসেন সোনালী ব্যাংকের মতলবগঞ্জ শাখায় ৫০ হাজার টাকার কৃষিঋণের আবেদন করলে তার কাছে ১৩ হাজার টাকা ঘুষ চাওয়া হয়। ঘুষ না দেওয়ায় তাকে আর ঋণটি দেওয়া হয়নি বলে অভিযোগ করেন।

পুনঃঅর্থায়ন তহবিল ঋণ বিতরণেও গতি কম: কৃষকদের স্বল্প সুদে ঋণ দিতে বর্তমানে তিনটি তহবিল চালু রয়েছে। এর মধ্যে গম ও ভুট্টা উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে ২০২২ সালের ২৫ আগস্ট এক হাজার কোটি টাকার তহবিল গঠন করা হয়। নির্দিষ্ট মেয়াদে গত জুন পর্যন্ত বিতরণ করা হয় ৩৪৩ কোটি টাকা, যা মোট তহবিলের মাত্র ৩৪ শতাংশ। অন্যদিকে দেশের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকল্পে ২০২২ সালের ১৭ নভেম্বর কৃষি খাতের জন্য পাঁচ হাজার কোটি টাকার তহবিল গঠন করা হয়। গত জুন পর্যন্ত নির্দিষ্ট মেয়াদের মধ্যে তহবিলটির ৮৭ শতাংশ ঋণ বিতরণ সম্ভব হয়েছে। সম্প্রতি এ দুটি তহবিলের মেয়াদ আরও এক বছর বাড়ানো হয়েছে। এ ছাড়া সরকারের সুদ ভর্তুকির আওতায় আমদানি বিকল্প ফসল চাষে গত অর্থবছরে ২২৮ কোটি টাকা বিতরণ হয়েছে, যা আগের অর্থবছরের চেয়ে মাত্র ২১ কোটি টাকা বেশি।

প্রান্তিক কৃষকদের ভরসা এনজিও: সরকারি প্রতিষ্ঠান বিবিএসের অ্যাগ্রিকালচার অ্যান্ড রুরাল স্ট্যাটিটিক্স ২০১৮ শীর্ষক প্রতিবেদন বলছে, ব্যাংক থেকে মাত্র ২৬ শতাংশ কৃষক ঋণ পাওয়ায় এনজিওর দ্বারস্থ হন ৬৩ শতাংশ কৃষক। এর বাইরে মহাজন থেকে ৩ দশমিক ৬৭ শতাংশ এবং আত্মীয়স্বজন ও অন্যান্য উৎস থেকে ৭ শতাংশ কৃষক ঋণ নিতে বাধ্য হন। দেশের ক্ষুদ্র ঋণ প্রতিষ্ঠান ও এনজিও থেকে কৃষকরা যে বেশি ঋণ নিচ্ছেন, তার পরিসংখ্যান উঠে এসেছে বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যেও। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, গত এপ্রিল মাসে গ্রামীণ ব্যাংক ও শীর্ষ ১০ এনজিও ১২ হাজার ৫৮২ কোটি টাকার ক্ষুদ্র ঋণ বিতরণ করেছে। একই সময়ে প্রতিষ্ঠানগুলো আদায় করেছে ১৫ হাজার ৩০ কোটি টাকা। ফলে জুন শেষে এসব প্রতিষ্ঠানের ঋণের স্থিতি দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ১৭ হাজার ৩২৬ কোটি টাকা।

কৃষিঋণে খেলাপিও কম: কৃষকদের মধ্যেই ঋণ ফেরত দেওয়ার প্রবণতা সবচেয়ে বেশি এবং তাদের খেলাপি হওয়ার হারও কম। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছেÑ গত মে পর্যন্ত ১১ মাসে কৃষকরা ফেরত দিয়েছেন ৩২ হাজার ৩৭৫ কোটি টাকা। আর গত মে শেষে এ খাতে খেলাপির পরিমাণ ছিল ৪ হাজার ১৫৯ কোটি টাকা, যা এ খাতে থাকা মোট ঋণস্থিতির মাত্র ৭ দশমিক ৩৮ শতাংশ। সেখানে গত মার্চ পর্যন্ত হিসাবে সার্বিক খাতে খেলাপির হার ছিল ১১ শতাংশের বেশি।

 

 

সর্বশেষ - অর্থ ও বাণিজ্য