গোদাগাড়ী মাদকের অভয়ারণ্য, ওসির বিরুদ্ধে ব্যবসায়ীদের মদদ দেয়ার অভিযোগ

নিজস্ব প্রতিবেদক:

রাজশাহীর গোদাগাড়ী থেকে গত ৯ অক্টোবর প্রায় ৫ কোটি টাকা মূল্যের হেরোইনসহ এক পাচারকারীকে আটক করে র‌্যাব। উপজেলা সারেংপুর নতুনপাড়া পদ্মার পাড় এলাকায় অভিযান চালিয়ে র‌্যাব-৫ সদস্যরা সাজেমান (৩৭) নামের ওই মাদক ব্যবসায়ীকে আটক করে। সে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার সদর থানার হাকিমপুর গ্রামের আলাউদ্দিনের ছেলে। সাজেমান একাধিক মাদক মামলার গ্রেপ্তারি পরোয়ানাভুক্ত আসামি। এ নিয়ে সোম্প্রতিক সময়ে কেবল র‌্যাবই উদ্ধার প্রায় সাত কোটি টাকা মূল্যের হেরোইন উদ্ধার করে। তবে কোটি কোটি টাকা মূল্যের এসব হেরোইনের মুল মালিকরা এখনো অধরাই থাকছে বলে একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে। আবার বিভিন্ন আইনশৃ্খংলা বাহিনী সম্প্রতি হেরোইনের বড় বড় চালান আটক করলেও সেখানে পুলিশের ভূমিকা বলা যায় একেবারেই নিস্ক্রিয়।

এরই মধ্যে গোদাগাড়ী থানার ওসির বিরুদ্ধে সরাসরি মাদক সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ তুলেছেন স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা। এ নিয়ে গত রবিবার জেলা আইনশৃঙ্খলা কমিটির সভায় ওসি হিপজুর আলম মুন্সির বিরুদ্ধে মাদক ব্যবসায়ীদের সঙ্গে যোগসাজস এবং তাঁর মদদে মাদক ব্যবসার অভিযোগ তোলা হয়েছে। রাজশাহী জেলা আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক ও গোদাগাড়ী পৌর মেয়র মনিরুল ইসলাম বাবু এ অভিযোগ তুলেন।

আইনশৃঙ্খরা বাহিনীর একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে, হেরোইন সিন্ডিকিটের মূল হোতারা কখনো সরাসরি হেরোইন পাচারের সঙ্গে যুক্ত হয় না। তাদের হয়ে বহনকারী (স্থানীয় ভাসায় যাদের পাইট বলা হয়) বা মধ্যসত্বভোগী হিসেবে হেরোইন পাচারকাজের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়ে শ্রমিক শ্রেণির কিছু লোকজন। ভারত থেকে আনা পর্যন্ত শুরু করে বাংলাদেশের অভ্যান্তরের নির্দিষ্ট গন্তব্যস্থলে পৌঁছে দিতে এসব শ্রমিকরা কাজ করে।

 

হেরোইনের টাকা লেনদেন করে মূল সিন্ডিকেটের সদস্যরা। তারা আড়ালে থেকে হেরোইন মতো এই মরণনেশার ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত থাকে। আর গোদাগাড়ী থানা পুলিশ এই সিন্ডিকের সঙ্গেই যুক্ত হেয় তাদের নানাভাবে সহযোগিতা করে যাচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন জনপ্রতিনিধিরা।

যার কারণে রাজশাহীর গোদাগাড়ী সীমান্ত দিয়ে যুগ যুগ ধরেই চলে আসছে সর্বনাশা হেরোইন ব্যবসা। আর মাঝখানে গোদাগাড়ী থানা পুলিশ লুটছে ফায়দা। এই মাদককে কেন্দ্র করেই গোদাগাড়ী থানার ওসি হিফজুর আলম মুন্সিসহ কয়েকজন এসআই বছরে অন্তত কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন বলেও নিশ্চিত করেছেন একাধিক সূত্র।

একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে, গত ৯ অক্টোবর আটকৃকত হেরোইনের চালানের প্রকৃত মালিক সাজেমান নয়। একটি বড় মাদক সিন্ডিকেটের হয়ে হেরোইনগুলো পাচার করছিল সাজেমান। ওই সিন্ডিকেটের হাতে হেরোইনগুলো পৌঁছে দেওয়ায় ছিল তার কাজ। তবে তার আগেই র‌্যাবের জালে ধরা পড়ে সাজেমান।

  • এর আগে গত ২৮ সেপ্টেম্বর রাতে গোদাগাড়ী উপজেলার উজানপাড়া এলাকায় অভিযান চালিয়ে তিন কেজি ২৫০ গ্রাম হেরোইন উদ্ধার করে র‌্যাব। এসময় রবিউল ইসলাম (২৫) নামের এক ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করা হয়। তার বাড়ি উপজেলার মাদারপুর এলাকায়। সে ওই এলাকার রফিকুল ইসলামের ছেলে। ওই হেরোইনটিও রবিউল ইসলামের ছিল বলে স্থানীয় কয়েকটি সূত্র নিশ্চিত করেছে।

রাত সাড়ে নয়টার দিকে উপজেলার উজানপাড়া অভিযান চালিয়ে তিন কেজি ২৫০ গ্রাম হেরোইন উদ্ধার করা হয়। এসময় রবিউল ইসলাম (২৫) নামের এক ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করা হয়। তার বাড়ি উপজেলার মাদারপুর এলাকায়। সে ওই এলাকার রফিকুল ইসলামের ছেলে।

সূত্র মতে, বাংলাদেশের মধ্যে গোদাগাড়ীই হলো হেরোইন পাচারের অন্যতম প্রধান রুট। এই রুটকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছে বড় বড় মাদক সিন্ডিকেট। যাদের কেউ কেউ গোদাগাড়ীতে থেকেই নিয়ন্ত্রণ করে এ ব্যবসা। আবার কেউ ঢাকায় বসে, কেউ নারায়নগঞ্জে বসে, কেউ চট্টগ্রামে বসে নিয়ন্ত্রণ করে কোটি কোটি টাকা মূল্যের হেরোইন পাচারের ব্যবসা। আর তাদের হয়ে কাজ করে মধ্যসত্বভোগী কিছু দিনমজুর বা শ্রমিক শ্রেণির সাধারণ মানুষ। হেরোইনের পরিমাণ অনুযায়ী বহনকারীদের কমিশন দেওয়া হয়। তবে ছোট ছোট ব্যবসায়ীরা নিজেরাই ভারতীয় সীমান্ত থেকে হেরোইন পাচার করেও নিয়ে আসে। তবে বড় ব্যবসায়ীদের অন্যতম ভরসা হলো বহনকারীরা। আর এদের ব্যবহার করেই গোদাগাড়ী সীমান্তকেন্দ্রীক গড়ে উঠেছে বড় বড় হেরোইন সিন্ডিকেট।

  • আবার কেউ কেউ শুধু হেরোইন ব্যবসা করেও এখন কোটিপতি বনে গেছে। রাতারাতি আঙ্গুলফুলে কলাগাছ বনে যাওয়া এসব কোটিপতিদের নিয়ে এর আগে কালের কণ্ঠে একটি অনুসন্ধানী খবরও প্রকাশ হয়েছে। এরপর চিহ্নিত কয়েকজ হেরোইন ব্যবসায়ীকে আটকও করে পুলিশ। যাদের মধ্যে একজন ছিল সোহেল রানা। যদিও সোহেলের নিকট থেকে মোটা অংকের টাকা নিয়ে তাকে কোনো মাদক মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়নি।

নাশকতার অভিযোগে দায়েরকৃত মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয় গোদাগাড়ীর মাটিকাটা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সদস্য সোহেল রানাকে। অভিযানের মুখে অনেকেই ওইসময় গা ঢাকা দেয়। কিন্তু এখন গোদাগাড়ী থানার ওসি হিফজুর আলম মুন্সিকে ম্যানেজ করে আবারো সেই চিহ্নিত হেরোইন ব্যবসায়ীরা এলাকায় ফিরে এসেছে। তারা এখন দাপটের সঙ্গেই হেরোইন ব্যবসা করে যাচ্ছে বলেও দাবি করেছেন গোদাগাড়ীর জনপ্রতিনিধিরা।

মেয়র মনিরুল ইসলাম বাবু আরও অভিযোগ করেন, ওসির নেতৃত্বে পুলিশ বাড়ি বাড়ি গিয়ে মাদকের নামে অভিযান চালায়। কিন্তু যারা মাদক ব্যবসায়ী তাদের আটক করা হয় না। আটক করা হয় সাধারণ মানুষকে। মাদক ব্যবসায়ীদের নিকট থেকে নিয়মিত মাসোহারা আদায় করে সাধারণ মানুষের পকেটে বা ঘরে হেরোইন রেখে পুলিশ তাদের ফাঁসিয়ে দেয়। কাজেই এই ওসির বিরুদ্ধে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হোক।

  • একটি গোয়েন্দা সংস্থার দেওয়া তথ্য মতে, গোদাগাড়ী থানার ওসি এই সমস্ত মাদক ব্যবসায়ীর নিকট থেকেই অন্তত কোটি টাকা টাকা আদায় করেছে গত প্রায় এক বছরে। তিনি নামে-বেনামে টাকাগুলো রেখেছেন বিভিন্ন ব্যাংকে।  আবার সম্পদও গড়েছেন বিভিন্ন স্থানে। এ নিয়ে পুলিশের মধ্যেও রয়েছে চরম ক্ষোভ।

ওই সূত্রগুলো আরও জানায়, গোদাগাড়ীর চিহ্নিত মাদক ব্যবসায়ী সেতাবুর রহমান বাবু গত দুই মাস আগেও পুলিশের অভিযানের মুখে পলাতক ছিল। এখন সে ওসির সঙ্গে থানায় বসে বিভিন্ন বিচার-শালিস করে থাকেন। এমনকি মাদকের টাকার ভাগ-বাটোয়ারা নিয়ে ঘটে যাওয়া বিরোধ-দ্বন্দ্ব, সংঘর্ষের ঘটনায় বাবুর নেতৃত্বে থানায় বসে মীমাংসা করে দেয় পুলিশ।

কয়েকটি সূত্র জানায়, ওসির বাইরেও গোদাগাড়ী থানার আরো যেসব কর্মকর্তা মাদক সিন্ডিকেটের সদস্যদের সঙ্গে আঁতাত করেন তাঁদের মধ্যে রয়েছেন এসআই আকবর আলী, আব্দুর রাজ্জাক, এএসাই আব্দু জাব্বারসহ আরো কয়েকজন সদস্য। এদের অনেকেই এখন টাকার কুমির শুধু মাদক সিন্ডিকেটের সহযোগিতায়।

  • এসব নিয়ে জানতে চাইলে ওসি হিফজুর আলম মুন্সি বলেন, ‘গোদাগাড়ীর চরাঞ্চলটা এখনো মাদক ব্যবসায়ীদের অভায়রন্য। আমরা সেখানে বড় অভিযানের প্রস্তুতি নিচ্ছি। কিন্তু যারা চিহ্নিত মাদক ব্যবসায়ী তারা এখন পলাতক। তাদের ধরতে নিয়মিত অভিযান হচ্ছে। এসব মাদক ব্যবসায়ীরাই গোদাগাড়ীর মাদক নিয়ন্ত্রণ করে থাকে।’

এক প্রশ্নের জবাবে ওসি আরও বলেন, মাদক ব্যবসায়ী বাবু, ভোদলসহ অন্যরাও পলাতক। তারা থানায় আসার কোনো সুযোগ নাই।’

আরেক প্রশ্নের জবাবে ওসি বলেন, ‘কোনো মাদক ব্যবসায়ীর সঙ্গে আতাত করে অর্থ আদায়ের বিষয়টি সঠিক নয়। এগুলো যারা বলছে, তারা হয়তো ভুল তথ্য দিচ্ছে। মেয়র মনিরুল ইসলাম বাবুর সঙ্গে স্থানীয় এমপির দূরুত্ব সৃষ্টি হয়েছে। এ কারণে তিনি এখন পুলিশকেও প্রতিপক্ষ মনে করছেন।’

এদিকে জানতে চাইলে জেলা পুলিশ সুপার মোয়াজ্জেম হোসেন ভুইঞা বলেন, ওসির বিরুদ্ধে মাদক ব্যবসায়ীদের সঙ্গে যোগসাজসের অভিযোগ উঠেছে। এগুলো নির্দিষ্টভাবে অভিযোগ পেলে তদন্ত করা হবে।’

স/আর