গুপ্তচর উৎপাদনের কারখানা ইরান!

সিল্কসিটিনিউজ ডেস্ক:

প্রায় দুই সপ্তাহ আগে ইরানের নিরাপত্তা বাহিনী মেলবোর্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক মেইমানাত হোসেইনি চাভোশিকে গ্রেপ্তার করে। ইরানীয়- অস্ট্রেলীয় এই শিক্ষাবিদকে গ্রেপ্তারের ঘটনা অনেককে বিস্মিত করেছে। নিরাপত্তা বাহিনী চাভোশিকে গ্রেপ্তার করেই ক্ষান্ত হয়নি, তারা তাঁর গবেষণাকর্মের সহযোগী মোহাম্মদ জালাল আব্বাসী শাভাজিকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ডেকে পাঠিয়েছে। শাভাজি তেহরান বিশ্ববিদ্যালয়ের জনসংখ্যাতত্ত্ব বিষয়ের অধ্যাপক এবং ইরানের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব পপুলেশন রিসার্চের পরিচালক। চাভোশি এবং শাভাজির বিরুদ্ধে গুপ্তচরবৃত্তি এবং ইরানি প্রতিষ্ঠানগুলোতে অনুপ্রবেশের অভিযোগ আনা হয়েছে। ইরানের গণমাধ্যমের খবর, এই দুজন গবেষক ইরানের জনসংখ্যার সংকটকে আড়াল করার জন্য দেশটির জন্মহার নিয়ে মিথ্যা পরিসংখ্যান দিয়েছেন।

২০১২ সালে ইরানের ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি তাঁর এক বক্তৃতায় দেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধির আহ্বান জানানোর পর ইরানে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি একটি স্পর্শকাতর বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। খামেনি তাঁর ওই বক্তৃতায় ইরানে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় কয়েক দশক ধরে চলা জন্মনিয়ন্ত্রণ নীতিকে ‘ভুল’ বলে বর্ণনা করেন। তিনি ইরানের জনসংখ্যা ৮ কোটি ১০ লাখ থেকে ১৫-২০ কোটিতে উন্নীত করার আহ্বান জানান। চাভোশি এবং শাভাজির যৌথভাবে লেখা দ্য ফার্টিলিটি ট্রানজিশন ইন ইরান বইটি ২০১০ সালে ইরানের সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের ইন্টারন্যাশনাল বুক অব দ্য ইয়ার পুরস্কারে ভূষিত হয়। এর পরের বছরগুলোতে তাঁরা যে সম্মান পেয়ে আসছিলেন, তাঁদের গ্রেপ্তারের ঘটনায় তাতে যেন ছন্দপতন হলো। জন্মহার ব্যবস্থাপনা এবং ইরানের জনসংখ্যা দ্বিগুণ করার সরকারি সিদ্ধান্তের সঙ্গে তাঁদের মতামত ও সুপারিশগুলোর মধ্যে অসংগতির কারণেই এ ঘটনা ঘটেছে।

ইম্পিরিয়াল কলেজ, লন্ডনের পরিবেশবিজ্ঞানী এবং ইরানের পরিবেশ অধিদপ্তরের সাবেক উপপ্রধান কাভেহ মাদানি গত এপ্রিল মাসে ইরান ত্যাগ করতে বাধ্য হন। তাঁকে অনুপ্রবেশকারী বা গুপ্তচর সন্দেহে আটক করা হতে পারে—এ আশঙ্কায় তিনি ইরান ছেড়ে যান। মাদানি আমাকে বলেছেন, ইরানের গোয়েন্দারা বিদেশি বিশেষজ্ঞ ও গবেষকদের ব্যাপারে খুব স্পর্শকাতর, কারণ তাঁরা দেশের নীতিনির্ধারকদের খুব কাছাকাছি থাকেন এবং তাঁদের আস্থা অর্জন করেন। তিনি বলেন, এটা খুবই গুরুতর একটি সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে, বিশেষ করে যখন বিদেশি গবেষকদের মতামত এবং তাঁদের গবেষণার ফল ইরানের রাষ্ট্রীয় নীতি ও আদর্শের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হয়। ইরানের রক্ষণশীল নিরাপত্তা বাহিনী ও গোয়েন্দারা ভয় পায় যে বিদেশি বিশেষজ্ঞদের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে ইরানি বিশেষজ্ঞরা বড় ধরনের সংস্কারের জন্য দেশের নীতিনির্ধারকদের প্রভাবিত করার চেষ্টা করতে পারেন।

তবে সব সময়ই যে রাষ্ট্রের সঙ্গে মতাদর্শগত পার্থক্যের কারণে বিভিন্ন ব্যক্তিকে গুপ্তচর আখ্যা দেওয়া হচ্ছে, তা নয়। নিজেদের ব্যর্থতা ঢাকার জন্য তারা শিক্ষাবিদ, গবেষকসহ বিভিন্ন ব্যক্তিকে ‘গুপ্তচর’ আখ্যা দিচ্ছে। তারা এমন সব ব্যক্তিকেও ‘গুপ্তচর’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছে, যাঁরা কিনা তেহরানের পক্ষে গুপ্তচরবৃত্তি করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন।

চলতি বছরের গোড়ার দিকে ইরানের পরমাণু অস্ত্রের বিপুল পরিমাণ তথ্য চুরি হয়। ইসরায়েলের দাবি, তাদের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের এজেন্টরা এসব তথ্য চুরি করেছে। এ ঘটনাকে ইরানের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর ব্যর্থতা হিসেবে দেখা হচ্ছে। এরপর থেকেই ইরানে ‘গুপ্তচর’ আটকের ঘটনা বেড়ে যায়। বলা যেতে পারে, ইরান এখন গুপ্তচর উৎপাদনের কারখানায় পরিণত হয়েছে।

পরমাণু অস্ত্রের তথ্য চুরি হওয়ার পর ইরানীয়-কানাডীয় অধ্যাপক কাভাস সাঈদ ইমামিকে ‘গুপ্তচর’ আখ্যা দিয়ে আটক করে ইরানের নিরাপত্তা বাহিনী। তিনি ইমাম সাদিক ইউনিভার্সিটির রাজনৈতিক সমাজবিজ্ঞান বিষয়ের অধ্যাপক ছিলেন। গ্রেপ্তারের কিছুদিন পরই কারাগারে তিনি রহস্যজনকভাবে মারা যান। পরে তেহরানের প্রসিকিউটর জেনারেল জানান, নিজের অপরাধ স্বীকার করার পর সাঈদ ইমামি আত্মহত্যা করেছেন। তাঁর এ কথার সত্যতা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। এর আগে আহমাদ রেজা জালালি নামে একজন ইরানীয়-সুইডিশ চিকিৎসককে ইসরায়েলের পক্ষে গুপ্তচরবৃত্তি করার অপরাধে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। তাঁর স্ত্রী দাবি করেন, ইরানের গোয়েন্দা বাহিনীর হয়ে গুপ্তচরবৃত্তি করতে অস্বীকার করায় তাঁকে এই শাস্তি দেওয়া হয়েছে। জালালির মতো আরও অনেকে এ মিথ্যা অপবাদের শিকার হয়েছেন। ইরানের রাষ্ট্রীয় নীতিতে মৌলিক পরিবর্তন না এলে এ রকম ঘটনা ঘটতেই থাকবে।