গহীন গাঙের বাঁকে ।। যুবায়ের হাসান

অফিসের একটা কাজে বেশ ক’মাস ধরে ঘুরছি ঢাকার আশপাশের এলাকায় । বলা যায়, ঢাকাকে মাঝখানে রেখে প্রায় চক্রাকারে এই ঘোরা, সংগে আছে ছোট একটা দল । ঘুরতে ঘুরতে মানিকগঞ্জ, গাজীপুর, নরসিংদী, নারায়ণগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জ জেলার শ’খানেক ইউনিয়ন দেখা হয়ে গেছে । জানা হয়েছে এ বাংলার হৃদমাঝার আর এর গ্রামীণ জীবনকে । দেখেছি চোখজুড়ানো নানান কিসিমের সবুজ, হলুদকে । ছোট, মাঝারি কত না নদ-নদীও এ সুযোগে ছুঁয়ে ফেললাম ! মাস খানেক আগে ছোট্ট ‘ইছামতী’র সংগে পরিচয় হলো । এক জায়গায় বাঁশের নড়বড়ে সেতু যার ও পাশের মেঠোপথ দূর গ্রামের বুকে হারিয়েছে । চেয়ে থাকতে থাকতে কেনো যে আনমনা হয়ে পড়ি, বুঝি না । বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যাও পার হলাম বেশ ক’বার । বিক্রমপুরের একেবারে পূব মাথায় আজ পেলাম ‘সুরচনা’কে । মেঘনা থেকে বেরিয়ে কিছুটা ফিতের মতো ঘোরাঘুরি করে সে আবার মেঘনাতেই হারিয়েছে ।

সন্ধ্যার দিকে ফেরার পথে নদীপথ আর বড় বড় জলাশয়ে ঘোরার গল্প উঠল । একজন জানাল, ”স্যার, আপনি যদি ঠিকঠাক মনভরে জলপথে ঘুরতে চান, তো হাওরে যান । কী যে এর বিশাল আকার, কী যে এর খোলতাই চেহারা–না দেখলে, ঠিক বোঝানো যাবে না ! শুনেন স্যার, একবার এই অফিসেরই কাজে মালামাল নিয়ে ট্রলারে উঠেছি । ঘাটের নাম সুনামগঞ্জ । যাব তাহিরপুর উপজেলা সদরে । এর সংগে রাস্তার কোনো যোগাযোগ নেই, একেবারে বিচ্ছিন্ন একটা জনপদ । তো, রাত আটটায় রওনা দিলাম, রাতেই সুরমা নদী ছাড়িয়ে হাওর এলাকায় এসে পড়লাম । ভোরে চোখ মেলে দেখি, আদিগন্ত পানি আর পানি, কূলও নেই, কিনারও নেই । ভরা বরষার পানি চারদিকে থইথই করছে, মাঝেমধ্যে ঢেউ এসে সশব্দে আছড়ে পড়ছে ট্রলারের গায়ে।

নতুন পানির এই নাচানাচি দেখে ভয়ে বুক ঠাণ্ডা হয়ে আসছে । আশ্চর্যের কথা, ডাঙার এই সাগরের মাঝে কোথাও কোথাও পানিফুঁড়ে মাথা বার করে আছে হিজল আর করচের মতো গাছ । দু-একটা গাছের মাথায় বাঁধা ছোট ছোট কাঠের ঝুপড়ি । বাস্তবে এগুলো এক একটা দোকান, খাওয়ার হোটেলও । ভাবা যায়, এরই নিচে বসে অর্ডার দিয়ে খেলাম সকাল আর দুপুরের খাবার ! কী স্বাদ সে সব খাবারের–জীবনে এমন অভিজ্ঞতাও হবে, আগে কখনো ভাবিনি । এরই মাঝে চলতে থাকল আমাদের ঘোরাঘুরি । শেষপর্যন্ত সন্ধ্যা নাগাদ শেষ হলো এই আশ্চর্য ভ্রমণ । স্যার, মিস করবেন না, নদী, বিল-ঝিল, সাগর তো অনেক দেখেছেন, এবার একবার কষ্ট করে এই হাওর-বাওর দেখে আসুন আর দেখলে বলবেন, এর কোনো তুলনাই হয় না ।”

ফিরতি পথে সন্ধ্যার আলো আঁধারিতে অদেখা, অচেনা সব হাওর ঘুরতে থাকি মনে মনে । .. গহীন গাঙের পানি–কালো সবুজে মাখা তার অদ্ভুতুড়ে রং ! পানির গভীরতা আঁচ করা বেশ কঠিন । আষাঢ়ের কালো মেঘ আকাশে থমথম করছে । ঝড়ের পূর্বাভাষ বাতাসের গায়ে এরই মধ্যে লেখা হয়ে গেছে । ছলাৎ ছলাৎ শব্দ তুলে নৌকার গায়ে বড় বড় ঢেউয়ের ধাক্কা চলছে । কেন জানি হঠাৎ গা শিরশির করে ওঠে । একটা অজানা আশংকা মনে কাঁপুনি জাগায় । একটা গানের কথা কি কোথাও থেকে ভেসে আসছে, ”নিথুয়া পাথারে নেমেছি বন্ধুরে, ধরো বন্ধু আমার কেহ নাই .. ”?

এই অকূল পাথারে আবার একটা তন্দ্রার মতো ভাব আসে । ঘোরের মাঝেই অস্ফুট গলায় বলে উঠি, ”ও মাঝি, তুমি আমারে কই ভাসাইয়া নিয়া যাইবা?”

লেখক: লেখক ও গদ্যকার