গরু মাদক অস্ত্রের দেনা পরিশোধে রাজশাহীর সীমান্ত দিয়ে পাচার হচ্ছে স্বর্ণের বার

নিজস্ব প্রতিবেদক:

গত বছরের ১১ ডিসেম্বর রাজশাহীর গোদাগাড়ীর মহিষালবাড়ি থেকে ১৫টি স্বর্ণের বারসহ এক চোরাকারবারীকে আটক করে মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের দল। যার ওজন প্রায় দেড় কেজি। আটককৃত ওই চোরাকারবারী হলো লিটন আলী শেখ (৩০)। তিনি সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলার জানপুর গ্রামের বাসিন্দা। স্বর্ণের বারগুলো ঢাকা থেকে চাঁপাইনবাবগঞ্জে নিয়ে যাওয়ার সময় গোদাগাড়ী উপজেলার সুলতানগঞ্জে বাস তল্লাশি করে স্বর্ণের বারগুলো উদ্ধার করা হয়।

এই ঘটনার পরে চলতি বছরের ২১ মার্চ রাতে বাংলাদেশ বর্ডার গার্ডের সদস্যরা (বিজিবি) চাঁপাইনবাবগঞ্জের সোনামসজিদ স্থলবন্দরের এক নম্বর গেইট এলাকা থেকে ১০টি স্বর্ণের বার উদ্ধার করা হয়। যার ওজন প্রায় এক কেজি।

রাজশাহীর কয়েকটি গোয়েন্দা সংস্থার সূত্র, ভারতীয় গরু ব্যবসায়ীসহ আরও অনেকেই জানান, প্রতিদিন রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ সীমান্ত দিয়ে বিপুল পরিমাণ মাদক, অস্ত্র এবং গরু পাচার হয়ে বাংলাদেশে ঢুকছে। এসব অবৈধ ব্যবসার দেনা পরিশোধ করতে ভারতের পাচারকারীদের হাতে এদেশের পাচারকারীরা প্রায় অর্ধেক টাকা পরিশোধ করছে হুন্ডির মাধ্যমে আর অর্ধেক টাকা পরিশোধ করছে সোনার মাধ্যমে। যার কারণেই রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ সীমান্ত দিয়ে প্রতিদিন কোটি কোটি টাকার স্বর্ণের বার পাচার হচ্ছে প্রশাসনের চোখে ধুলো দিয়ে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলার লালগোলার চোরাকারবারী এনামুল হক খুদু ভারতীয় সীমান্ত এলাকায় গড়ে তুলেছে পাচারের বড় সিন্ডিকেট। রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ সীমান্ত এলাকা দিয়ে যেসব মাদক, গরু এবং অস্ত্র পাচার হয়ে আসে তার অধিকাংশই নিয়ন্ত্রণ করে এই সিন্ডিকেট। এনামুল হক খুদু এবং তার ভাগ্নে পিন্টু সম্প্রতি ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার কাছে ধরা পড়েছে। তবে পলাতক আছে তার অপর দুই ভাগ্নে অন্টু ও জন্টু। এদের সঙ্গে যোগাযোগ রয়েছে রাজশাহীর মুকুল এববং মনিরুলসহ চাঁপাইনবাবগঞ্জের এক এমপির। বাংলাদেশের এই তিনজন ভারতীয় পাচার সিন্ডিকেটের সঙ্গে যুক্ত হয়ে ওপার থেকে যত অবৈধ জিনিসপত্র এদেশে ঢুকছে তার দেনা পরিশোধ করছে হুন্ডি এবং স্বর্ণের বারের মাধ্যমে। এ কারণেই সম্প্রতি রাজশাহী অঞ্চল দিয়ে স্বর্ণের বার চোরাচালান বৃদ্ধি পেয়েছে।

একটি নির্ভলযোগ্য সূত্র নিশ্চিত করেছে, ভারতের এনামুল সিন্ডিকেটের হয়ে বাংলাদেশের প্রশাসনকে ম্যানেজ করতে স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের আশ্রয় নেওয়া হয়। যার মধ্যে চাঁপাইনবাবগঞ্জের একজন প্রভাবশালী এমপিও রয়েছেন। এছাড়া রাজশাহীর কয়েকজন নেতাও এই সিন্ডিকেটের হয়ে কাজ করছেন। আর এনামুল সিন্ডিকেটের এজেন্ট হিসেবে কাজ করছেন মনিরুল এবং মুকুল নামের দুই ব্যক্তি।

এই সিন্ডিকেটই বাংলাদেশ থেকে যেসব স্বর্ণের বার পাচার হচ্ছে, তার বড় একটি অংশ নিয়ন্ত্রণ করছে। ফলে অধিকাংশ সময় স্বর্ণের বারগুলো ধরা পড়ছেন। সাম্প্রতিক সময়ে মাত্র দুটি বড় চালান আইনশৃঙ্খলা বাহিনী জব্দ করতে পারলেও প্রতিদিন যেসব স্বর্ণের বার পাচার হচ্ছে সেগুলো থাকছে ধরা-ছোঁয়ার বাইরে।

রাজশাহীর একজন ভারতীয় গরু ব্যবসায়ী জানিয়েছেন, শুধু রাজশাহী থেকেই সপ্তাহে অন্তত ৪০০ কোটি টাকা হুন্ডির মাধ্যমে পাচার হচ্ছে। এর চেয়েও বেশি পরিমাণ টাকা পাচার হচ্ছে চাঁপাইনবাবগঞ্জ সীমান্ত দিয়ে। দুই জেলার সীমান্ত দিয়ে স্বর্ণের বারও পাচার হচ্ছে একই হারে। ভারত থেকে যেসব গরু, মাদক এবং অস্ত্রের চালান বাংলাদেশে ঢুকছে তার অন্তত অর্ধেক টাকাই পরিশোধ করতে হচ্ছে স্বর্ণের বারের মাধ্যমে। ফলে এই অঞ্চল দিয়ে স্বর্ণের বার চোরাচালান বেড়েছে।

সূত্র মতে, বাংলাদেশে পাচার হয়ে আসা অবৈধ পণ্যের দেনা পরিশোধ করতে টাকার চেয়ে স্বর্ণের বার দেওয়াটাই নিরাপদ মনে করেন পাচারকারীরা। কারণ প্রতিদিন কোটি কোটি টাকা ভারতীয় পাচারকারীর হাতে তুলে দিতে হয়। এটি করতে গিয়ে দুই দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিতে হয়। তার পরেও বিপুল পরিমাণ টাকা পাঠানো হয়ে উঠে অনিরাপদ; কিন্তু ছোট ছোট আকারের স্বর্ণের বারগুলো খুব সহজেই পাচার করা সম্ভব হয়। এ কারণেই রাজশাহী অঞ্চল দিয়ে এখন স্বর্ণের বার পাচারের ঘটনা বাড়ছে। এভাবেই প্রতিদিন কেজি কেজি স্বর্ণের বার বাংলাদেশী পাচারকারীদের হাত ঘুরে চলে যাচ্ছে ভারতীয় পাচারকারীদের হাতে।

একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়, রাজশাহীর গোদাগাড়ী, পবা, চারঘাট ও বাঘা সীমান্ত দিয়ে পাচার এখনো অব্যাহত আছে। আর এসব সীমান্ত দিয়েই ভারতে পাচার হচ্ছে হুন্ডির টাকা এবং স্বর্ণের বার। অন্যদিকে চাঁপাইনবাবগঞ্জের সীমান্ত এলাকা জোহরপুর, জোহরপুর ট্যাক, অহেদপুর, ফতেপুর ও রঘুনাথপুর সীমান্ত এবং সোনামসজিদ স্থলবন্দর হয়েও পাচার হচ্ছে হুন্ডির টাকা এবং স্বর্ণের বার।

সম্প্রতি এসব সীমান্ত এলাকায় হুন্ডি নিয়ে একটি অনুসন্ধানী খবর প্রকাশের পর নড়ে-চড়ে বসেছিল প্রশাসন। ফলে হুন্ডি কমে এখন স্বর্ণের চোরাচালান বেড়েছে জোরতালে।

রাজশাহী মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিপ্তরের উপ-পরিচালক মোহম্মদ লুৎফর রহমান জানান, মাদকের টাকা পরিশোধের জন্যেও ভারতে স্বর্ণের বার পাচার করা হচ্ছে।

সম্প্রতি গোদাগাড়ীর মহিষালবাড়িতে স্বর্ণের বারসহ লিটন আলী শেখ নামের যাকে ধরা হয়, সেও মাদকের টাকা পরিশোধ করতে স্বর্ণের বারগুলো নিয়ে যাচ্ছিল। তবে মাদক প্রতিরোধে প্রশাসন কঠোর অবস্থানে আছে বলেও দাবি করেন ওই কর্মকর্তা।

জানতে চাইলে রাজশাহী পুলিশ সুপার শহিদুল ইসলাম বলেন, চোরাকারবারিরা তাদের অর্থের লেনদেন করে গোপন মাধ্যমে। স্বর্ণের বাজ এবং হুন্ডির মাধ্যমেই তারা অর্থ পাচার করে। এদের বিরুদ্ধে পুলিশ কাজ করছে।

স/আর