‘গরু’ বনাম ‘গোরু’: সাম্প্রতিক বানান-বিতর্ক

পটভূমি: ‘গরু’র বদলে ‘গোরু’ বানানকে শুদ্ধ ঘোষণা করে একটি পোস্ট দিয়েছিল ফেসবুকের একটি পেজ, যারা ‘শুদ্ধ’ বাংলা বানান প্রচার করে। তাদের রেফারেন্স ছিল বাংলা একাডেমির ২০১৬ সালে প্রকাশিত ‘আধুনিক বাংলা অভিধান’। সম্ভবত সামনে কোরবানির ঈদ থাকায় এবং গরু নিয়ে উদ্বেগ থাকায় পোস্টটি বিপুল মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। তাঁদের অভ্যস্ত গরুর সঙ্গে ‘শুদ্ধ’ বলে ঘোষিত বানানটির অমিল তাঁদের ক্ষুব্ধ করে। ফেসবুকে যা হয়, রাতারাতি বিভিন্ন ব্যক্তি ও পক্ষ ব্যাপারটি নিয়ে নিজ নিজ মত প্রকাশ করতে থাকে। বলা যায়, সামাজিক মিডিয়ায় একধরনের মিডিয়া ট্রায়াল হয়, আর তাতে খানিকটা অন্যায্যভাবে বাংলা একাডেমি এবং আধুনিক বাংলা অভিধান ধরাশায়ী হয়।

বাংলা একাডেমি আসলে অত গোছানো আর প্রভাবশালী প্রতিষ্ঠান নয়, যতটা অনেকে মনে করে থাকে। তদুপরি, অভিধানটিও বেরিয়েছে কয়েক বছর আগে। কয়েক বছর ধরেই দেখছি, বাংলা একাডেমির এ ধরনের কোনো উদাহরণ চোখে পড়লেই মানুষ তেলে-বেগুনে জ্বলে ওঠেন। এটা যে দু শ বছর ধরে বাংলা ভাষার প্রমিতায়নের প্রক্রিয়ায় আমজনতার গলার স্বরকে ক্রমাগত দমন করার প্রতিক্রিয়া, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। ঢাকায় এ গোলমালটা ঢের বেশি; কারণ, এখানে প্রমিতায়নের নামে আসলে কলকাতার উচ্চারণরীতিকে তুমুল প্রাধান্য দিয়ে ভাষা বিধিবদ্ধ করা হয়েছে। এর ফলে ক্ষোভের মাত্রা অনেক বেশি আর তার প্রকাশভঙ্গিও বেশ কতকটা বিশৃঙ্খল। যা-ই হোক, সাম্প্রতিক ‘গরু’-বিতর্কের কয়েকটি দিক নিয়ে পর্যালোচনা করা হয়েছে নিচের সংক্ষিপ্ত পরিসরে।

২। যাঁরা বঙ্কিম, রবীন্দ্রনাথ বা নজরুলের লেখার উদাহরণ দিয়ে আলাপ চূড়ান্ত করেছেন, তাঁরা পদ্ধতির দিক থেকে ঠিক কাজ করেননি। ভাষার প্রমিতকরণ প্রাতিষ্ঠানিক কাজ, ব্যক্তির নয়। তা সে ব্যক্তি যে-ই হোন। ব্যক্তিদের উদাহরণ প্রমিতকরণে নমুনা হিসেবে অবশ্যই প্রভাব ফেলে। তবে সেটা ভিন্ন প্রক্রিয়া।
৩। বাংলা বানান প্রমিতকরণ শুরু হয়েছে ১৯৩৬-এর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোগ থেকে। ওদের ঠিক করা বানানই আমরা একটু-আধটু এদিক-সেদিক করে এখনো ব্যবহার করি। ফলে এর আগের লেখালেখির উদাহরণ সরাসরি এ আলাপে পদ্ধতির দিক থেকে ব্যবহৃত হতে পারে না।

৪। পুরোনো উদাহরণ আপনি টানতে পারেন ভাষা প্রমিতকরণের যে রীতিগুলো প্রতিষ্ঠিত আছে সেগুলোর ক্রিটিক করার জন্য। বিশেষ কোনো বানানের উদাহরণ হিসেবে নয়। বাংলাদেশে যেমন উদাহরণ হিসেবে বলছি, অধ্যাপক শিশির ভট্টাচার্য্য, অধ্যাপক মনসুর মুসা, অধ্যাপক এস এম লুৎফর রহমান এ বিধি মান্য করেন না, বা করতেন না। সে আলাপটা একটা শব্দের ব্যাপার নয়, মূলনীতির আলাপ।

৫। পুরোনো বাংলা পুঁথির উদাহরণ একটা শব্দের ক্ষেত্রে টানা মুশকিল। মূল পুঁথি আর সম্পাদিত পুঁথিতে আকছার ভিন্নতা দেখা যায়। একই পুঁথিতে ভিন্ন ভিন্ন বানান দেখা যায়। অনেকগুলো উদাহরণ জড়ো করা ছাড়া, বা কালের রীতি আবিষ্কার করা ছাড়া এ ধরনের উদাহরণ খুব একটা কাজে লাগে না। রবীন্দ্র রচনাবলিতে ব্যাপক ‘গোরু’ বানানের ক্ষেত্রে দেখা দরকার, বানানটা কখন কীভাবে ব্যবহৃত হয়েছে। বিশেষত বিশ্বভারতীর সংস্করণে যেহেতু ‘গোরু’ এবং ‘গরু’ দুই বানানই আছে (‘গোরু’ বানানই বেশি), সেহেতু সিদ্ধান্তটা কীভাবে নেওয়া হয়েছে তা বিচার না করে এ উদাহরণ ব্যবহার করা কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের পদ্ধতি হিসেবে মানসম্মত হবে না।

৬। নতুন করে ‘গোরু’র প্রবেশ উচ্চারণের জন্য হয়নি। কারণ, বাংলা উচ্চারণের প্রথম সূত্র অনুযায়ীই ‘গরু’ শব্দের উচ্চারণ ‘গোরু’ হবে। এর জন্য আলাদা করে ‘গোরু’ লেখার কোনো দরকার নেই। তাহলে ‘নোদী’, ‘মোরু’, ‘তোরু’ ইত্যাদিও লিখতে হয়।

তা ছাড়া গরু অর্থে ‘গো’ বাংলায় ব্যাপকভাবে চালু থাকায় ‘গোরু’ বানানে বিভ্রান্তির অন্য একটা মাত্রা যুক্ত হয়। ‘রু’ অংশটা বাহুল্য হয়।
৭। এ বানান এসেছে ব্যুৎপত্তিগত যুক্তিতে। এবং সে কারণেই এটা মোটেই নিরীহ ব্যাপার নয়। বাংলায় উচ্চারণানুগ বানান-স্কুলের বিপরীতে ব্যুৎপত্তি-স্কুলের বিবাদ বহু পুরোনো। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বানানবিধিতে শেষোক্ত স্কুল অংশত পিছু হটলেও নানা উপলক্ষে তারা আসর গাড়তে চায়। এটা উনিশ শতকীয় কলোনিয়াল রোগের প্রকাশ।

মনে রাখতে হবে, কয়েক শ বছর ধরে ধারাবাহিকভাবে ব্যবহৃত বানানের ঐতিহ্য আর কোনো ‘মূল’ ভাষার ‘মূল’ শব্দের অনুকরণে বানান প্রমিতকরণ সম্পূর্ণ ভিন্ন জিনিস। আমাদের বেশির ভাগ আলোচক এই মূল্যবান সূত্রটি গুলিয়ে ফেলেন।

৮। বাংলা একাডেমির সর্বশেষ অভিধানে যে ও-কারের প্রাধান্য আছে, সংখ্যাবাচক শব্দ (বারো, তেরো) এবং ক্রিয়াপদ-যে (করো, ধরো, বলো) ও-কার দিয়ে লেখা হয়েছে, তা মোটেই নিরীহ ব্যাপার নয়। এ শব্দগুলো এমনিতেই খানিকটা ও-কারান্ত হয়ে উচ্চারিত হয়; কারণ, বাংলা শব্দের শেষ ‘অ’-এর উচ্চারণ সাধারণত ‘ও’-এর মতোই হয়। ‘ও’-এর মতো উচ্চারণের ক্ষেত্রে ঢাকা ও কলকাতার প্রধান প্রবণতার সুস্পষ্ট ফারাক আছে। এ অবস্থাকে বিন্দুমাত্র আমলে না এনে প্রমিতায়নে কলকাতার উচ্চারণ-প্রবণতাকে অনুকরণ করা কোনো কাজের কথা নয়। ভাষা-রাজনীতির দিক থেকেই ব্যাপারগুলোর পর্যালোচনা হওয়া জরুরি। একই কারণে বলা যায়, যাঁরা ব্যাপারটাকে রসিকতা হিসেবে দেখছেন, বা ‘এটাও হয়, ওটাও হয়’ ধরনের লিবারেল দৃষ্টিভঙ্গি প্রচার করেছেন, তাঁরা বোধ হয় ব্যাপারটা খুব একটা তলিয়ে দেখেননি।

৯। সবশেষে ‘গরু’ ও ‘গোরু’ প্রসঙ্গে একটি ঐতিহাসিক কৌতুক:
বাংলা বানান সংস্কার সমিতি ও রবীন্দ্রনাথ প্রসঙ্গে একদিনের একটি কাহিনি বলি। বিবরণটি হীরেন্দ্রনারায়ণ মুখোপাধ্যায়ের একটি রচনা থেকে গৃহীত।
‘… রবীন্দ্রনাথের মুখ থেকে সাহিত্য সম্পর্কে কিছু শোনার আগ্রহ ছিল। কিন্তু বাধা পড়ল সুনীতিবাবু, চারুবাবু ও বিজন ভট্টাচার্যের আগমনে।
‘তারপর কী খবর’? রবীন্দ্রনাথ তাঁদের অভ্যর্থনা করলেন।

‘বানান পরিষদের দায়িত্ব পড়েছে ঘাড়ে। তাই বাংলা বানান সম্বন্ধে আপনার কিছু মতামত দরকার’, বলে নিজেকে একটু এগিয়ে দিলেন সুনীতিবাবু।
‘আপনার মতামত ছাড়া কি বাংলা ভাষার কোনো পরিবর্তন করা চলে। বিশেষ করে আমাদের যুগে যখন আপনাকে পেয়েছি’, বলে সুনীতিবাবু বানানের কথা পাড়লেন। ‘কতকগুলো শব্দের মৌলিক রূপটা বজায় রাখবার জন্য চলতি বানান কিছু কিছু পরিবর্তন করতে চাইছি’। ‘যথা?’ রবীন্দ্রনাথ জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে চাইলেন।

সুনীতিবাবু বললেন, ‘যেমন গরু। আমরা বানান লিখি গরু। কিন্তু আমার মনে হয় শব্দটা গো-রূপ থেকে এসেছে। সুতরাং বানানটা গরু না হয়ে গোরু হলেই ভালো হয়’।

‘হ্যাঁ। অন্তত কলেবর বৃদ্ধি হয়। গাইগুলো দিন দিন যেমন ক্ষীণ হয়ে পড়েছে, কলেবর বাড়ানো ভালো নিশ্চয়ই, কিন্তু তাতে দুধ বাড়বার সম্ভাবনা আছে কি’? রবীন্দ্রনাথ কৌতূহলপূর্ণ দৃষ্টিতে মুখ তুলে চাইলেন। কারও পক্ষেই হাসি সংবরণ করা সম্ভব হলো না।

(রবীন্দ্রনাথ রবীন্দ্রনাথই / অমিত্রসূদন ভট্টাচার্য, দে’জ পাবলিশিং, কলকাতা, প্রথম প্রকাশ ২০০৬ পৃ. ১২৯-৩০)
১০। আশা করি, এসব বিতর্ক উপলক্ষে অন্তত কেউ কেউ বাংলা ভাষার প্রমিতায়নের গত দু শ বছরের ইতিহাস একটু করে হলেও চেখে দেখার সুযোগ নেবেন।

মোহাম্মদ আজম: ভাষা গবেষক এবং শিক্ষক, বাংলা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।