গতিশীল অর্থনীতিতে দক্ষ জনবল অপরিহার্য

আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা এখনও গতানুগতিকতা থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি এ কথা অকপটে স্বীকার করতে আমার কোনো দ্বিধা নেই। ক্রমবর্ধমান পরিবর্তনশীল এ পৃথিবীতে শিক্ষাব্যবস্থাও প্রতিনিয়ত পরিবর্তনশীল।

সম্প্রতি করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বিশ্বে এ পরিবর্তনকে আরও বেশি ত্বরান্বিত করেছে। কিন্তু আমরা কি আমাদের প্রচলিত গতানুগতিক শিক্ষাব্যবস্থা আঁকড়ে থাকব? গতানুগতিক চিন্তাভাবনা নিয়ে পড়ে থাকলে পরিবর্তনশীল এ পৃথিবীতে আমাদের আরও বেশি পিছিয়ে পড়তে হবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই।

বর্তমানে আমাদের দেশের বাস্তব চিত্রটি হচ্ছে, বেকারের সংখ্যা ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। বেকারত্ব একটি জাতির জন্য অভিশাপ। এর কারণে শিক্ষা খাতে সরকারের অর্জিত সব অর্জন ম্লান হয়ে যেতে পারে। বেকারত্বের কারণে তরুণ সমাজ বিপথগামী হয়ে পড়লে দেশে অরাজকতা সৃষ্টি হতে পারে।

দেশে বর্তমানে তৈরি পোশাক খাতে ম্যানেজারিয়াল ও টেকনিক্যাল বিভাগে ২ লাখ বিদেশি নাগরিক কাজ করছে। তাদের আয় ৭ বিলিয়ন ডলার। সরকারি হিসাবমতে, বর্তমানে দেশের এক কোটির বেশি শ্রমিক বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কাজ করছেন। তাদের পাঠানো রেমিটেন্স ১৫ বিলিয়ন ডলারের মতো। সেখানে ২ লাখ বিদেশি আমাদের দেশ থেকে নিয়ে যাচ্ছেন ৭ বিলিয়ন ডলার। ফলে আমরা যে পরিমাণ রেমিটেন্স আনি, তা আবার দিয়ে দিতে হয়।

সবচেয়ে পরিতাপের বিষয় হল- আমাদের দেশের নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে পাস করা শিক্ষার্থীরা যখন বেকারত্বের গ্লানি বয়ে বেড়াচ্ছেন, তখন ২ লাখ বিদেশি নাগরিক আমাদের দেশে কাজ করে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার নিয়ে যাচ্ছেন। অনেক ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভালো সাবজেক্টে পড়াশোনা করেও আমাদের ছেলেরা কাঙ্ক্ষিত চাকরিটি পর্যন্ত পাচ্ছেন না। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য পরিকল্পিতভাবে দক্ষ জনশক্তি তৈরির কোনো বিকল্প নেই। আধুনিক যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে শিক্ষিত দক্ষ মানবসম্পদ তৈরিতে আমরা বরাবরই ব্যর্থ।

এ ব্যর্থতার দায় স্বীকার করে গতানুগতিকতার বাইরে এসে শিক্ষাব্যবস্থাকে কর্মমুখী করে ঢেলে সাজানোর সময় এসেছে। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে আরও বেশি জীবনমুখী করে ঢেলে সাজাতে হবে। শুধু পাসের হার বাড়ার মাধ্যমেই শিক্ষাব্যবস্থার উন্নতি হচ্ছে, এ ধারণা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। কারণ শিক্ষাব্যবস্থায় গুণগত পরিবর্তন না আনতে পারলে আমরা ২০৪১ সালের মধ্যে আমাদের প্রিয় বাংলাদেশকে কাঙ্ক্ষিত উন্নত দেশের কাতারে নিয়ে যেতে পারব না।

আমি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি, আমাদের তরুণ সমাজ অনেক বেশি উদ্যমী, পরিশ্রমী ও সম্ভাবনাময়। এ সম্ভাবনাকে সঠিকভাবে কাজে না লাগাতে পারার ব্যর্থতা আমাদেরই। কারণ আমরা আমাদের দেশে নতুন নতুন উদ্যোক্তা তৈরির সহায়ক পরিবেশ ও নীতি গ্রহণ করতে পারিনি। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকেও এ ব্যর্থতার দায় নিতে হবে। শুধু তাই নয়, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে এখন নতুন নতুন গবেষক সেই অনুযায়ী তৈরি হচ্ছে না। বেশিরভাগ শিক্ষক আজ গবেষণাকর্ম থেকে দূরে থাকেন।

তবে আমাদের কিছু নিবেদিতপ্রাণ শিক্ষক বিদেশের বিলাসবহুল জীবন ও অর্থ-সম্পদের মায়া ত্যাগ করে দেশ ও জাতির কল্যাণে শিক্ষা-গবেষণায় নিজেদের উৎসর্গ করে চলেছেন। তাদের খাটো করার জন্য আমি এ কথাগুলো বলিনি। কারণ আমরা জানি, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো হচ্ছে একটি জাতির জন্য আলোকবর্তিকা, মুক্তবুদ্ধির চর্চা আর জ্ঞান সৃষ্টির জায়গা। কিন্তু আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তাদের এ অবস্থান থেকে ক্রমাগত দূরে সরে যাচ্ছে।

বিশ্ব র‌্যাংকিংয়েও আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অবস্থা খুবই নাজুক। লন্ডনভিত্তিক শিক্ষা সাময়িকী ‘টাইমস হায়ার এডুকেশনে’ ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি র‌্যাংকিং-২০২০-এর প্রকাশিত তালিকায় বাংলাদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয় এক হাজারের ভেতর স্থান পায়নি। তালিকায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান এক হাজারের নিচে। র‌্যাংকিংয়ে বিদেশি ছাত্রের ক্ষেত্রে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পেয়েছে শূন্য। অর্থাৎ বিশ্ববিদ্যালটির ৪ হাজার ১০৮ শিক্ষার্থীর মধ্যে কোনো বিদেশি শিক্ষার্থী নেই কিংবা থাকলেও সেই সংখ্যা সন্তোষজনক নয়। তালিকাটি লক্ষ করলে দেখা যায়, বাংলাদেশের প্রতিবেশী দেশ ভারত ও পাকিস্তানের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বেশ ভালো করেছে।

এ তালিকায় তিনশ’ থেকে শুরু করে এক হাজারের মধ্যে রয়েছে ভারতের ৩৬টি বিশ্ববিদ্যালয়। এমনকি রাজনীতিসহ বিভিন্ন ইস্যুতে অস্থিতিশীল দেশ পাকিস্তানের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অবস্থানও বাংলাদেশের চেয়ে ভালো। তালিকায় এক হাজারের মধ্যে রয়েছে পাকিস্তানের সাতটি বিশ্ববিদ্যালয়।

বর্তমানে আমাদের দেশের প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষার সামগ্রিক চিত্রও হতাশাজনক। শহর এলাকায় ব্যাঙের ছাতার মতো গড়ে উঠেছে কিন্ডারগার্টেন, ক্যাডেট স্কুল ও কোচিং সেন্টার। শিক্ষার মানোন্নয়ন নয়, ব্যবসাই মূল লক্ষ্য এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান মালিকের। স্বল্পশিক্ষিত শিক্ষক দ্বারা পাঠদান, সরকারের পাঠ্যবইয়ের তুলনায় নিজেদের বইকে প্রাধান্য এবং অতিরিক্ত বইয়ের বোঝা চাপিয়ে দেয়া, অসহনীয় ভর্তি ফি আদায়, অতিরিক্ত মাসিক বেতন, অপ্রয়োজনীয় পরীক্ষার নামে মাসে মাসে পরীক্ষা ফি আদায়, শ্রেণি কার্যক্রম শুরুর আগে জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশন না করার অভিযোগ রয়েছে এসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে।

দেশব্যাপী বেসরকারি স্কুলগুলোয় টিউশন ফি, সেশন চার্জ ও ভর্তি ফি আদায় নিয়ে নৈরাজ্য চলছে। প্রতিষ্ঠানগুলো ইচ্ছামতো ফি আদায় করছে। এ নিয়ে সরকারের সুনির্দিষ্ট নীতিমালা থাকলেও তা কেউই মানছে না। শিক্ষা প্রশাসনও অনেক ক্ষেত্রেই কার্যকর ভূমিকা রাখতে ব্যর্থ হচ্ছে। কিন্ডারগার্টেন স্কুলগুলোর জন্য কোনো একক বা সাধারণ পাঠ্যক্রম নেই। নেই প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষার জন্য কোনো দিকনির্দেশনাও।

আমাদের মনে রাখতে হবে, প্রাথমিক পর্যায়ে শিক্ষার মান তলানিতে রেখে কখনই দক্ষ ও মেধাবী জাতি গঠন সম্ভব নয়। অস্বীকার করার উপায় নেই, বিশ্বের উন্নত দেশের তুলনায় আমাদের দেশে শিক্ষাক্ষেত্রে বরাদ্দ তুলনামূলক কম।

সীমিত সম্পদ ও বিপুল জনসংখ্যার চাপ উপেক্ষা করে উন্নয়ন ও অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখতে দক্ষ জনবল তৈরির লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে সরকার। রূপকল্প-২১ পরিকল্পনার আওতায় উচ্চতর প্রবৃদ্ধি অর্জন, বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন ও প্রাক্কলিত রাজস্ব আহরণে জোর দেয়া হয়েছে। আর এসব ক্ষেত্রে সাফল্য আনতে মানবসম্পদ উন্নয়নে সবচেয়ে জোর দেয়া হচ্ছে।

পরিপ্রেক্ষিত পরিকল্পনার লক্ষ্যানুযায়ী জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে হলে বিনিয়োগ ও বিনিয়োগের উৎপাদনশীলতা ও দক্ষতা বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। প্রতিযোগিতামূলক বিশ্ব বাণিজ্যে টিকে থাকতে ও উৎপাদন সক্ষমতা বাড়াতে তথ্যপ্রযুক্তি খাতের উন্নয়নের পাশাপাশি প্রয়োজন দক্ষ মানবসম্পদ। বিপুল জনসংখ্যাকে জনসম্পদে পরিণত করার জন্য সবার আগে যা দরকার তা হল সবার জন্য কর্মমুখী শিক্ষাব্যবস্থা চালু করা। কারণ আমাদের দেশের বিদ্যমান শিক্ষাব্যবস্থা বেকারত্ব ঘোচাতে পারছে না।

বিশ্ব শ্রমবাজারে টিকে থাকার জন্য দক্ষ জনশক্তি তৈরি করতে হবে। কর্মমুখী শিক্ষার মাধ্যমে চীন তাদের শিক্ষাক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটিয়েছে। চীন সরকার তাদের গবেষণা খাতে ব্যাপক বিনিয়োগ করছে। একেবারে ঢালাওভাবেই বিনিয়োগ করছে। এর ফলে খুব অল্পদিনের মধ্যেই বিশ্বসেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় চীনের সরব উপস্থিতি নিশ্চিত করতে পেরেছে তারা। এমনকি আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারত তাদের ২০টি বিশ্ববিদ্যালয়কে বিশ্বমানে নেয়ার ঘোষণা দিয়েছে।

প্রতিবেশী দেশগুলোর তুলনায় শিক্ষা খাতে বিনিয়োগে আমরা অনেক পিছিয়ে রয়েছি। এবারের বাজেট অধিবেশনের আগ পর্যন্ত আশা করা হয়েছিল, করোনা পরিস্থিতির কারণে আগামী অর্থবছরের বাজেটে শিক্ষা খাতের বরাদ্দ বাড়বে; কিন্তু অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল আমাদের হতাশ করেছেন। ২০২০-২১ অর্থবছরের জন্য শিক্ষা খাতে ৬৬ হাজার ৪০০ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করেছেন। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের জন্য ২৪ হাজার ৯৩৭ কোটি, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষায় ৩৩ হাজার ১১৮ কোটি এবং কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগের জন্য ৮ হাজার ৩৩৮ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করেছেন।

শিক্ষা খাতে বরাদ্দের পরিমাণ মোট ব্যয়ের ১১ দশমিক ৬৯ শতাংশ এবং জিডিপির ২ দশমিক ০৯ শতাংশ; যা গত বছরের তুলনায় মাত্র ০.০১ শতাংশ বেশি। সামগ্রিক বিচারে মূল্যস্ফীতি ও জাতীয় প্রবৃদ্ধির বিবেচনায় প্রকৃত অর্থে শিক্ষা খাতে বাজেট বরাদ্দ কমে গেছে, যা আমাদের মর্মাহত করেছে। বর্তমানে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আমাদের প্রায় এক কোটির মতো প্রবাসী রয়েছে। বৈশ্বিক জ্বালানি তেলের দাম কমে যাওয়ায় তেল রফতানিনির্ভর গোটা আরব বিশ্বের অর্থনীতি এখন চরম বিপর্যয়ের মুখোমুখি।

এর ফলে সেখানে অবস্থানরত আমাদের প্রবাসীরা চরম অনিশ্চয়তার মধ্য দিয়ে দিনাতিপাত করছেন। আস্তে আস্তে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্সেও ভাটা পড়তে শুরু করবে। কারণ আমাদের রেমিটেন্সের বেশিরভাগই আসে আরব রাষ্ট্রগুলো থেকে। এক গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশের এক কোটির মতো প্রবাসীর আয় প্রায় ১৫ বিলিয়ন ডলার।

বিপরীতে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত, মাত্র ১ কোটি ৩০ লাখের মতো জনগোষ্ঠী পাঠিয়ে আয় করছে ৬৮ বিলিয়ন ডলার। একমাত্র অদক্ষতার কারণেই আমরা তাদের সঙ্গে কুলিয়ে উঠতে পারছি না। সরকার উদ্যোগ নিয়ে বিপুলসংখ্যক জনশক্তিকে দক্ষ করতে পারলে আমাদের প্রবাসী আয় আরও তিনগুণ বৃদ্ধি পাবে। সেই সঙ্গে বিদেশের শ্রমবাজারে আমাদের শ্রমিকদের চাহিদাও বাড়বে।

এ জন্য সবার আগে আমাদের গতানুগতিক শিক্ষাব্যবস্থা থেকে বেরিয়ে এসে কর্মমুখী শিক্ষার প্রতি জোর দিতে হবে। বিশেষ করে আইটি ও কারিগরি শিক্ষাব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। বিশ্ববাজারের চাহিদার ভিত্তিতে বাংলাদেশে বিপুল কর্মক্ষম মানুষকে বিভিন্ন প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষ করে গড়ে তুলতে হবে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়াতে হবে। তাদের কোন ধরনের শ্রমশক্তি প্রয়োজন তা জানতে হবে। শুধু প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করলে হবে না। তাদের চাহিদা বুঝে শ্রমিকদের প্রস্তুত করতে হবে।

এ অবস্থায় আমরা বন্ধুপ্রতিম দেশ চীন, জাপান ও ভারতের গৃহীত পলিসিগুলো থেকে শিক্ষা নিতে পারি। তবে আশার বিষয় হল, ২০২১ সালে স্কুল ও মাদ্রাসায় ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত কর্মমুখী প্রকৌশল শিক্ষা বাধ্যতামূলক করার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এজন্য ইতোমধ্যে পাঠ্যক্রম প্রণয়নের কাজ শেষ হয়েছে। বই সম্পাদনার কাজও চলছে। বর্তমান সরকারের এ ধরনের উদ্যোগ প্রশংসার দাবি রাখে।

মুনতাকিম আশরাফ : সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট, এফবিসিসিআই

 

সুত্রঃ যুগান্তর