গণপরিবহনের মালিক-শ্রমিকদের নৈরাজ্যের শিকার নারী

সিল্কসিটিনিউজ ডেস্ক:

রাজধানীতে একের পর এক গণপরিবহণে যৌন-হয়রানির অভিযোগ উঠছে। হয়রানির শিকার নারীরা মুখ খুলছেন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে, প্রতিবাদ উঠছে বন্ধু-সহপাঠীদের কাছ থেকে। যাত্রী অধিকার আন্দোলনের সঙ্গে যুক্তরা বলছেন, এই পরিস্থিতির নেপথ্যে সবচেয়ে বড় কারণ পরিবহণ শ্রমিকরা। তারা যতই অপরাধ করুক, বিচারের মুখোমুখি হতে হয় না বলে গণপরিবহন কেন্দ্রিক নৈরাজ্য বাড়ছে। মালিক-শ্রমিকের একচ্ছত্র আধিপত্যই সবচেয়ে বড় হুমকি।

এ ব্যাপারে মালিকরা বলছেন, শ্রমিকরা ৫০ শতাংশই মাদকাসক্ত। যে কারণে পরিবহনে যাত্রীদের সঙ্গে বিভিন্ন অনৈতিক আচরণ করে তারা।

তবে পরিস্থিতি যাতে ভয়াবহ রূপ নিতে না পারে, সেজন্য ইতোমধ্যে গণপরিবহনের ভেতরে বড় করে গাড়ির নম্বর ও জাতীয় হেল্প লাইন ‘৯৯৯’ লিখে রাখা বাধ্যতামূলক করতে যাচ্ছে সরকার। কিন্তু কেন এধরনের পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে এবং হয়রানির শিকার নারী আইনি সহায়তা নিতে ভয় পাচ্ছে কিনা- সেদিকে নজর দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন নারীনেত্রী ও গবেষকরা।

গত ২৩ এপ্রিলের ঘটনা। দুপুর দেড়টায় বাড্ডা লিংক রোড থেকে তুরাগ পরিহনের বাসে ওঠেন এক শিক্ষার্থী। বাসটি বাড্ডা নতুন বাজার এলাকায় পৌঁছানোর পর খালি হয়ে যায়। কিন্তু নতুন করে আর যাত্রী ওঠানো হয় না। বিষয়টি দেখে ওই শিক্ষার্থীর সন্দেহ হলে বাস থেকে নেমে যেতে চান তিনি। এসময় বাসের হেলপার এসে তার পাশে বসে। এরপর সুপারভাইজার গাড়ির চালককে রুট বদলে ৩০০ ফিটের দিকে গাড়ি নিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দিলে কোনোমতে বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার সামনে ওই শিক্ষার্থী বাস থেকে লাফিয়ে পড়েন।

সম্প্রতি এরকম আরও ঘটনা ঘটেছে। জানা যায়, ১৫ মে বেলা ১২টায় রাজধানীর দেওয়ান পরিবহনের একটি বাসের হেলপার ও চালক যৌন-হয়রানি করেছে বলে অভিযোগ করেছেন তেজগাঁও কলেজের এক শিক্ষার্থী। ওই শিক্ষার্থী বাংলা ট্রিবিউনকে জানান, বাড্ডা থেকে লিংক রোড হয়ে তেজগাঁও কলেজে যাওয়ার সময় গুলশান এক নম্বরে গাড়িটি জ্যামে আটকা পড়লে যাত্রীরা নেমে যান। বাস চালক ও হেলপার তাকে সেসময় বিভিন্ন অঙ্গভঙ্গিতে কথা বলতে থাকেন। তারা নানা রকম উসকানি, নারী বিদ্বেষী ও কটূক্তিমূলক কথা বলতে থাকে। এসময় বারবার নেমে যেতে চাইলেও তাকে নামতে দেওয়া হয়নি।

বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাক পরিচালিত এক গবেষণা বলছে, গণপরিবহনে যাতায়াত করতে গিয়ে ৯৪ শতাংশ নারী কোনও না কোনও সময় যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছেন এবং সেটি বয়স্ক পুরুষদের দ্বারা। এদিকে, গণপরিবহনে নারীর ভোগান্তি নিয়ে অ্যাকশন এইড-এর গবেষণায় দেখা গেছে, গণপরিবহনে যৌন হয়রানি এড়াতে শতকরা ১৩ ভাগ নারী গণপরিবহন ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকেন, যা নারীদের কর্ম-স্বাস্থ্য এবং শিক্ষার ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।

এ প্রসঙ্গে অ্যাকশন এইডের কান্ট্রি ডিরেক্টর ফারাহ কবীর বলেন, ‘গণপরিবহনে যৌন হয়রানির ঘটনায় অপরাধীদের কঠোর শাস্তি দেওয়া হলে এ প্রবণতা কমবে। যখন এ ধরনের অপরাধ ঘটে, তখন কোনও না কোনোভাবে তারা পার পেয়ে যায়। আর মালিকশ্রেণির ছত্রছায়ায় রাষ্ট্র তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারে না। আমাদের দেশে অল্প আয় বা নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য যে গণপরিবহন সেখানেই যদি এই পরিস্থিতি হয়, তাহলে স্বস্তিতে যাতায়াতের জায়গা কোথায়?’

যাত্রী অধিকার আন্দোলনের মুখপাত্র মাহমুদুল হাসান শাকুরী বলেন, ‘গণপরিবহণে নৈরাজ্য দীর্ঘদিনের সমস্যা। কিন্তু বর্তমান সময়ে এই সমস্যা রাজধানীসহ সারাদেশে ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে। এর নেপথ্যে সবচেয়ে বড় কারণ পরিবহণ শ্রমিকরা। তারা যতই অপরাধ করুক, কোনও বিচার হয় না। আইন থাকলেও তার যথাযথ বস্তবায়ন হয় না। ফলে গণপরিবহণের মালিক ও শ্রমিক বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। তারা সাধারণ যাত্রীদের মারধর করা থেকে শুরু করে যৌন নিপীড়নের মতো অপরাধ করতে দ্বিধা করছে না।

তিনি আরও বলেন, ‘গণপরিবহণের নৈরাজ্যময় পরিস্থিতির জন্য সড়ক ও পরিবহণ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ, পরিবহণ মালিক, শ্রমিক এবং যাত্রীদের মাঝে সমন্বয়হীনতাও অন্যতম কারণ। এসব সমস্যা সমাধান করতে হলে গণপরিবহণ আইনের যথাযথ বাস্তবায়ন করতে হবে। সড়ক দূর্ঘটনায় নিহত হলে মৃত্যুদণ্ডের বিধান ও দুই কোটি টাকা জরিমানার বিধান এবং যৌন নিপীড়নকারীদের যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের বিধান রেখে আইন সংশোধন করা প্রয়োজন।’

এত সাহস পরিবহন শ্রমিকরা কোথায় পায়- এই প্রশ্নের জবাবে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্লাহ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বাজারে চালক বা হেলপারের অভার রয়েছে কিন্তু তাদের চাকরির অভাব নেই। এক্ষেত্রে মালিকরা একটু কঠোর হলে তারা চাকরি ছেড়ে দেয়। যে কারণে মালিকরা তাদের বিরুদ্ধে সরাসরি কোনও ব্যবস্থা নিতে চায় না। এ কারণেই বেপরোয়া হয়ে পড়ে পরিবহন শ্রমিকরা।’

তিনি আরও বলেন, ‘পরিবহন শ্রমিকদের কোনও শক্তি নেই। তারা ক্ষমতাধরও না। এদের ৫০ শতাংশই মাদকাসক্ত। যে কারণে পরিবহনে যাত্রীদের সঙ্গে বিভিন্ন অনৈতিক আচরণ করে থাকে তারা।’

বাংলা ট্রিবিউন