‘গঙ্গা চুক্তি নিয়েও ভাবুন’ – দিল্লিকে বলছেন হাসিনা

সিল্কসিটিনিউজ ডেস্ক: ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে ১৯৯৬ সালে স্বাক্ষরিত গঙ্গা-চুক্তির মেয়াদ ফুরোতে এখনও প্রায় বছর দশেক বাকি থাকলেও – ঢাকা চাইছে, বর্তমান আকারে চুক্তিটির নবায়ন না-করে নতুন কোনও বিকল্প ব্যবস্থার কথা ভাবা হোক।

বিবিসি জানতে পেরেছে, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার সাম্প্রতিক ভারত সফরে এই প্রসঙ্গটির অবতারণা করেছেন – এবং যথেষ্ট সময় হাতে নিয়ে যাতে বর্তমান গঙ্গা চুক্তির সীমাবদ্ধতাগুলো দূর করার চেষ্টা শুরু করা হয় দিল্লিকে সে অনুরোধও জানিয়েছেন।

ভারতের বিশেষজ্ঞরাও মনে করছেন, শেখ হাসিনার এই অনুরোধ খুবই স্বাভাবিক – কারণ এখনকার চুক্তিতে সত্যিই বেশ কিছু অসঙ্গতি আছে যার ফলে বাংলাদেশকে ভুগতে হচ্ছে।

ভারত সরকার অবশ্য এ বিষয়ে এখনও আনুষ্ঠানিক কোনও মন্তব্য করতে রাজি হয়নি।

ফলে তিস্তা নিয়ে যখন ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে এক ধরনের কূটনৈতিক টেনশন চলছে – তখন প্রায় নীরবেই আর একটি অভিন্ন প্রধান নদীর জলবন্টন নিয়েও দুদেশকে নতুন করে ভাবনাচিন্তা শুরু করতে হচ্ছে, আর সেটি হল গঙ্গা।

কুড়ি বছর আগে যে চুক্তির মাধ্যমে গঙ্গার জল ভাগাভাগির সমস্যা মিটেছিল, সেই চুক্তির মেয়াদ ফুরোবে ২০২৬ সালে।

কিন্তু বাংলাদেশ চাইছে সেই চুক্তির মেয়াদ আর না-বাড়িয়ে ভাগাভাগির নতুন কোনও ব্যবস্থা ভাবা হোক, যেটা তাদের ভাগের ন্যায্য পাওনা নিশ্চিত করবে।

দিল্লিতে নিযুক্ত বাংলাদেশের হাইকমিশনার সৈয়দ মোয়াজ্জেম আলি বিবিসিকে জানিয়েছেন, প্রধানমন্ত্রী হাসিনার সাম্প্রতিক ভারত সফরেই দুদেশের আলোচনায় এ প্রসঙ্গটি উঠেছিল।

তিনি বলেন, “গঙ্গা অববাহিকায় আমরা যে চুক্তিটা করেছিলাম তা নিয়ে তো আমাদের আলোচনার প্রয়োজন আছে। কারণ আজ থেকে কুড়ি বছর আগে আমরা চুক্তিটা করেছিলাম, আর বাকি আছে দশ বছরেরও কম। ফলে দশ বছর বাদে বিকল্প পরিকল্পনাটা কী, সেটা তো এখন থেকেই ভাবতে হবে।”

“আমরা যে গঙ্গা প্রকল্পের কথা বলছি, সেটার সাথে ভারতের পরিকল্পনা সিনক্রোনাইজ করে চুক্তির মেয়াদ ফুরোনোর পর কী বিকল্প ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে সেটার জন্য এখন থেকেই মাথা ঘামানো দরকার। কারণ হাতে সময় মাত্র দশ বছর, আর এ বিষয়ে অনেক আলোচনারও অবকাশ আছে”, বলছেন রাষ্ট্রদূত মি আলি।

কুড়ি বছর আগে যখন গঙ্গা-চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়, তখন বেশ তাড়াহুড়ো করে মাত্র দুতিনমাসের মধ্যে সেই চুক্তির গ্রাউন্ডওয়ার্ক করা হয়েছিল।

ওই চুক্তির একটা প্রধান সমালোচনা হল, ফারাক্কা পয়েন্টে প্রাপ্য জলের পরিমাণের ভিত্তিতে সেখানে দুদেশের পাওনা নির্ধারণ করা হয়েছে, কিন্তু গঙ্গার উজানে ভারত কীভাবে নদীর জলসম্পদকে ব্যবহার করবে সে ব্যাপারে বাংলাদেশের কিছুই করণীয় নেই।

ফলে ভারতের বিশিষ্ট নদী-বিশেষজ্ঞ হিমাংশু ঠক্কর মনে করেন, আজ কুড়ি বছর বাদে বাংলাদেশ যদি মনে করে গঙ্গা চুক্তি তাদের পুরোপুরি স্বার্থরক্ষা করতে পারছে না তাহলে তার পেছনে সঙ্গত কারণও আছে।

তিনি বরছেন, “এই চুক্তির একটা সীমাবদ্ধতা হল এটা শুধু জানুয়ারি থেকে মে – এই শুখা মরশুমের জল ভাগাভাগির কথাই বলে, বছরের বাকি সময়টা সম্পর্কে চুক্তি নীরব। দ্বিতীয়ত, উজানে জল কীভাবে ব্যবহার করা হবে তা নিয়ে চুক্তিতে কোনও বাধ্যবাধকতা নেই। এমন কী শুধু বাংলাদেশ কেন, গঙ্গা অববাহিকায় উজানের একটা রাজ্য জলাধার তৈরি করলে ভারতেরই পশ্চিমবঙ্গ বা বিহারের সেখানে কিছু বলার নেই।”

“তা ছাড়া গঙ্গা বেসিনে জলের একটা প্রধান উৎস হল কোশী-গন্ডক-শোনের মতো নেপালে উৎপন্ন নদীগুলো, কিন্তু এই চুক্তিতে নেপালের কোনও ভূমিকা নেই। ফলে বাংলাদেশ চাইতেই পারে নেপালকে যুক্ত করে এটিকে একটি ত্রিদেশীয় চুক্তিতে রূপ দিতে, তাতে পরে তাদের নেপালের জলবিদ্যুৎ খাতে সমঝোতা করতেও সুবিধা হবে”, বলছেন তিনি।

বাংলাদেশের এই অনুরোধ নিয়ে ভারতে সরকারি কর্মকর্তারা এখনও প্রকাশ্যে কোনও মন্তব্য করতে রাজি হননি, তবে তারা স্বীকার করেছেন শেখ হাসিনার অবস্থান গঙ্গা নিয়ে তাদেরও নতুন করে ভাবাচ্ছে।

ইতিমধ্যে ফারাক্কা বাঁধ যে মালদা (দক্ষিণ) সংসদীয় কেন্দ্রের ভেতরে পড়ে, সেই আসনের এমপি ও বর্ষীয়ান রাজনীতিক আবু হাশেম খান চৌধুরী বিবিসিকে বলেছেন ফারাক্কা পয়েন্টে জলের প্রবাহ যে ক্রমশ কমছে তাতে কোনও সন্দেহ নেই – আর তার পেছনে নানা কারণও আছে।

মি চৌধুরীর কথায়, “গঙ্গার যে ধারা বা ন্যাচারাল কোর্স আছে – যেটা দিয়ে জলটা যায় – তা খুব ঘন ঘনই পরিবর্তন হচ্ছে। এটা যতদিন না ঠিক করা যাচ্ছে ততদিন সমস্যাটা থাকবেই। আমার ধারণা আগামী দু-একবছরের মধ্যে এটা আরও গুরুতর আকার নেবে, গঙ্গা দিয়ে জল আর অতটা যাবে না।”

“তা ছাড়া ড্রেজিং-ফ্রেজিং তো অনেকদিন হয় না, কাজেই একমাত্র বন্যার মৌশুম ছাড়া অন্য সময় জলও আর আগের মতো যাচ্ছে না। আসল সমস্যা এগুলোই, সেদিকে দৃষ্টি না-দিয়ে আমরা ভারত বাংলাদেশকে জল দেবে কি দেবে না ইত্যাদি, সেই রাজনৈতিক দৃষ্টিতে দেখি। কিন্তু জল যে যাবে তার জন্য তো আগে নদীর গতিপথ, ড্রেজিং এগুলো ঠিক করতে হবে”, বলছেন আবু হাশেম খান চৌধুরী।

ফলে সাড়ে কুড়ি বছর মোটামুটি সফলভাবে বাস্তবায়নের পর গঙ্গা চুক্তি এখন কেন বাংলাদেশকে উদ্বেগে ফেলেছে সেটা বোঝা খুব কঠিন নয়।

কূটনৈতিক সূত্রে আভাস মিলেছে, ২০২৬-এ শুধু নতুন একটি চুক্তিই নয়, প্রয়োজনে গঙ্গা অববাহিকাতে যৌথভাবে ব্যারাজ বা জলাধার নির্মাণ করে দুদেশই যাতে তা ব্যবহার করতে পারে – ঢাকা তেমন প্রস্তাব দিতেও তৈরি! সূত্র: বিবিসি বাংলা