খরায় পুড়ছে রাজশাহী, নামছে পানির স্তর, ঝরছে আম

নিজেস্ব প্রতিবেদক:
বরেন্দ্র অঞ্চল বলে পরিচিত রাজশাহী যেন খরায় পুড়ছে। গত প্রায় চার মাস ধরে রাজশাহীতে বড় ধরনের বৃষ্টিপাত নাই। গত বর্ষাতেও তেমন বৃষ্টি না হওয়ায় খাল-বিল মাঠ-ঘাট অনেকটায় পানিশূন্য ছিল বলা যায়। এর মধ্যে সুষ্কমৌসুমেও গত এক মাসেরও বেশি সময় ধরে এক ফোটাও বৃষ্টিপাত হয়নি রাজশাহীতে। সর্বশেষ গত ২৫ ফেব্রুয়ারি মাত্র ৪ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে। এর পর গত মার্চ মাস গোটা গেছে বৃষ্টিহীন অবস্থায়। এই অবস্থায় রাজশাহীর প্রকৃতি চরম রুক্ষ হয়ে উঠেছে। বিলের মাটিগুলো ফেটে চৌচির হয়ে গেছে। বাড়ছে গরম। আর এর প্রভাব পড়েছে মৌমুমি ফল আমেও। টানা বৃষ্টিহীন থাকায় খরায় আমের মুকুল ব্যাপক হারে ঝরে পড়েছে। ফলে গাছে গুটি তেমন আসেনি। গতবারের চেয়ে এবার শতকরা ৩০-৪০ ভাগ আছে গাছে। অন্যদিকে ক্রমাগত হারে নামছে রাজশাহীতে পানির স্তর। ফলে অগভীর নলকূপগুলোতে বন্ধ হয়ে গেছে পানি ওঠা। কেবলমাত্র গভীর নলকূপেই উঠছে পানি। তাও কমে গেছে।

রাজশাহী আবহওয়া অফিসের ইনচার্জ আবু সাইদ বলেন, ’সর্বশেষ গত ২৫ ফেব্রুয়ারি রাজশাহীতে মাত্র ৪ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে। এর আগে বড় বৃষ্টি হয়েছে গত নভেম্বরে। ফলে গত চার মাস ধরে রাজশাহীতে বড় ধরনের বৃষ্টিপাত নাই। তবে আবহাওয়া পর্যবেক্ষণে জানা গেছে, আগামী দুই-একদিনের মধ্যে রাজশাহী বিভাগের কোথাও কোথাও দমকা ঝড়ো হাওয়াসহ হালকা বৃষ্টিপাত হতে পারে।’

শুষ্কতা বৃদ্ধির বিষয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক চৌধুরী সারওয়ার জাহান বলেন, দীর্ঘদিন থেকে বরেন্দ্র অঞ্চলের আবহাওয়া ও ভূ-প্রকৃতির উপর মানুষ অত্যাচার করে আসছে। হাজার বছর আগে বরেন্দ্র অঞ্চল সুন্দরবনের অংশ ছিল বলে বিভিন্ন বইতে বর্ণনা পাওয়া যায়। এরপর ধীরে ধীরে মানুষের সংখ্যা বেড়েছে। মানুষের চাহিদা মেটাতে বেড়েছে খাদ্য উৎপাদন। এই খাদ্য উৎপাদন করতে গিয়ে বনাঞ্চলের বৃক্ষাদি কেটে উজার করে চাষযোগ্য ভূমির পরিমাণ বাড়ানো হয়েছে। এসব জমিতে ফসল ফলাতে গিয়ে ভূগর্ভ থেকে বেশি বেশি পানি উত্তোলন করা হয়েছে এবং হচ্ছে। বরেন্দ্র অঞ্চলে বন্যা না হওয়ার কারণে বর্ষাকালেও ভূগর্ভস্থ পানি দিয়েই এখানকার চাষাবাদি জমি সেচ দিতে হয়। আবার ভূগর্ভস্থ সুপেয় পানি পান করার পাশাপাশি মাছ চাষের জন্যেও ব্যবহার করা হচ্ছে। এতে করে এই বরেন্দ্র অঞ্চলের ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ধীরে ধীরে অনেক নিচে নেমে গেছে। যার ফলে পানির প্রয়োজনীয়তা পূরণ না হওয়ায় এই অঞ্চলের শুষ্কতা দিন দিন বাড়ছে।

বরেন্দ্র অঞ্চলের পানির স্তর সম্পর্কে একই বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক সারওয়ার জাহান বলেন, ‘পানির স্তর সুনির্দিষ্ট করে বলা কঠিন। কারণ এখানকার গ্রাউন্ড ওয়াটার লেভেল একেক জায়গায় একেক রকম। মোটামুটিভাবে ১৬০ ফুট গভীর পর্যন্ত পানি পাওয়া যায়। তবে পানির স্তর প্রতিবছর এক ফুট করে নামছে। সেই হিসেবে এ বছরও এক ফুট নেমেছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে একসময় ভয়বাহ পানিসংকট দেখা দেবে বলে মনে করেন তিনি।’

বরেন্দ্র অঞ্চলে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিয়ে দীর্ঘদিন কাজ করছে গবেষণা সংস্থা ডাসকো ফাউন্ডেশন।
সমন্বিত পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনা প্রকল্পের আওতায় তানোরের মুণ্ডুমালা পৌরভবনের পাশেই ২০১৬ সালে তারা একটা পানি মাপার কূপ তৈরি করেছিলেন। কূপ বসানোর সময় সেখানে পানির স্তর ছিল ১০০ ফুট নিচে। গত বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে মাটির ১৫০ ফুট নিচে গিয়েও পানি পাওয়া যায়নি। এবার আরও বেড়েছে।

ডাসকো’র কর্মকর্তা জাহাঙ্গীর আলম জানান, এক যুগ আগেও রাজশাহী অঞ্চলে ৬০ থেকে ৭০ ফুট গভীরে পানি পাওয়া যেত। বর্তমানে কোথাও কোথাও ১৬০-১৮০ ফুট বা তারও নিচেও পানি পাওয়া যাচ্ছে না।

গবেষকরা বলছেন, কৃষি কাজের জন্য বরেন্দ্র এলাকায় অতিরিক্ত ভূগর্ভস্থ পানি তোলার কারণে পানির স্তর প্রতিবছর গড়ে এক ফুট নিচে নেমে যাচ্ছে। ১৯৮০ সালেও বরেন্দ্র অঞ্চলে পানির স্তর মাটির মাত্র ৩৯ ফুট নিচে ছিল। ২০১৬ সালে ১১৮ ফুট নিচে নেমে যায়। ১০০ থেকে ১৫০ ফুট নিচে পাতলা একটা পানির স্তর পাওয়া যাচ্ছে।

এদিকে দেশের গড় বৃষ্টিপাত ২ হাজার ৫০০ মিলিমিটার হলেও বরেন্দ্র অঞ্চলে সেটি মাত্র ১ হাজার ২০০ থেকে ১ হাজার ৩০০ মিলিমিটার। বৃষ্টিপাতে ভূগর্ভস্থ পানির গড় পুনর্ভরণের হার দেশে ২৫ শতাংশ হলেও এ অঞ্চলে মাত্র ৮ শতাংশ। ফলে বরেন্দ্র অঞ্চলের উঁচু এলাকাগুলোতে পানির সংকট ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে।

রাজশাহীর গোদাগাড়ীর কাঁকনহাট এলাকার বাসিন্দা আকবর আলী বলেন, ‘কোনো অগভীর নলূক’পে পানি পাওয়া যাচ্ছে না। বরেন্দর গভীর নলক’প থেকে পানি সংগ্রহ করে বাড়ির নানা কাজকর্ম করতে হচ্ছে। পানির কষ্টে ঠিক মতো গোসলও করতে পারছি না আমরা।’

এদিকে রাজশাহীর বাঘা এলাকার আমচাষি মহিবুল ইসলাম বলেন, ‘এবার এমনিতেই গাছে কম পরিমাণে মুকুল এসেছিল। কিন্তু খরার কারণে সেগুলোও ঝরে গেছে। কোনো কোনো গাছে শুধু আমের মুকলের শীষ খাড়া হয়ে আছে। গুটি ঝরে পড়েছে। ফলে এবার গতবারের চেয়ে বড় জোর ৪০ ভাগ আম আছে গাছে। পানির অভাবে মুকুল ঝরে পড়েছে।’

একই দাবি জানান, দুর্গাপুরের আম চাষি আমিনুল ইসলাম বলেন, ‘গাছে আমের গুটির পরিমাণ এবার খুবই কম। খরার কারণে মুকুল ঝরে গেছে। ফলে অনেক গাছে কোনো আমই নাই। এ কারণে এবার আমের উৎপাদন অনেক কম হবে।’

এদিকে রাজশাহী ফল গবেষণা কেন্দ্রের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. আব্দুল আলীম কালের জানান, এবার রাজশাহীতে ১৮ হাজার ৫১৫ হেক্টর জমিতে আম চাষ হয়েছে। যা গতবার ছিল ১৭ হাজার ৯৪৩ হেক্টর জমিতে। গত বছর উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল ২ লাখ ১৪ হাজার ৪৮৩ মেট্রিক টন। সে লক্ষ্যমাত্রাও ছাড়িয়ে গিয়েছিল। ফলে এবার ৫৮২ হেক্টর জমিতে আম চাষ বেশি হওয়ায় গত বারের চেয়ে উৎপাদন ছাড়িয়ে যাওয়ার আশা করা হয়েছিল। তবে খরার কারণে এবার আমের ফলনে ঘাটতি দেখা দিতে পারে।