ক্ষমতার দ্বন্দ্ব-সংঘাতে সমাজ ও রাজনীতি

ইউপি দ্বিতীয় পর্ব নির্বাচন শেষ হওয়ার পর সরকার থেকে বলা হয়েছিল যে তৃতীয় পর্বের নির্বাচনে যাতে দ্বিতীয় পর্বের মতো হানাহানি, খুনাখুনি ও সংঘাত-সংঘর্ষ না ঘটে সে ব্যাপারে দল এবং আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীকে কঠোর নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। বিশেষত দলীয় মনোনয়ন নিয়ে প্রার্থীদের মধ্যে বিরোধ এবং দলের বিদ্রোহী প্রার্থী যাতে কেউ না হতে পারে সে ব্যাপারে দৃষ্টি দেওয়ার জন্য তৃণমূলে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এই আশ্বাস শোনার পর অনেকেই আশ্বস্ত হয়েছিলেন যে ওপরের কঠোর বার্তা সর্বত্র চলে গেছে এবং এ ব্যাপারে সতর্কতা ও সংযম প্রদর্শন অনেকে হয়তো করবেন। তা ছাড়া গত ১৯ তারিখ শুক্রবার আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী পরিষদে ইউপি নির্বাচনে মনোনয়ন, দলীয় মনোনীত প্রার্থী, বিদ্রোহী ও স্বতন্ত্র প্রার্থী নিয়ে যে অনাকাঙ্ক্ষিত পরিবেশ ইউপি নির্বাচনে কোথাও কোথাও তৈরি হয়েছে, সে ব্যাপারে কঠোর নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এই নির্দেশনা দলের স্থানীয় পর্যায়ের নেতাকর্মীরা মেনে চলবেন বলেই অনেকে আশা করেছিলেন। কিন্তু আগামী ২৮ নভেম্বর তৃতীয় পর্বের ইউপি নির্বাচনকে কেন্দ্র করে এরই মধ্যে বেশ কয়েক জায়গায় দ্বন্দ্ব-সংঘাত ও হানাহানির ঘটনা সংঘটিত হয়েছে। মুন্সীগঞ্জে আওয়ামী লীগের দুই পক্ষের সংঘর্ষে একজন নিহত, ১৫ জন আহত হয়েছে। এর মধ্যে ১০ জন গুলিবিদ্ধ হয়েছে। নৌকা প্রার্থী ও সমর্থকদের ওপর বিদ্রোহী স্বতন্ত্র প্রার্থীর সমর্থকরা ককটেল ও গুলিবর্ষণ করে। ৫০-এর অধিক বাড়িঘরে হামলা ও ভাঙচুর চালানো হয়। নারী ও শিশুরা আত্মরক্ষার্থে বাড়ি থেকে পালিয়ে যান। হামলা ও সংঘর্ষে আহতের ঘটনা ঘটেছে কুমিল্লার বরুড়া উপজেলা, শেরপুরের নালিতাবাড়ী, সাতক্ষীরার কালীগঞ্জে, ফরিদপুরের ভাঙ্গায়, পাবনার সাঁথিয়ায়, নেত্রকোনার কলমাকান্দায় প্রভৃতি এলাকায়। প্রতিদিনই সংঘর্ষের ঘটনা বাড়ছে। এতে দলের অভ্যন্তরেই একে অপরকে ঘায়েল করার জন্য সমর্থকদের ব্যবহার করছে, প্রতিপক্ষের ওপর হামলা করতে গিয়ে নিজ দলের কর্মী-সমর্থকদের হত্যা করতেও কেউ কেউ দ্বিধা করছে না। মূলত ইউপি নির্বাচনে মেম্বার কিংবা চেয়ারম্যান পদে অধিষ্ঠিত হওয়া, না হওয়ার বিষয়টি দলের অভ্যন্তরেই কতটা হিংসাত্মক রূপ ধারণ করছে, সেটি এসব সংঘাত, সংঘর্ষ ও হানাহানির মধ্যে লক্ষ করা যাচ্ছে। এখানে দল ও রাজনীতি নয়, ব্যক্তিগতভাবে ক্ষমতা লাভ করাই হচ্ছে মূল বিষয়। যিনি ক্ষমতা লাভের ক্ষেত্রে ইচ্ছাপূরণ নিয়ে সন্দিহান হয়ে পড়েন, তিনি নিজের ক্ষমতালিপ্সাকে বাস্তবায়িত করতে প্রতিপক্ষকে দেখে নেওয়ার জন্য হামলা, সংঘাত ও সংঘর্ষে লিপ্ত হতেও দ্বিধা করেন না। বিষয়টি এখন সমাজের বিভিন্ন স্তরে যেভাবে বিস্তার লাভ করছে তা কোনোভাবেই যেন দলীয় নির্দেশ, দেশের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর উপস্থিতিতে মোটেও বিবেচনায় নেওয়া হচ্ছে না। উচ্ছৃঙ্খলতা ও বেপরোয়া মনোভাব স্থানীয় নেতাকর্মীদের মধ্যে কতটা বিরাজ করছে সেটি এসব ঘটনার বহিঃপ্রকাশ থেকে স্পষ্ট হয়ে উঠছে। এর ফলে আওয়ামী লীগের স্থানীয় পর্যায়ের দলীয় কর্মকাণ্ডে দলীয় শৃঙ্খলা কতটা নড়বড়ে ও দুর্বল অবস্থায় রয়েছে তা-ও স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। দলের তৃণমূল পর্যায়ে শৃঙ্খলা, আদর্শের চর্চা নেতাকর্মীদের মধ্যে জারি থাকলে দলের যেকোনো ধরনের মনোনয়ন অনেক বেশিসংখ্যক নেতাকর্মীর সমর্থন নিয়েই ঘটত, তাতে দলাদলি, বিরোধ এবং সংঘাতের পরিস্থিতিতে জড়িয়ে পড়ার মনোভাব দলীয় পরিচয়ের কর্মীদের মধ্যে খুব একটা সমর্থন পেত বলে মনে হয় না। সম্ভবত এখানেই সমস্যার বীজ লুকিয়ে থাকে, যা মনোনয়ন দেওয়ার পর কোথাও কোথাও বিস্ফোরিত হয়।  দলকে ব্যবহার করে অনেকেই ক্ষমতা লাভের জন্য এভাবে দলবল-সমর্থক নিয়ে প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে হামলা, সংঘাত, সংঘর্ষে লিপ্ত হতে দ্বিধা করে না। তারা দলকে কিংবা দলের নির্দেশনাকে উপেক্ষা করতেও দ্বিধা করে না। বেপরোয়া এই মনোভাবের পেছনে রাজনৈতিক আদর্শের চেয়ে ক্ষমতা লাভের মাধ্যমে ব্যক্তিগতভাবে রাজনীতি ও ক্ষমতার সিঁড়িতে ওঠাই এদের প্রধান লক্ষ্য থাকে। তাতে সামান্যতম ছাড় দিতে তারা রাজি নয়। সে কারণেই দলের এত সব নির্দেশনা উপেক্ষা করেই স্থানীয় পর্যায়ে ইউপি নির্বাচনে সংঘাত, সংঘর্ষ কোনোভাবেই কমানো যাচ্ছে না। এর ফলে আওয়ামী লীগ দলগতভাবেই শুধু ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে না, দেশের ভবিষ্যৎ রাজনীতি নিয়েও সচেতন মহলের মধ্যে হতাশা তৈরি হচ্ছে।

ক্ষমতার স্বার্থ নিয়ে দলের অভ্যন্তরে বিরোধ, সংঘাত, সংঘর্ষ শুধু গ্রামাঞ্চলেই নয়, শহরেও এখন ভেতরে ভেতরে তীব্রতর হচ্ছে। দলের ভেতরে ক্ষমতালিপ্সু অনেক ব্যক্তি ও গোষ্ঠী নিজের প্রভাব বিস্তার, সম্পদ অর্জন, দুর্নীতি, ব্যবসা-বাণিজ্য দখল, ভূমিদস্যুতা, চাঁদাবাজি ইত্যাদি যেভাবে বিস্তার লাভ করছে তাতে নানা অপশক্তি এর মধ্যে জড়িয়ে পড়েছে। এরাই নিজেদের স্বার্থে একে অপরের বিরুদ্ধে হত্যাকাণ্ডের মতো ঘটনা ঘটাতেও ভয় পায় না। গত সোমবার ২২ তারিখ বিকেলে কুমিল্লায় ১৭ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলরের ব্যক্তিগত কার্যালয়ে একদল মুখোশধারী দুর্বৃত্ত আকস্মিকভাবে অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে প্রবেশ করে। তারা ওয়ার্ড কাউন্সিলর মোহাম্মদ সোহেলের ওপর বেপরোয়া গুলি চালায়। তাঁর মাথায় দুটি, বুকে দুটি, পেটে ও শরীরের বিভিন্ন স্থানে চারটি গুলি লাগে। তাঁর সহযোগী হরিপদ সাহাসহ মোট পাঁচজন সন্ত্রাসীর দ্বারা আহত হলে তাঁদের কুমিল্লা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে ৫২ বছর বয়সী কাউন্সিলর মোহাম্মদ সোহেল এবং ৩৫ বছর বয়সী হরিপদ সাহা মৃত্যুবরণ করেন। এই হত্যাকাণ্ডের মূল লক্ষ্য ছিল কাউন্সিলর মোহাম্মদ সোহেলকে হত্যা করা। তিনি ২০১২ ও ২০১৭ সালে কাউন্সিলর ছিলেন। তিনি কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের দ্বিতীয় মেয়াদে প্যানেল মেয়র হিসেবে ছিলেন। তিনি ১৩ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতিও ছিলেন। এই হত্যাকাণ্ডের পেছনে দলীয় অন্য কোনো ভবিষ্যৎ প্রার্থীচ্ছুর কোনো উদ্দেশ্য জড়িত আছে কি না কিংবা কুমিল্লার সাম্প্রতিক সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টের চেষ্টায় গোপনে লিপ্ত থাকা কোনো অপশক্তির কূটকৌশল হতে পারে কি না কিংবা ব্যক্তিগত বা স্বার্থগত কোনো বিরোধ এর সঙ্গে জড়িত আছে কি না তার রহস্য আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী উদঘাটন করতে পারে। তবে কুমিল্লায় গত চার বছরে সিটি করপোরেশনে তিনজন কাউন্সিলর সন্ত্রাসীদের গুলিতে নিহত হয়েছেন। বর্তমান হত্যাকাণ্ডটিও তাদেরই একই সন্ত্রাসীদের সংঘটিত হত্যাকাণ্ড কি না সেটি জানা খুব জরুরি। বাংলাদেশের অন্য কোনো সিটি করপোরেশনে এ ধরনের ঘটনার নজির বোধ হয় নেই। চারজন কাউন্সিলর পর পর হত্যাকাণ্ডের শিকার হওয়া খুবই উৎকণ্ঠার বিষয়। কুমিল্লার অতীত ঐতিহ্যের সঙ্গে এটি খুব বেশি যায় না। কুমিল্লাকে সব সময়ই শিক্ষা, সংস্কৃতি এবং শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের নগরী হিসেবে অভিহিত করা হয়ে থাকে। কিন্তু রাজনৈতিক বিরোধ গত দুই-তিন দশক ধরে বড় দুই দলেই কমবেশি ঘটতে দেখা গেছে। আওয়ামী লীগে ব্যক্তিত্বের দ্বন্দ্বের কারণে দলীয় প্রার্থীর পরাজয় নির্বাচনে অনেকবারই ঘটেছে। এমনকি মেয়র পদেও আওয়ামী লীগের প্রতিদ্বন্দ্বী গ্রুপের বিরোধের সুযোগ নিয়ে বিএনপির প্রার্থী সহজে বিজয় লাভ করেন বলে অভিযোগ আছে। সম্প্রতি কুমিল্লা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও বর্ষীয়ান নেতা অধ্যক্ষ আফজাল খান মৃত্যুবরণ করেছেন। তাঁর প্রতিপক্ষ গ্রুপের নেতৃত্ব দিচ্ছেন বাহার উদ্দিন এমপি। তিনি কুমিল্লা মহানগর আওয়ামী লীগের সাবেক প্রতিষ্ঠাতাসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে ছিলেন। কুমিল্লার রাজনীতিতে তাঁর ব্যাপক প্রভাব রয়েছে। তিনিও এখন একজন বর্ষীয়ান নেতা হিসেবে পরিচিত। কুমিল্লার রাজনীতিতে আরো অনেক রাজনীতিবিদ ছিলেন এবং এখনো জীবিত আছেন। কিন্তু তাঁদের অনেকের নামই এখন আর শোনা যায় না। তারা কি নিষ্ক্রিয় হয়ে গেছেন? তাদের নিষ্ক্রিয়তার সুযোগ নিয়েই কি কুমিল্লায় এসব হানাহানি ঘটার সুযোগ পেয়েছে? আগামী বছর কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। সে উপলক্ষেই এই হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে কি না, হলেও কারা করতে পারে সেটিও হয়তো আলোচনায় আসবে।

একদিকে ইউপি নির্বাচন, অন্যদিকে জাতীয় রাজনীতিতে নানা উত্তেজনা। আবার ভেতরে ভেতরে সাম্প্রদায়িকতা, ব্যক্তিগত বিরোধ, ক্ষমতা ও স্বার্থের দ্বন্দ্ব এবং রাজনীতিতে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করার জন্য একে অপরের বিরুদ্ধে যেভাবে সমর্থক, ভাড়াটে গুণ্ডা ও ঘাতকদের ব্যবহার করা হচ্ছে তা আমাদের সমাজব্যবস্থার ভেতরে অস্থিরতা, বৈষম্য, বিরোধ এবং রাজনীতির দ্বন্দ্ব-সংঘাত ও আদর্শহীনতাকেই বাড়িয়ে দিতে পারে। সে কারণে সরকারকে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর পাশাপাশি রাজনৈতিক দলের মধ্যে শৃঙ্খলা, আদর্শবোধ এবং সচেতন নেতাকর্মী সৃষ্টির গুরুত্বকে কোনো অবস্থায়ই অবহেলা করা উচিত হবে না।

লেখক : অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক
বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়

 

সুত্রঃ কালের কণ্ঠ