ক্ষমতাই ঘুষের ফাঁদ

সিল্কসিটিনিউজ ডেস্ক:

শুল্ক ফাঁকি দেয়া আমদানিকারক ও সিএন্ডএফ এজেন্টদের ধরতে মাঠে নামছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। গত এক মাসে মিথ্যা ঘোষণায় পণ্য আমদানির মাধ্যমে শুল্ক ফাঁকি ও অর্থ পাচারে জড়িতদের তালিকা চেয়ে দুদক সম্প্রতি জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে (এনবিআর) চিঠি দিয়েছে।

এনবিআরের তালিকার ভিত্তিতে ওইসব ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের সম্পদ অনুসন্ধান করা হবে। অবশ্য কাস্টমসের সংস্কার ও অসৎ কর্মকর্তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে না পারলে শুল্ক ফাঁকি বন্ধ করা সম্ভব নয় বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদ ও সাবেক কাস্টমস কর্মকর্তারা।

বিশেষজ্ঞদের মতে, ক্ষমতাকে ঘুষের ফাঁদ হিসেবে ব্যবহার করছে কাস্টমসের অসাধু কর্মকর্তারা। কাজেই শুল্ক ফাঁকির দায়ে শুধু আমদানিকারক ও সিএন্ডএফ এজেন্টদের শাস্তির আওতায় আনলে হবে না। সবার আগে অসৎ কাস্টমস কর্মকর্তাদের ব্যাপারে দুদককে সোচ্চার হতে হবে। কারণ ব্যবসায়ীদের একার পক্ষে কখনই শুল্ক ফাঁকি দেয়া সম্ভব নয়।

অসৎ কর্মকর্তারা ঘুষের বিনিময়ে উচ্চ শুল্কের পণ্যকে নিু শুল্কে খালাসে সহযোগিতা করে। এক্ষেত্রে প্রকারান্তরে তারা শুল্ক ফাঁকি দেয়াকে উৎসাহিত করছে। আর যারা ঘুষ দিতে চায় না, তাদের পণ্যে মনগড়া শুল্কায়ন করে। অহেতুক পণ্য খালাসে বিলম্ব ঘটায়। এতে পোর্ট ডেমারেজসহ সৎ ব্যবসায়ীরা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হন।

এ অবস্থা থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য অসাধু কর্মকর্তাদের অনৈতিক দাবি মেনে নিতে বাধ্য হন। সম্প্রতি কাস্টমসে ঘুষ নেয়ার সময় হাতেনাতে কয়েক কর্মকর্তাকে আটকও করে দুদক। তারা বলেন, এ অভিযান অব্যাহত রাখতে হবে।

পাশাপাশি অসৎ কর্মকর্তাদের কাস্টমসে পোস্টিং দেয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। এছাড়া খোদ দুদক চেয়ারম্যান সম্প্রতি চট্টগ্রামে এক আলোচনা সভায় বলেছেন, ঘুষ দাতা ও গ্রহীতা কেউ রেহাই পাবে না। আমরা বাস্তবে তার প্রমাণ দেখতে চাই।

প্রসঙ্গত, ১০ জানুয়ারি ঘুষের টাকাসহ চট্টগ্রাম কাস্টমসের নাজিম উদ্দিন নামে এক রাজস্ব কর্মকর্তাকে হাতেনাতে আটক করে দুদক। সমুদ্রগামী জাহাজের ছাড়পত্র প্রদানে ঘুষ বাণিজ্যের বিষয়ে দুদকের অভিযোগ কেন্দ্রে (হটলাইন ১০৬) ফোন দেয় ভুক্তভোগী জাহাজ কোম্পানির প্রতিনিধিরা। এর পরিপ্রেক্ষিতে তাকে আটক করা হয়। এরপর কাস্টমস কর্মকর্তা ও তাদের স্ত্রীদের সম্পদের অনুসন্ধান শুরু করে দুদক।

এ বিষয়ে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান  বলেন, সদিচ্ছা থাকলে দুদকের পক্ষে শুল্ক ফাঁকির প্রবণতা কমিয়ে আনা সম্ভব। তবে এনবিআর এক্ষেত্রে দুদককে শুধু তথ্য দিয়ে নয়, পারস্পরিক সহযোগিতাও করতে হবে। কারণ ব্যবসায়ীদের একার পক্ষে শুল্ক ফাঁকি দেয়া সম্ভব না। অসৎ কর্মকর্তারা অনৈতিক সুবিধা নিয়ে শুল্ক ফাঁকিতে সহায়তা করেন।

তিনি আরও বলেন, শুল্ক ফাঁকি রোধ করতে চাইলে প্রথমত এনবিআরকে তাদের কর্মীদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির প্রমাণ সাপেক্ষে বিভাগীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। দ্বিতীয়ত, দুদক সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে অসৎ কর্মকর্তাদের দেশের প্রচলিত আইনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির আওতায় আনবে। কাস্টমস কর্মকর্তাদের নিয়মিত মনিটরিং করতে পারলে শুল্ক ফাঁকি অনেকাংশেই হ্রাস করা সম্ভব বলে মনে করেন তিনি।

গত ৬ ফেব্রুয়ারি এনবিআরে চিঠি পাঠিয়ে দুদক জানুয়ারি মাসে মিথ্যা ঘোষণায় পণ্য আমদানিতে জড়িত সিএন্ডএফ এজেন্ট ও আমদানিকারকের তথ্য চেয়েছে। চিঠিতে মিথ্যা ঘোষণায় রাজস্ব ফাঁকির যেসব ঘটনা এনবিআর উদঘাটন করে জরিমানা আদায় করেছে, সেসব আমদানি-রফতানিকারকের বিস্তারিত তথ্য পাঠাতে বলা হয়েছে।

দুদক সচিব স্বাক্ষরিত চিঠিতে বলা হয়েছে, ‘আমদানির ক্ষেত্রে বিদেশি প্রতিষ্ঠান বা বিক্রেতা থেকে মালামালের প্রকৃত মূল্যের চেয়ে ইনভয়েসে কোনো কোনো ক্ষেত্রে অধিক মূল্য দেখিয়ে এলসির মাধ্যমে কতিপয় অসাধু ক্রেতা বিক্রেতার ব্যাংকের মালামালের মূল্য পরিশোধের মাধ্যমে টাকা পাচার বা মানি লন্ডারিং করে থাকে। রফতানির ক্ষেত্রে ওভার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে মালামাল রফতানি করে ইনভয়েসে মালামালের প্রকৃত মূল্যের চেয়ে অধিক মূল্য দেখিয়ে কতিপয় অসাধু ব্যবসায়ী কালো টাকা সাদা করে।’

কেমন তথ্য পাঠাতে হবে- চিঠিতে দুদক তার বিবরণও দিয়েছে। এতে বলা হয়েছে, আমদানি করা পণ্য বন্দরে আসার পর কাস্টমস কর্তৃপক্ষ মালামাল খালাসের আগে সোর্স বা অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে ও দ্বৈবচয়নের মাধ্যমে বিভিন্ন চালানের পণ্য যাচাই করে। এতে কী পরিমাণ পণ্য আমদানি করা হয়েছে তার পরিমাণসহ বিল অব এন্ট্রি, ইনভয়েস যাচাই করে মিথ্যা ঘোষণা বা রাজস্ব ফাঁকির ঘটনা উদঘাটন করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা (যেমন আমদানিকারকের বিরুদ্ধে রাজস্ব ফাঁকির জন্য জরিমানা, মামলা দায়ের, লাইসেন্স বাতিল করে সিএন্ডএফ এজেন্টকে কালো তালিকাভুক্ত করা) হয়। এ ধরনের ফাঁকিবাজদের তালিকা পাঠাতে বলা হয়েছে।

২৭ জানুয়ারি চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে বিভাগীয় পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে মতবিনিময় সভায় দুদক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ কাস্টমস বিভাগের কর্মকর্তাদের উদ্দেশে বলেন, ওভার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে বিদেশে বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচার হয়। এটা বন্ধ করতে হবে। হুন্ডির মাধ্যমে অর্থ পাচার হয়। তবে কাস্টমসের মাধ্যমে যে বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচার হয়ে যায় তা ধরা পড়ে না। কখনও কখনও ধরা পড়লেও জরিমানার মাধ্যমে বিষয়টি নিষ্পত্তি করা হয়। কিন্তু পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আসে না।

ফেব্রুয়ারি মাসের ওভার-ইনভয়েসের তালিকা ১ মার্চের মধ্যে দুদকের কাছে জমা দেয়ার অনুরোধ জানিয়ে তিনি বলেন, এসব ইনভয়েস দুদক পরীক্ষা করে দেখবে। কারা ওভার ইনভয়েসের সঙ্গে জড়িত তাদের চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেয়া হবে।

প্রসঙ্গত, সম্প্রতি অনুসন্ধান চালিয়ে সিএন্ডএফ এজেন্টদের একটি জালিয়াতচক্রের খোঁজ পেয়েছে শুল্ক গোয়েন্দা। এ চক্রটি কাস্টমসের অবসরপ্রাপ্ত ও বদলি হওয়া কর্মকর্তাদের ‘অ্যাসাইকুডা ওয়ার্ল্ডের’ ইউজার আইডি ব্যবহার করে কাস্টমসের সার্ভারে প্রবেশ করে পণ্য খালাস করে নিত। এ ধরনের ৭ সিএন্ডএফ প্রতিষ্ঠানকে শনাক্ত করে শুল্ক গোয়েন্দা।

জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত থাকায় ১৬ জানুয়ারি এমআর ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল, চাকলাদার সার্ভিসের বিরুদ্ধে রাজধানীর রমনা থাকায় মামলা দায়ের করে শুল্ক গোয়েন্দা। পরে এমআর ট্রেড ইন্টারন্যাশনালের স্বত্বাধিকারী মিজানুর রহমান চাকলাদারকে কাকরাইল থেকে আটক করে পুলিশে সোপর্দ করা হয়।

দুদক সূত্র জানায়, কাস্টমসের অসাধু কর্মকর্তারা ব্যবসায়ীদের অনৈতিক সুবিধা দিয়ে নিজেরা ফুলেফেঁপে উঠছেন। এতে একদিকে সরকার রাজস্ব হারাচ্ছে, অন্যদিকে সবার নাকের ডগা দিয়ে বিদেশে টাকা পাচার হয়ে যাচ্ছে। পাচার রোধ করতে ও সরকারের রাজস্ব আদায়ে কাস্টমস কর্মকর্তাদের পাশাপাশি অসাধু আমদানিকারক ও সিএন্ডএফ এজেন্টদের মনিটরিং করার অংশ হিসেবে এনবিআরে তথ্য চাওয়া হয়েছে। তথ্য পাওয়ার পর সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের সম্পদ অর্জনের প্রকৃতি যাচাই-বাছাই করা হবে।

অবশ্য তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও অর্থনীতিবিদ এবি মির্জা আজিজুল ইসলাম মনে করেন, শুল্ক ফাঁকি বন্ধ করতে সবার আগে চিহ্নিত শুল্ক ফাঁকিবাজদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির পাশাপাশি কাস্টমস পলিসিতে পরিবর্তন আনতে হবে।

তিনি বলেন, বাংলাদেশে আমদানি পণ্যের শুল্ক হার বেশি। এ কারণে ফাঁকির প্রবণতাও বেশি। শুধু তাই নয়, অতিরিক্ত শুল্কের কারণে ভোক্তা পর্যায়ে অনেক পণ্যের দাম বৃদ্ধি পায়। তাই অর্থনীতির বিভিন্ন লক্ষ্য সামনে রেখে পণ্যের শুল্ক হার নির্ধারণে গবেষণা করা উচিত।

অন্যদিকে এনবিআরের সাবেক সদস্য ফরিদ উদ্দিন মনে করেন, কাস্টমসে সংস্কার করতে না পারলে শুল্ক ফাঁকি, অনিয়ম-দুর্নীতি কোনোদিনই বন্ধ করা সম্ভব নয়।

তিনি বলেন, গত ১০ বছরের বেশি সময় ধরে কাস্টমসের সংস্কার নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। বিশ্বব্যাংক ও এডিবির সহায়তায় কিছু ক্ষেত্রে আংশিক সংস্কার হয়েছে। তবে আংশিক সংস্কার দিয়ে শুল্ক ফাঁকি সম্ভব নয়। এজন্য কাস্টমস টু কাস্টমস সহযোগিতা বৃদ্ধি করতে হবে। অর্থাৎ যে দেশ থেকে পণ্য আমদানি হচ্ছে, শুল্কায়নের সময় কর্মকর্তাদের সন্দেহ হলে সে দেশের কাস্টমসের সঙ্গে যোগাযোগ করে তথ্য আদান-প্রদানের ব্যবস্থা চালু করতে হবে। এছাড়া সরকারের অন্য দফতর যেমন বিডা, বেজা, বেপজা, শিল্প মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে কাস্টমসের যোগাযোগ বাড়াতে হবে। এক্ষেত্রে ব্যবসায়ীদের সহায়তাও নেয়া যায়। ব্যবসায়ী সংগঠনগুলোর সঙ্গে এমওইউ করতে হবে। এর আওতায় যাতে শুল্ক ফাঁকিবাজ চিহ্নিত করার পর ওই ব্যবসায়ী সংগঠন যাতে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয় তা নিশ্চিত করতে হবে।

তিনি আরও বলেন, আরেকটি বড় সমস্যা হচ্ছে বন্দর ও কাস্টমসের মধ্যে সমন্বয় বাড়াতে হবে। বর্তমানে কাস্টমস চলে এক নিয়মে। বন্দর ও প্রাইভেট আইসিডি চলে অন্য নিয়মে। এছাড়া বন্দরে অত্যাধুনিক স্ক্যানার বসাতে হবে। এখন যে স্ক্যানারগুলো আছে তা ২০০৮ সালের পুরনো। নতুন অত্যাধুনিক স্ক্যানার বসিয়ে অ্যাসাইকুডা ওয়ার্ল্ড সিস্টেমের সঙ্গে যুক্ত করতে হবে। এসব সংস্কার করতে সরকারের খুব বেশি বিনিয়োগ করতে হবে না। শুধু সদিচ্ছা থাকলেই কাস্টমসের সংস্কার করে ২ বছরের মধ্যে শুল্ক ফাঁকির প্রবণতা অনেকাংশে হ্রাস করা সম্ভব। পাশাপাশি কাস্টমস কর্মকর্তাদের তালিকা করে অসৎ কর্মকর্তাদের কাস্টমসে পোস্টিং দেয়া থেকে বিরত থাকতে হবে।