কোরবানির পশুর চামড়াই দেখিয়েছিল পেঁয়াজের ভবিষ্যৎ

ভারত পেঁয়াজ রফতানি বন্ধের সিদ্ধান্ত নেয়ার পরিপ্রেক্ষিতে পেঁয়াজের দাম এক রাতেই ৩৩ শতাংশ বেড়ে যাওয়ার পর মনে পড়ল কিছুদিন আগের কোরবানির ঈদের কথা। মনে পড়ল সেখানে দাঁড়িয়ে সামনের দিকে ভালো করে তাকালেই পেঁয়াজ নিয়ে কী ঘটতে পারে সেটা দেখা যেত। সে প্রসঙ্গে আসছি একটু পরে।

 

পেঁয়াজের মূল্য গত বছর ট্রিপল সেঞ্চুরি করেছিল। এবার কি সেটি হবে? এ দেশে জনগণ তার প্রাপ্য অধিকারটুকু রাষ্ট্রের কাছে পাক বা না পাক, একটা জিনিস প্রচুর পায়- আশ্বাস। প্রচুর পরিমাণে আশ্বাস আমরা এ ক্ষেত্রেও পাচ্ছি- বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে বলা হয়েছে, গতবারের মতো খারাপ পরিস্থিতি হবে না। এর মানে আমরা এখন এমন একটি দেশে বাস করি যেখানে নাগরিক হিসেবে আমাদের খুশি থাকতে হবে, পরিস্থিতি গতবারের চেয়ে কম খারাপ হবে এটি ভেবে। কিন্তু সেটুকু আশ্বস্ত হওয়াও কি সম্ভব আমাদের পক্ষে?

এবার ভারত পেঁয়াজ রফতানি বন্ধ করে দেয়ার পর থেকেই সরকার কূটনৈতিক চ্যানেলে পেঁয়াজ পাওয়ার চেষ্টা করেছে এবং কিছু সাফল্য দেখা গিয়েছে বলে মনে হয়েছিল। ভারত সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল ২৫ হাজার টন পেঁয়াজ রফতানি করবে। বিভিন্ন স্থলবন্দরে ট্রাকে প্রায় ২৫ হাজার টন পেঁয়াজ আটকে ছিল। আসলে ট্রাকে থাকা এ পেঁয়াজ পচতে শুরু করায় এটুকু রফতানি করার অনুমতি দেয়া ছাড়া উপায় ছিল না। আটকে থাকা পেঁয়াজ বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে এবং এরপর আবার পেঁয়াজ রফতানি বন্ধ করা হয়েছে। এটিও আমরা দেখতে পাচ্ছি, এ পেঁয়াজের বড় অংশ পচে গেছে, যার জন্য আমাদের ব্যবসায়ীরা আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েছেন।

মিডিয়ায় খবর এসেছিল, ভারতীয় পেঁয়াজ প্রবেশের খবরে দেশে পেঁয়াজের দাম কিছুটা কমেছে। কিন্তু এ সামান্য পেঁয়াজ দীর্ঘমেয়াদে পেঁয়াজের দামকে স্থিতিশীল করবে না। এ দেশে প্রতিদিন পেঁয়াজের চাহিদা সাত হাজার টন, তাই ভারত থেকে আসা পেঁয়াজ পচা না হলেও চাহিদা মেটাতো সাড়ে তিন দিনের। অর্থাৎ পেঁয়াজের সংকট সমাধানের পথে এর কোনো ভূমিকা থাকত না। অর্থাৎ এ বছরও আমরা আরেকটি পেঁয়াজ সংকটে লম্বা সময়ের জন্য ভুগতে যাচ্ছি।

হতেই পারে এবার সংকটের তীব্রতা গত বছরের চেয়ে কিছুটা কম হবে। কিন্তু আমরা যদি করোনা মহামারীকে বিবেচনায় রাখি, তাহলে আমরা জানব এ মহামারী সমাজের প্রত্যেক মানুষের উপার্জনে প্রচণ্ড রকম খারাপ প্রভাব ফেলেছে। তাই এবার সংকট গতবারের চেয়ে কিছু কম হলেও তার প্রভাব মানুষের ওপর আরও অনেক বেশি করে পড়বে।

প্রভাবটা কেমন হতে যাচ্ছে তার একটি প্রাথমিক ধারণা আমাদের যুগান্তরই দিয়েছে। ১৮ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত এক রিপোর্টে এ পত্রিকাটি আমাদের জানায়, সেপ্টেম্বর মাসের শুরুর দিন থেকে রিপোর্টের দিন পর্যন্ত ১৮ দিনে ৪০ টাকা কেজির পেঁয়াজের দাম বেড়ে সর্বোচ্চ উঠেছে ১২০ টাকায়। আগে আমদানি করা পেঁয়াজের দাম ধাপে ধাপে বাড়িয়ে এবং ভারত রফতানি বন্ধ করার পর দ্রুত বাড়িয়ে ওই কয়েকদিনেই মানুষের কাছ থেকে লোপাট করা হয়েছে কমপক্ষে ৪২৪ কোটি টাকা।

এ প্রসঙ্গে আমরা জেনে রাখব, কনসাস কনজুমার্স সোসাইটি (সিসিএস) নামের একটি সংগঠন গত বছরের পেঁয়াজ সংকটের সময় ২ নভেম্বর হিসাব করে দেখিয়েছিল, এর আগের তিন মাসে পেঁয়াজ নিয়ে কারসাজি করে, কম মূল্যে আমদানি করা পেঁয়াজ অনেক বেশি মূল্যে বিক্রি করে জনগণের পকেট থেকে ৩ হাজার ১৭৯ কোটি টাকা লোপাট করা হয়েছে। এ হিসাব করা হয়েছিল যখন, তখন পেঁয়াজের দাম ১৫০ টাকার আশপাশে। এ পেঁয়াজের মূল্য তারপর ৩০০ টাকায় উঠেছিল। তাই অনুমান করে নেই সাকুল্যে জনগণের পকেট কতটা কাটা হয়েছিল।

গত বছরের পেঁয়াজের সংকট কীভাবে এত বড় হল তা নিয়ে আলোচনার আগে গত বছর কী ঘটেছিল, সেটি একটু দেখে নেয়া যাক। আগস্টের মাঝামাঝি ভারতের পত্রিকায় খবর বেরিয়েছিল, পেঁয়াজের দাম গত এক বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে। আর সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহে পেঁয়াজের দাম চার বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ে গেছে। এরপর ১৩ সেপ্টেম্বর প্রতি টন পেঁয়াজের রফতানি মূল্য ৮৫০ ডলারে বেঁধে দেয় ভারত সরকার। এর কিছুদিন পর, ২৯ সেপ্টেম্বর ভারত পেঁয়াজ রফতানি পুরোপুরি বন্ধ করে দেয়। এ পুরো প্রক্রিয়ায় আমাদের দেশের বাণিজ্য মন্ত্রণালয় কোনোরকম প্রস্তুতি নেয়নি।

২০১৭ ও ২০১৮ সালে কোরবানির চামড়ার মূল্য ধারাবাহিকভাবে নেমে যাচ্ছিল কারসাজির কারণে। এ পতন ২০১৯ সালে এসে এক ভয়ংকর আকার নেয়। পতনের আগেই সেটি অনুমান করা যাচ্ছিল। সেই বছরই কোরবানির চামড়ার দাম এতটাই পড়ে যায় যে, বিক্রি করতে না পেরে লাখ লাখ চামড়া মাটিচাপা দিয়েছিল মানুষ। আগের দুই বছরের অভিজ্ঞতাকে বিবেচনায় নিয়ে গত বছরই উচিত ছিল কাঁচা ও ওয়েট ব্লু চামড়া রফতানির সিদ্ধান্ত নেয়া; কিন্তু সেটি হয়নি। হয়েছে আরও অবিশ্বাস্য ঘটনা।

গত বছর চামড়ার দামের চরম বিপর্যয়ের পর এ বছরেও অবিশ্বাস্যভাবে রফতানির ব্যাপারে একটা স্রেফ আইওয়াশ দেয়া হয়েছিল- কাঁচা ও ওয়েট ব্লু চামড়া রফতানির সিদ্ধান্ত ঘোষণা করা হয় ঈদের দুই দিন আগে। এ সিদ্ধান্তের পরই বাংলাদেশ হাইড অ্যান্ড স্কিন মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, এ সিদ্ধান্ত কোনো কাজে আসবে না। খুব যৌক্তিক কারণও তারা জানিয়েছিল- বিশ্ববাজারে বাংলাদেশ এ ধরনের চামড়া রফতানিকারক দেশ হিসেবে পরিচিত নয়, ফলে হুট করে এ সিদ্ধান্ত নেয়াটা আখেরে কোনো কাজে আসবে না। হাতে সময় নিয়ে আন্তর্জাতিকভাবে এ তথ্যটা জানিয়ে দেয়া গেলে সেটি কার্যকর হতে পারত।

একের পর এক চামড়া নিয়ে এ ভয়ংকর কারসাজি হয়েছে। কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে জনগণের স্বার্থরক্ষার জন্য কোনো পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। এর কারণ হিসেবে দুটি সম্ভাবনা দেখা যায়- হয়তো এ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা ও মন্ত্রী অদক্ষ ও অযোগ্য, অথবা এ পুরো কারসাজির সঙ্গে মন্ত্রণালয় জড়িত আছে।

গত বছরের পেঁয়াজ সংকটের পর আমাদের সরকারের সঙ্গে ভারত সরকারের এক ধরনের সমঝোতা হয়েছিল, রফতানি বন্ধের আগে সেই সরকার বাংলাদেশ সরকারকে আগাম জানাবে। কিন্তু এবার রফতানি বন্ধের আগে আমরা দেখলাম এরকম কোনো সতর্কবার্তা ভারত সরকারের পক্ষ থেকে ছিল না। গত বছরের ভয়ংকর পরিস্থিতির পর শুধু ভারতের পূর্বাভাসের আশায় বসে থাকা কি ঠিক হয়েছে? পেঁয়াজ রফতানি বন্ধের আগে ভারতের পরিস্থিতি কী ছিল? এ ব্যাপারে খোঁজ নিতে ভারতের পত্রিকা ঘেঁটে আমি যা পেলাম সেটি উল্লেখ করছি। মার্চ থেকে ভারতে পেঁয়াজের দাম ক্রমাগত বাড়ছিল। আগস্টে চরম অতিবৃষ্টিতে কর্ণাটক রাজ্যের পেঁয়াজ ফলনের বড় অংশ নষ্ট হয়েছে। এ পেঁয়াজ সেপ্টেম্বরে বাজারে আসার কথা ছিল। ওই অতিবৃষ্টিতে মহারাষ্ট্র, মধ্যপ্রদেশ, গুজরাটের অনেক আড়তের বিপুল পরিমাণ পেঁয়াজ নষ্ট হয়েছে। ফলে এক মাস আগে থেকেই ভারতে পেঁয়াজের দাম খুব দ্রুত বাড়ছিল এবং পেঁয়াজ রফতানি বন্ধের দাবি উঠছিল সেই সময় থেকেই।

গত বছর ভারত পেঁয়াজ রফতানি বন্ধ করেছিল মহারাষ্ট্র-হরিয়ানা এ দুই রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে। আর এ বছরের সিদ্ধান্তের পেছনে কাজ করেছে বিহারের বিধানসভা নির্বাচন। ভারতে পেঁয়াজ একটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক পণ্য। বিভিন্ন জাতীয় নির্বাচনে পেঁয়াজের মূল্য গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু হিসেবে এসেছে। কিন্তু দিল্লিতে অন্তত দু’বার সরকার পরিবর্তনের ক্ষেত্রে (১৯৯৮ সালে বিজেপির পরাজয় এবং কংগ্রেসের জয়, ২০১৩ সালে কংগ্রেসের পরাজয় এবং আম আদমি পার্টির জয়) পেঁয়াজের মূল্য প্রধান ভূমিকা পালন করেছে। অর্থাৎ বাংলাদেশ থেকে কেউ যদি খুব ভালোভাবে ভারতের পরিস্থিতি মনিটর করত, তাহলে সে আগাম অনুমান করতে পারত- ভারত পেঁয়াজ রফতানি বন্ধ করে দেবে। গত বছর পেঁয়াজ নিয়ে চরম বিপর্যয়ের পর এ বছর এ ব্যাপারে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কোনো কর্মকর্তাকে বিশেষ দায়িত্ব দিয়ে রাখা দরকার ছিল। তাতে আমরা অন্তত এক মাস আগে থেকেই বিভিন্ন উৎস থেকে পেঁয়াজ আমদানি শুরু করতে পারতাম। এখন বাণিজ্যমন্ত্রী বলছেন, তুরস্ক থেকে পেঁয়াজ আসতে এক মাস সময় লাগবে এবং তখন পেঁয়াজের দাম স্থিতিশীল হবে। তার কথা যদি পুরোপুরি সঠিক হয় তবুও সামনের এক মাস ভীষণ অস্থিতিশীল পরিস্থিতি থাকবে এবং এ সময়ে মানুষের ওপর প্রচণ্ড আর্থিক চাপ পড়বে।

পেঁয়াজের আলোচনায় চামড়া এনেছি কারণটা এখন নিশ্চয়ই স্পষ্ট হয়েছে। চামড়া আর পেঁয়াজ একই মন্ত্রণালয়ের অধীন। দুর্ঘটনাক্রমে কোনো বছর কোনো সমস্যা হয়ে যেতে পারে। কিন্তু জনগণের কল্যাণের কথা ভাবা হলে সেই দুর্ঘটনা বারবার ঘটে না। গত বছর পেঁয়াজ সংকটের দুই বছর আগেও পেঁয়াজ নিয়ে একই রকম সংকট হয়েছিল। যে ৬-৭ লাখ টন ঘাটতির কারণে আমাদের পেঁয়াজ আমদানি করতে হয়, সেটি দেশের মধ্যেই কীভাবে উৎপাদন করা যায় কিংবা আমদানিরও বিভিন্ন বিকল্প উৎস রেখে একক দেশ নির্ভরতা কমানো যায়- সেসব নিয়ে কোনোদিন সমন্বিত কোনো পরিকল্পনা নেয়া হয়নি।

ডা. জাহেদ উর রহমান : শিক্ষক, অ্যাক্টিভিস্ট

 

সূত্রঃ যুগান্তর