‘কোয়ারেন্টিন’ না বলে ‘ঘরবন্দী’ বা ‘একঘরে’ বলা উচিত

সিল্কসিটিনিউজ ডেস্ক:

আজ যদি ধর্মীয় গ্রন্থগুলোর সঠিক অনুবাদ হতো তাহলে জাতি ভণ্ডদের হাতে ধরা খেত না। এমন একটি কথায় অনেকেই ভাববেন কী বুঝাতে চাচ্ছি আমি। যদি ইংরেজিতে বলি “I eat rice” হুবহু অনুবাদ করলে হবে আমি খাই ভাত। আমরা হুবহু ইংরেজি থেকে বাংলা না করে আমাদের মাতৃভাষার মতো অনুবাদ করি তখন বলি “আমি ভাত খাই।”

ধর্মীয় গ্রন্থগুলোকে যদি ঠিক আমাদের বাংলা ভাষায় সঠিকভাবে অনুবাদ করা যেত তাহলে ধর্মীয় গ্রন্থগুলো বুঝতে সহজ হতো। এর ফলে এক দল ভণ্ডরা তাদের ইচ্ছে মতো সাধারণ মানুষের নাকে দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখতে পারত না।

এমনটি বাইবেলের ক্ষেত্রে অতীতে হয়েছে পরে খ্রিষ্টান ধর্মে বিশ্বাসীরা বাইবেলকে যার যার মাতৃভাষায় অনুবাদ করে সহজ এবং সঠিকভাবে বোঝার জন্য। যে কারণে পৃথিবীতে বাইবেল সবচেয়ে বেশি বিক্রিত বই হিসেবে পরিচিত।

আরেকটি উদাহরণ তুলে ধরি। বর্তমান কোয়ারেন্টিন শব্দটি বেশ ব্যবহৃত হচ্ছে যা সাধারণত আমরা ফার্মাসিউটিক্যালস ইন্ডাস্ট্রিতে ব্যবহার করে থাকি। যেমন কোন ওষুধ বা কাঁচামাল রিলিজ (মুক্তি) হবার আগে যদি চ্যুতি ধরা পরে সে ক্ষেত্রে পণ্যটি রিলিজ না করে কোয়ারেন্টিনে রাখা হয়; যতদিন পর্যন্ত চ্যুতির কারণ না জানা যায়।

এ ধরনের শব্দ সমাজে ব্যবহার করে বর্তমানে শুধু বিভ্রান্তির সৃষ্টি করা হয়েছে। আমরা আমাদের বাংলায় একে ‘কোয়ারেন্টিন’ না বলে ‘ঘরবন্দী’ বা ‘একঘরে’ বলতে পারতাম। এ ধরনের শব্দ সাধারণ মানুষের বুঝতে সহজ হতো।

শুনেছি পুলিশ আসছে এক প্রবাসীকে কোয়ারেন্টিনে নিতে। কোয়ারেন্টাইন শব্দ শুনে সেই প্রবাসী মনে করেছে তাকে ক্রসফায়ার দিবে, তাই তিনি পালিয়েছেন। তিনি যদি করোনায় আক্রান্ত হয়েই থাকেন তাহলে যেখানেই পালিয়ে বেড়াচ্ছেন সেখানেই ভাইরাসটি ছড়িয়ে দিচ্ছেন।

যদি তিনি বুঝতেন কোয়ারেন্টিন মানে ঘরবন্দী তাহলে তিনি আদৌ পালাতেন না। কী বিপদ! আবার একজন প্রবাসী বাড়িতে এসে স্বেচ্ছায় কোয়ারেন্টিনে রয়েছেন। কিন্তু কোয়ারেন্টিনের কথা শুনে শত শত লোক দূর-দূরান্ত থেকে এসেছে দেখতে! তাদের কৌতূহলের শেষ নেই।

কোয়ারেন্টিন দেখতে কেমন, কী এর রূপ-চেহারা, এর সাইজ কেমন, এটি খেতে কেমন ইত্যাদি। সারাদিন লোকজন ঘরের বাইরে অপেক্ষা করছে এটা দেখার জন্য। কেউ কেউ ঘরের ফুটো দিয়ে কোয়ারেন্টিন দেখার চেষ্টা করছে! সেখানে তৈরি হয়েছে জটিলতা।

তাদের মধ্যে যদি কারো করোনা ভাইরাসটি থাকে তাহলে সবাই সেখানে আক্রান্ত হতে পারে। যদি ঘরবন্দী বা অন্য কোনো সহজ ভাষা ব্যবহৃত হতো তাহলে নিশ্চয়ই ব্যাপারটি এ রকম হতো না। তাহলে কোয়ারেন্টিন শব্দটাই নতুন বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

করোনা ভাইরাস বলার সঙ্গে সঙ্গে আমরা যদি বলতে পারতাম এটা একধরনের ছোঁয়াচে রোগ; তাহলে সাধারণ মানুষ সহজে বুঝতে পারত। এখন যদি বলা হয় যারা বিদেশ থেকে এসেছে তাদের ‘একঘরে’ বা ‘ঘরবন্দী’ করে রাখতে হবে কারণ বিদেশে এই রোগে অনেকে আক্রান্ত হয়ে মারা যাচ্ছে।

যেহেতু এটা একটি ছোঁয়াচে রোগ তাই বিদেশ ফেরত লোকটিকে কিছুদিন একা থাকতে হবে। সেক্ষেত্রে তার থেকে আমাদের দূরে থাকতে হবে এবং কেউ যেন তাকে না স্পর্শ করে সে দিকে খেয়াল রাখতে হবে ইত্যাদি।

ছোটবেলা যখন কলেরা বা বসন্ত হয়েছে আমরা ঠিক এমনটি করেছি। অথচ এখন কেন সেভাবে বলা হচ্ছে না? আমার ছোটবেলার স্মৃতিচারণ করলে মনে পড়ে যার কলেরা বা বসন্ত হয়েছে আমরা তার কাপড়চোপড়-জিনিসপত্র, খাবারদাবার যাতে না ছুঁই তা বলা হয়েছে।

তাকে একটা আলাদা ঘরে এমনভাবে রেখে চিকিৎসা দিয়ে সারিয়ে তুলতে হয়েছে যাতে অন্যরা কেউ আক্রান্ত না হয়। আরও দূরে যদি যাই তাহলে শত শত বছর আগে যখন কুষ্ঠরোগে মানুষ আক্রান্ত হতো কী করেছে আমাদের পূর্বপুরুষেরা?

দূরে বহু দূরে ফেলে এসেছে। যেমনটি অতীতে ব্রিটিশরা ফেলে আসত অনেককে অস্ট্রেলিয়াতে। যে অস্ট্রেলিয়া আজ পৃথিবীর একটি ধনীদেশ। কুষ্ঠরোগে আক্রান্ত মানুষকে যখন দূরে ফেলে আসত তখন এ ঘটনাকে বোঝানো হতো ‘আইসোলেশন’ শব্দ দিয়ে। তাহলে কাউকে নির্জনে রেখে আসাকে আইসোলেশন বলা হয়।

যাইহোক এভাবে শহর-গ্রামের সব সাধারণ মানুষকে বোঝানোর কাজটা শুধু এখন সরকারের নয়। এ কাজ স্বাস্থ্যকর্মী, সমাজকর্মী, সংস্কৃতিকর্মী, গণমাধ্যমকর্মীদের সবার। আমরা নিজেরাই এখনও উপলব্ধি করতে পারছি না এর ভয়াবহতা কী।

বাংলাদেশের গ্রাম এবং পাশের চরাঞ্চলের মানুষ এখনো এই কঠিন বিষয়টা হেলা করে উড়িয়ে দিচ্ছে! এখন এমন একটা সময় যখন দেশের গণমাধ্যম, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, সামাজিক সব অঙ্গনের মানুষকেই দেশের মানুষের সুরক্ষায়-সেবায় এগিয়ে আসতে হবে।

সরকার স্কুল, কলেজ বন্ধ করে দিয়েছে একইসঙ্গে ভোটকেন্দ্র খোলা রেখেছে। এতে জনগণের নিকট কী ম্যাসেজ পৌঁছালো? মেসেজটি হলো, করোনা ভাইরাস রোগটি সিরিয়াস কিছু নয়। এর আগে একজন মন্ত্রী করোনা ভাইরাসকে সাধারণ সর্দি-জ্বরের সঙ্গে তুলনা করে বক্তব্য দেওয়ায় জনগণের কাছে এই ম্যাসেজটি আরও পাকাপোক্ত হয়েছে।

আবার বলা হচ্ছে লকডাউন। তা আবার কী? গৃহবদ্ধ! এখন প্রশ্ন হচ্ছে, বিদেশে লকডাউন করেছে ঠিকই তার জন্য সরকার সবার জীবনের নিশ্চয়তা দিয়েছে। যেমন খাবার, ওষুধ যা দরকার তার ব্যবস্থা করেই লকডাউন করেছে। তার পরও প্রতিদিন বিদেশে লোক মরছে।

হোটেল, রেস্টুরেন্ট ইত্যাদি বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, মানুষ চাকরিচ্যুত হচ্ছে। বাংলাদেশ শুধু লকডাউন করবে বলছে কিন্তু কী হবে মানুষের? কি হবে গরীব দুঃখীদের? কে দিবে তাদের খাবার, ওষুধ ইত্যাদি? তাহলে সফলতা আসবে কী করে? সবাই মিলে যদি এ ধরনের কাজ না করা হয় তবে আমরা কেউই নিরাপদে থাকতে পারব না।

যখন কোন উপায় থাকবে না তখন জাতির সর্বোত্তম স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে প্রয়োজনে কঠোর ও নির্দয় সিদ্ধান্ত নিতে হবে। যেমন ইতালি তার চিকিৎসা ব্যবস্থায় যুদ্ধাবস্থার জন্য প্রযোজ্য নীতিমালা অনুসরণের সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছে। এই নীতিতে দেখা যাচ্ছে শুধু তাকেই সেবা দেওয়া হবে যার বাঁচার সম্ভাবনা আছে।

চিকিৎসক এবং নীতিনির্ধারক উভয়ের জন্য এই পরিস্থিতি বেশ কষ্টের। বাংলাদেশে তো দুর্নীতি হবে, ক্ষমতার অপব্যবহার হবে, টাকার জোর আর লোভের কারণে কী যে ভয়ংকর পরিবেশ দেখা দিবে তা কী সবাই ভেবেছেন?

আমরা আমাদের অভিজ্ঞতায় দেখেছি গরিব হয়ে যার জন্ম হয়েছে সে আজীবন গরিবই রয়ে গেল। দেশ স্বাধীন করে গরিবের ভাগ্যের পরিবর্তন হয়নি। অথচ স্বাধীন করতে গরিবরাই বেশি জীবন দিয়েছে। ভাগ্যের পরিবর্তন হয়েছে আমলাদের, রাজনীতিবিদদের, দুর্নীতিবাজদের।

I feel sorry for them, really I do. কারণ প্রয়োজন হলেই গার্মেন্টস এবং প্রবাসীদের অর্থে বিদেশ গিয়ে চিকিৎসা নেয়, দেশ-বিদেশ ঘুরে বেড়ায়, হানিমুন করে। এখন কী হবে তাদের? তারা তো অভ্যস্ত নয় দেশীয় চিকিৎসায়! কিন্তু সত্য যে কঠিন তা হলো এমন একটি সময় আসবে তখন কেউ পাশে থাকবে না, শুধু আজরাইল ছাড়া। তখন অনুশোচনা হবে কিন্তু বড্ড দেরিতে। লা ইলাহা ইল্লা আনতা সুবহানাকা ইন্নি কুনতু মিনাজ জোয়ালিমীন। এখন কীভাবে করোনা থেকে রেহাই পেতে পারি সেটাই সবার চিন্তা। করোনা আমাদের সঙ্গেই থাকবে, আমাদেরকে অ্যাডজাস্ট করে চলতে হবে ম্যালেরিয়া বা ডেঙ্গুর মত করে।

পৃথিবীর মানুষ আতঙ্কিত। কারণ সমস্যা আছে, সমাধান নেই। তবে যুক্তরাষ্ট্র সরকার ক্লোরোকুইন এবং হাইড্রোক্সাইক্লোরোকুইনকে করোনাভাইরাসের চিকিৎসার জন্য অনুমোদন দিয়েছে। যদিও এটি ভাইরাসের জন্য কার্যকর সমাধান কিনা তার ফলাফলগুলো এখনও অত্যন্ত অস্পষ্ট। এই ওষুধ হাইড্রোঅক্সিক্লোরোকুইন গোত্রের যা আর্থ্রাইটিসসহ কিছু রোগের চিকিৎসায় এর ব্যবহার হয়ে থাকে। আমার এ ওষুধটির ওপর মনোযোগী হবার কারণ তিন সপ্তাহ আগে আমি সর্দি, জ্বর, কাশিতে বেশ অসুস্থ হই।

যদিও ছোঁয়াচে রোগ তা স্বত্বেও আমার স্ত্রী মারিয়ার কিছুই হয়নি। মারিয়া নিজে এই ওষুধটি ব্যবহার করে এবং সে নিজেই তার কোম্পানির ফাইনাল অ্যানালাইসের দায়িত্বে। যার ফলে ওষুধটি সম্পর্কে আমাদের একটি ধারণা রয়েছে।

ম্যালেরিয়ার ওষুধ C20H24N2O2, কুইনিন, সিনিন (Kinin), ক্লোরোসিনফসফট, ক্লোরোকুইন বা হাইড্রোক্সাইক্লোরোকুইন যাই বলি না কেন এখন বিশ্বজুড়ে প্রশ্ন- এই ওষুধ কি আদৌ প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস নির্মূলে কার্যকর ভূমিকা রাখবে?

রহমান মৃধা, সুইডেন থেকে, rahman.mridha@gmail.com