কোভিড-১৯ রোগের ভাইরাসের বৈশ্বিক মহামারি সৃষ্টির কৌশল।।প্রফেসর আসগর

২০১৯ সালের ডিসেম্বরে চীনের উহান শহরে নভেল করোনাভাইরাস সার্স-কোভ-২ (SARS-COV-2) এর কারণে সৃষ্ট রোগ কোভিট-১৯ বিশ্বের লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবন বিপন্ন করছে ও অর্থনীতি ধ্বংসের মুখে। করোনাভাইরাস পরিবার চারটি প্রধান ভাগে বিভক্ত-আলফা করোনাভাইরাস, বিটা করোনাভাইরাস, গামা করোনাভাইরাস, ও ডেল্টা করোনাভাইরাস। ২০১৯ সালে আবির্ভূত সার্স-কোভ-২ হচ্ছে মানুষের সংক্রমণে জড়িত করোনাইভাইরাসগুলির সপ্তম প্রজাতি (সূত্র: ১৭ মার্চ, ২০২০ তারিখের ন্যাচার মেডিসিন জার্নালে প্রকাশিত গবেষণা)। নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল অফ মেডিসিন এর প্রকাশিত গবেষণা অনুযায়ী, তিনটি করোনাভাইরাস, SARS-CoV (severe acute respiratory syndrome coronavirus), MERS-CoV (Middle East respiratory syndrome coronavirus) ও সাম্প্রতিক কোভিড-১৯ বৈশ্বিক মহামারির জন্য দায়ী ভাইরাস SARS-COV-2 (severe acute respiratory syndrome coronavirus-2) মানুষের মারাত্মক অসুস্থতার কারণ হলেও, অন্য চারটি করোনাভাইরাস, 229E, OC43, NL63 এবং HKU1, মানুষের মৃদু ক্ষতি করে। ল্যানসেট জার্নাল এবং দ্য নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল অফ মেডিসিন নামক দুইটি জার্নালে প্রকাশিত গবেষণা অনুযায়ী, SARS-CoV ভাইরাস ২০০২-২০০৩ সালে চীনের গুয়াংডং প্রদেশে ও MERS-CoV ভাইরাস ২০১২ সালে মধ্যেপ্রাচ্যে মহামারি সৃষ্টি করেছিল। এডভ্যান্সেস ইন ভাইরাস রিসার্চ জার্নালের প্রকাশিত গবেষণা অনুযায়ী, করোনাভাইরাস হচ্ছে আবরণ বিশিষ্ট RNA (Ribonucleic acid) ভাইরাস পরিবার যা প্রধানত মানুষের শ্বসনতন্ত্রে (ফুসফুস ইত্যাদি) সংক্রমণ করে। করোনাভাইরাসের বাহিরের আবরণে স্পাইক প্রোটিনগুলো একত্রিত হয়ে মুকুটের অনুরুপ ট্রাইমারস গঠন করে (ছবি সংযুক্ত)।
ন্যাচার জার্নালে প্রকাশিত গবেষণায় দেখা গেছে, ২০০২-২০০৩ সালের মহামারির জন্য দায়ী ভাইরাস SARS-CoV ও ২০১৯-২০২০ সালের মহামারি কোভিড-১৯ রোগের ভাইরাস SARS-COV-2 এর মধ্যে ঘনিষ্ঠ জেনেটিক ও গাঠনিক সম্পর্ক আছে। ২০০২ সাল থেকে চীনে মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়া সার্স-কোভ নামক ভাইরাসের সংক্রমণে পৃথিবীতে ৭৭৪ জনের মৃত্যু হয়েছিল এবং ৮০৯৮ জন সংক্রমিত হয়েছিল। তবে ২০০২-২০০৩ সালের মহামারির চেয়ে ২০১৯-২০২০ সালের সার্স-কোভ-২ ভাইরাসের কারণে মহামারিতে অনেক বেশি মানুষ মারা গেছে ও সংক্রমিত হয়েছে।
৩০ মার্চ ২০২০ তারিখের ন্যাচার জার্নালে প্রকাশিত গবেষণায় দেখা গেছে, ২০০২-২০০৩ সালের সালে সংঘটিত মহামারির জন্য দায়ী ভাইরাস সার্স-কোভ এর সাথে ২০১৯-২০২০ সালের বৈশ্বিক মহামারির জন্য দায়ী ভাইরাস সার্স-কোভ-২ এর অনেক সাদৃশ্য থাকলেও, উভয়ের বাহিরের আবরণের ‘স্পাইক’ প্রোটিনের গঠনে পার্থক্য রয়েছে। পূর্বের সার্স কোর্ভ ভাইরাসের স্পাইক প্রোটিনের গঠন জেনেটিক্যালি পরিবর্তিত হয়ে নতুন স্পাইক প্রোটিনের গঠন হওয়ার মাধ্যমে সৃষ্ট ভাইরাস সার্স-কোভ-২ মানুষের কোষকে আক্রমণে অধিকতর সক্রিয়তা অর্জন করেছে। কোভিট-১৯ রোগের জন্য দায়ী ভাইরাসের বাহিরের আবরণের স্পাইক প্রোটিনগুলো ২০০২-২০০৩ সালের মহামারির জন্য দায়ী ভাইরাসের চেয়ে অনেক বেশী সন্নিবিষ্ট হওয়ার ফলে বর্তমানে সার্স-কোভ-২ ভাইরাস দ্বারা মানুষের দেহের কোষগুলো দৃঢ়ভাবে সংযুক্ত থেকে তীব্র সংক্রমণ ও দ্রুত রোগ বিস্তার করছে (সূত্রঃ ৩০ মার্চ, ২০২০ তারিখের ন্যাচার জার্নালে প্রকাশিত গবেষণা)। সার্স-কোভ-২ ভাইরাসটি তার আবরণের স্পাইক প্রোটিনের মাধ্যমে মানুষের শ্বসনতন্ত্রের এপিথেলিয়াল কোষগুলিকে আক্রমণ করে।
করোনাভাইরাস মানুষের দেহে সংক্রমণের দ্বারা দেহ থেকে খাদ্য গ্রহণের মাধ্যমে টিকে থাকে। এ কারণে সংক্রমণের সময় মানুষকে হোস্ট বলা হয়। সংক্রমণের সময় কালে, সার্স-কোভ-২ ভাইরাসের বাহিরের আবরণের ‘স্পাইক’ প্রোটিন মানুষের (হোস্ট) শ্বসনতন্ত্রের (গলবিল, ফুসফুস) কোষের ‘রিসেপটর’ প্রোটিনের সাথে যুক্ত হয় (সূত্রঃ ১ এপ্রিল, ২০২০ তারিখের ন্যাচার জার্নালে প্রকাশিত গবেষণা)। একটি তালা যেমন একটি চাবিকে গ্রহণ করে অনুরূপভাবে, করোনাভাইরাসকে মানুষের (হোস্ট) কোষের ‘রিসেপটর’ গ্রহণ করে। সংক্রমণের সময় সার্স-কোভ ও সার্স-কোভ-২ উভয় ভাইরাসই receptor-binding domain (RBD) এর মাধ্যমে মানুষের শ্বসনতন্ত্রের এপিথেলিয়াল কোষের একই রিসেপটর ‘hACE 2/এইচএসিই ২’ (হিউম্যান এনজিওটেনসিন-কনভার্টিং এনজাইম ২)-তে সংযুক্ত হয়। ‘এইচএসিই ২” তে সংযুক্ত হওয়ার জন্য উভয় ভাইরাসের ‘রিসেপটর-বাইন্ডিং ডোমেনে’ স্পাইক প্রোটিনের দুইটি hotspots (হটস্পটস), যথা hotspot-31 (হটস্পট-৩১) ও hotspot-353 (হটস্পট-৩৫৩) আছে। কিন্তু উভয় ভাইরাসের রিসেপটর-বাইন্ডিং ডোমেনের হটস্পটগুলির স্পাইক প্রোটিনের গঠনে কিছুটা পার্থক্য থাকায়, সার্স-কোভ-২ ভাইরাসের দুইটি হটস্পটস, সার্স-কোভ এর দুইটি হটস্পটস এর তুলনায় ‘এইচএসিই ২’ এর সঙ্গে বন্ধনে অধিক নিবিড় ও স্থিতিশীল।
ন্যাচার জার্নালে প্রকাশিত গবেষণার এভিডেন্স অনুযায়ী, কোভিড-১৯ রোগের ভাইরাসের (সার্স-কোভ-২) ‘রিসেপটর-বাইন্ডিং ডোমেনের’ ২০০২-২০০৩ সালের সার্স-কোভ ভাইরাসের ‘রিসেপটর-বাইন্ডিং ডোমেনের’ চেয়ে হোস্ট (মানুষ) কোষের এইচএসিই ২ এর প্রতি অধিকতর বন্ধন আসক্তি রয়েছে। সার্স-কোভ-২ ভাইরাসের ‘রিসেপটর-বাইন্ডিং ডোমেনের’ হটস্পটগুলোর স্পাইক প্রোটিনের ভিন্ন গাঠনিক বৈশিস্টের কারণে হোস্ট কোষের এইচএসিই-২’কে প্রচন্ডভাবে আকর্ষণের মাধ্যমে আক্রমণে মুখ্য ভূমিকা পালন করে। ফলে কোভিট-১৯ রোগটি বিশ্বব্যাপী দ্রুত সংক্রমিত ও বিস্তার লাভ করছে এবং তা স্থায়ী হচ্ছে।
গবেষকেরা কোভিট-১৯ রোগের ভাইরাসের দ্বারা মানুষকে আক্রমণের প্রোটিনের গঠন খুঁজে পেয়েছেন। বিজ্ঞানীরা মনে করছেন, সংশ্লিষ্ট ‘মনোক্লোনাল এন্টিবডিস’ সার্স-কোভ-২ এর রিসেপটর-বাইন্ডিং ডোমেনের সাথে হোস্ট কোষের এইচএসিই এর বন্ধন বাধাগ্রস্থ করতে পারে। তাই বর্তমানে ‘মনোক্লোনাল এন্টিবডিস’ সম্ভাবনাময় এন্টিভাইরাল ড্রাগ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। অধিকিন্তু, এক্সপার্ট অপেনিয়ন অন থেরাপিউটিক টারগেটস জার্নালের গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, ‘সার্স-কোভ-২ ভাইরাসের রিসেপটর-বাইন্ডিং ডোমেন’ নিজেই কোভিড-১৯ রোগের ভ্যাকসিন হিসেবে সম্ভাবনাময়। যুক্তরাষ্ট্রের চিলড্রেন হসপিটাল অফ ফিলাডেলফিয়া ভ্যাকসিন এডুকেশন সেন্টার প্রদত্ত তথ্য অনুযায়ী, মৃত বা দুর্বল এন্টিজেন (ভাইরাস/ব্যাকটেরিয়া) দ্বারা ভ্যাকসিন তৈরি হয়। সাম্প্রতিক ইবায়োমেডিসিন জার্নালে প্রকাশিত গবেষণা অনুযায়ী, কোভিট-১৯ রোগের ভাইরাসের ভ্যাকসিন আবিস্কারের লক্ষ্যে বিজ্ঞানীরা ইদুরের উপর মার্স-কোভ ভাইরাসের (করোনাভাইরাসের অন্য একটি স্ট্রেন/প্রজাতি) ভ্যাকসিন প্রয়োগ করে সফল হয়েছে। ইদুরের দেহে মার্স-কোভ ভাইরাসের প্রয়োগের ফলে পর্যাপ্ত পরিমাণে শক্তিশালী ও দীর্ঘস্থায়ী রোগ প্রতিরোধী প্রোটিন “এন্টিবডি” সৃষ্টি হয়েছিল। এ গবেষণাটি মানুষের দেহের কোভিট-১৯ রোগের ভাকসিন আবিস্কারে গুরুত্বপূর্ণ দিকনির্দেশনা প্রদান করবে। যুক্তরাষ্ট্রের ব্যবসাবিষয়ক ওয়েবসাইট বিজনেস ইনসাইডার এক প্রতিবেদনে বলেছে, করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিনের জন্য দ্রুত চেষ্টা করছে যুক্তরাষ্ট্র। মার্চের মাঝামাঝি সময়ে ম্যাসাচুসেটসের বায়োটেক প্রতিষ্ঠান মর্ডানা তাদের ভ্যাকসিন নিরাপদ কি না তা পরীক্ষা শুরু করে। ইনোভিওর তৈরি ‘আইএনএ-৪৮০০’ ভ্যাকসিনটিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মানব পরীক্ষা শুরু করার জন্য দ্বিতীয় সম্ভাব্য করোনাভাইরাস ভ্যাকসিন হিসেবে দেখা হচ্ছে।
লেখক:
প্রফেসর ড. মু. আলী আসগর

                                                                                                                                                                                                                Dr Md Ali Asgar

MS & Ph.D. (Japan)
Professor
Department of Crop Science and Technology
University of Rajshahi,
and
Former Provost, Motihar Hall
University of Rajshahi, Bangladesh
Cell: +8801727226701