কেমন আছি আমরা!

‘যদিও সন্ধ্যা আসিছে মন্দ মন্থরে,
সব সঙ্গীত গেছে ইঙ্গিতে থামিয়া,
যদিও সঙ্গী নাহি অনন্ত অম্বরে,
যদিও ক্লান্তি আসিছে অঙ্গে নামিয়া,
মহা আশঙ্কা জপিছে মৌন মন্তরে,
দিক দিগন্ত অবগুণ্ঠনে ঢাকা-
তবু বিহঙ্গ, ওরে বিহঙ্গ মোর,
এখনি, অন্ধ, বন্ধ কোরো না পাখা।’
[রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। এখন দুঃসময়]

এক অদৃশ্য আততায়ী পৃথিবীব্যাপী তাড়িয়ে ফিরছে আমাদের। তিলে তিলে গড়ে ওঠা মানব সভ্যতা, তার চোখ ঝলসানো উন্নয়নের অহংকার, শব্দের চেয়ে দ্রুত গতিতে চলার ধাবমানতা- সবই যেন এক লহমায় থমকে দাঁড়িয়েছে।

কোভিড-১৯ মহামারী থমকে দিয়েছে মানব সভ্যতার গতি। আমাদের দাঁড় করিয়ে দিয়েছে প্রতিদিন মৃত্যুর মিছিলে। আমরা ঘুমুতে যাই মৃত্যুর স্কোর নিয়ে, জেগে উঠে প্রস্তুতি নিই আজকের মৃত্যুর স্কোর তৈরির জন্য। মহামারীর বিরুদ্ধে এমন অসম যুদ্ধ পৃথিবীতে আগেও ঘটেছে, কিন্তু বিশ শতকের এই পরিস্থিতি সেসব মহামারীর চেয়ে অনেক বেশি সংকটজনক।

শ্বাসরুদ্ধকর এমন সময় পৃথিবীতে এর আগে আর কখনও আসেনি। আর এই শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতিতে নিজের কাছেই এই প্রশ্নটি ছুড়ে দিয়ে- ‘কেমন আছি আমরা?’- উত্তর খুঁজতে গিয়ে দেখছি বাঙালির প্রাণের স্পন্দনের স্বরলিপি যার হাতে রচিত, সেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শতবর্ষ আগে দূরদৃষ্টিসম্পন্ন ঋষির প্রজ্ঞায় যেন আজকের এই দুঃসময়কেই বর্ণনায় তুলে রেখেছিলেন। যেন আজকের এই দুঃসময়েরই ভাস্কর্য তিনি শব্দ খুঁড়ে খুঁড়ে গেঁথেছিলেন হৃদয়ের অতল গভীর থেকে।

আসলেই ‘কেমন আছি আমরা’ এই করোনার দুঃসময়ের কালে? যখন নাড়িছেঁড়া সন্তান বৃদ্ধ মা-বাবাকে করোনা আক্রান্ত এই ভয়ে রাস্তায় ফেলে রেখে চলে যাচ্ছে? স্ত্রী-সন্তানেরা করোনাক্রান্ত পিতাকে বাড়িতে স্থান না দিয়ে উল্টো একটা ঘরে তালাবদ্ধ করে মৃত্যুমুখে ঠেলে দিচ্ছে? যখন করোনায় মৃত স্বজনের সৎকার সম্পন্ন করার কাজে এগিয়ে আসছে না সন্তানসন্ততি, আত্মীয়স্বজন; যখন করোনায় মৃতকে কবরস্থানে দাফনে পর্যন্ত বাধা দেয়া হচ্ছে, শ্মশানে দাহ কার্যে বাধা দেয়া হচ্ছে! করোনা রোগীর চিকিৎসককে বাড়িওয়ালারা বাড়ি থেকে বের করে দিচ্ছেন! যখন একেকটি পরিবারের শ্রদ্ধার, ভালোবাসার আদরের সদস্য- মৃত্যুতে হয়ে দাঁড়াচ্ছে ‘একটি সংখ্যা’ মাত্র?

এরকম একটা অসম যুদ্ধের প্রান্তরে দাঁড়িয়ে এমন প্রশ্ন- ‘আমরা কেমন আছি?’- যেন অর্থহীন উচ্চারণ মনে হয়। তারপরও আমাদের কলম ধরতে হয়, কথা বলতে হয়। রবিঠাকুরের ভাষায়ই এই আশা জাগিয়ে রাখার নিরন্তর সাধনায়- ‘তবু বিহঙ্গ, ওরে বিহঙ্গ মোর, এখনি, অন্ধ, বন্ধ কোরো না পাখা।’

না, চলা বন্ধ করার কোনো উপায় নেই। লকডাউন, শাটডাউনের মধ্যেও আমাদের চলতে হবে। চালিয়ে নিতে হবে জীবনকে। এই অদৃশ্য আততায়ী করোনার কাছে যেমন শিশু-বৃদ্ধ নেই, ধনী-নির্ধন নেই- তার বিনাশে-সংহারে। তেমনই আমাদের বেঁচে থাকার লড়াইয়েও নেই ক্ষান্তি। তাই এই দুঃসময়ের তিমির অন্ধকারে আমরা দেখছি আলোর জোনাকি হয়ে ক্ষুধার্তের মুখে অন্ন তুলে দিচ্ছে ‘বিদ্যানন্দের’ স্বেচ্ছাসেবীরা। সরকারের ত্রাণসামগ্রী ঘরে ঘরে পৌঁছে দিচ্ছেন সেনাবাহিনী, বিজিবি, র‌্যাব, পুলিশ, আনসার বাহিনীর সদস্যরা। স্বজনের কাছ থেকে পরিত্যক্ত লাশ দাফনে সাহস নিয়ে দাফন ও দাহ কার্যে এগিয়ে এসেছে কোয়ান্টাম, আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামের স্বেচ্ছাব্রতীরা।

নিরস্ত্র বাঙালি জাতি একদিন যেমন প্রচণ্ড সাহসে সশস্ত্র বর্বর পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধ করে ছিনিয়ে এনেছিল দেশের মুক্তি, তেমনই আমরা বিশ্বাস করি অদৃশ্য আততায়ী করোনার বিরুদ্ধে অসম যুদ্ধেও আমরা জয়ী হব। করোনাকালের আশাজাগানিয়া এই জোনাকিরা আমাদের আলোর পথে নিয়ে যাবে অবশ্যই।

২.
এই সাংঘাতিক দুর্যোগের সময়ে এই জোনাকিরা যেমন লড়ছে, তেমনই সম্মুখসারিতে থেকে অজস্র অব্যবস্থাপনার ভেতরও আমাদের ডাক্তার, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মীরা তাদের সামর্থ্যের সর্বস্ব দিয়ে লড়ছেন। তারা আক্ষরিকভাবে জীবনবাজি রেখে লড়ছেন। এ লড়াইয়ে আমরা এ পর্যন্ত ৭৩ জন ডাক্তারকে হারিয়েছি। যাকে জাতির জন্য অপূরণীয় ক্ষতি বলা চলে। হারিয়েছি পুলিশ বাহিনীর বেশ ক’জন সদস্যকে। ডাক্তার, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মী, স্বেচ্ছাব্রতীরা করোনা আক্রান্তদের চিকিৎসা করতে গিয়ে নিজেরা সংক্রমিত হয়েও ভালো হয়ে উঠেই আবারও করোনা আক্রান্ত মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে যুদ্ধে শামিল হচ্ছেন। আমরা যেন এই লড়াই, এই বীরত্বের কথা ভুলে না যাই। যখন বিদেশে একজন ডাক্তার, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মী ডিউটি থেকে ঘরে ফেরার সময় সব প্রতিবেশী তার উদ্দেশে হাততালি দিয়ে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছেন, তখন আমাদের করোনা চিকিৎসককে বাড়িওয়ালা তার বাড়ি থেকে বের করে দিচ্ছেন এমন দেখেছি।
একসময় হয়তো এই যুদ্ধের শেষ হবে; কিন্তু করোনা-যুদ্ধে শামিল যোদ্ধাদের যেন আমরা কৃতজ্ঞতা জানাতে না ভুলি। আমরা যেন তাদের কাজের অবদানের স্বীকৃতি দিই অকুণ্ঠচিত্তে।

৩.
করোনার থাবায় আমাদের স্বাস্থ্য, শিক্ষা, অর্থনীতি, শিল্প-বাণিজ্যের প্রতিটি ক্ষেত্রই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে- এই ক্ষতির পরিমাপ এখনই নিরূপণ করা সম্ভব নয়। ১৯৭১-এ যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশকে যেমন শূন্য ও রিক্তহস্তে শুরু করতে হয়েছিল, তেমনই প্রায় সবকিছু শুরু করতে হবে ফের। আর এ কাজের ভার সিংহভাগ বহন করতে হবে সরকারকেই। কেবল গণমানুষের সরকারের পক্ষেই তা সম্ভব। সব সুখে-দুঃখে, আনন্দে, দুর্যোগ মোকাবেলায় চাই জনগণের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা। তবে সরকারের পাশে থেকে বেসরকারি খাতের মানুষকেও ভূমিকা রাখতে হবে উল্লিখিত স্বেচ্ছাব্রতীদের মতো। ত্যাগের মনোবৃত্তি নিয়ে, দেশের মানুষের প্রতি দায়বদ্ধতার অঙ্গীকার নিয়ে।

৪.
সমাজের সব পেশার মানুষের জীবনের ওপর পড়েছে করোনার কালো ছোবল। সংবাদপত্র, টেলিভিশনসহ গণমাধ্যমগুলোর কর্মীরা জীবনের চরম ঝুঁকি নিয়ে পালন করে চলেছেন পেশাগত দায়িত্ব। সংকটের কালো ছায়ার নিচে অনিশ্চিত জীবনের মধ্যে কালাতিপাত করতে হচ্ছে পোশাক কারখানাসহ বিভিন্ন কারখানার শ্রমিক, ডাক্তার, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মী, বিচারক, আইনজীবী, স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কর্মচারী, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, হকার, রিকশাওয়ালা, ক্ষেতমজুর, পরিবহন শ্রমিক, মালিক, কুলি, দিনমজুর থেকে শুরু করে বাসার কাজের মানুষ, এমনকি পেশাদার ভিক্ষুকরা পর্যন্ত- কেউ এ তালিকার বাইরে নয়।
এক অজানা আতঙ্কে আড়ষ্ট হয়ে পড়েছে পুরো শ্রমের আঙিনা। কর্মসংস্থানের এই ভেঙে পড়া ঝুঁকি কাটিয়ে আবার যথাযথরূপে পুনঃস্থাপন না করতে পারলে সমাজের সার্বিক স্বাভাবিকতা ফিরিয়ে আনা দুঃসাধ্য হয়ে পড়বে। আর সেই ভার আমাদের সমাজ বইতে পারবে কি না, সেটাই চিন্তার বিষয়।

আন্তর্জাতিক সাময়িকী ‘দি ইকোনমিস্ট’-এর একজন বিশ্লেষক লিখেছেন, ‘করোনা থাকবে, এর ভেতরেই আমাদের মানিয়ে চলতে হবে।’

আমাদের মনে হয় এটাই বাস্তবতা। আর এই মানিয়ে চলতে গেলে আমাদের মতো দেশে সরকারি নানা উদ্যোগ ও পদক্ষেপের সঙ্গে সাধারণ মানুষের সচেতনতার মেলবন্ধন তৈরি করতে হবে। এজন্য বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই প্রয়োজন হবে সরকারের পক্ষ থেকে সঠিক মধ্যস্থতা এবং কার্যকর মনিটরিং।

৫.
করোনা দুর্যোগের এই সংকটকালে ইতোমধ্যেই কর্মহীন বেকার এক বিশাল জনগোষ্ঠীর সৃষ্টি হয়েছে। খেটে খাওয়া এই মানুষগুলো কবিগুরু কথিত- ‘মহা আশঙ্কা জপিছে মৌন মন্তরে’- এরা খেটে খাওয়া মানুষ- ভিক্ষা, লুট, চুরি কোনোটাই এদের কাজ নয়- তাই এদের আবার কর্মসংস্থানে ফিরিয়ে আনতে হবে। সরকারের একার পক্ষে এই বিপুলসংখ্যক মানুষকে পুনর্বাসিত করা সম্ভব নয়। তাই এদের কাজে ফেরাতে লাগবে বেসরকারি খাতের সহযোগিতা। পরীক্ষিত বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তাদের আস্থায় নিতে হবে সরকারকে। যারা দেশের মানুষের জন্য, দেশের অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের লড়াইয়ে লড়বে। জীবন ও জীবিকার সমন্বয়ে করোনা মোকাবেলায় বিশ্ব নিয়েছে ব্যাপক প্রস্তুতি। পিছিয়ে নেই বাংলাদেশও।

৬.
করোনা দুর্যোগের এ সময়ে একটা কথা প্রায়ই তুলনায় আসছে- আমাদের পরে স্বাধীনতা পেয়ে ‘ভিয়েতনাম’ পারল করোনা মোকাবেলায়, দক্ষিণ কোরিয়া পারল- আমরা কেন পারছি না?

এ প্রশ্নের উত্তরে বলা যায়, আমরাও পারছি- এ ক্ষেত্রে আমাদের সফলতা কম হলেও আমরা ব্যাপক সংক্রমণকে সামাল দিতে পেরেছি। অতীতের আরও অনেক দুর্যোগ মোকাবেলার অভিজ্ঞতার আলোকে আমরা আমাদের সীমিত সামর্থ্যে করোনা সংক্রমণের গতিকে শ্লথ করতে পেরেছি।

৭.
করোনাকালে বন্যার ছোবলে দেশের ৩০-৩২ জেলা প্লাবিত। লাখ লাখ মানুষ এখন দারুণ দুর্ভোগে দিন কাটাচ্ছে। ত্রাণ পাচ্ছে, ত্রাণ পাচ্ছে না। অভাব খাদ্যের, ওষুধ, খাবার পানির। পানির মধ্যে বসবাস করে পানির অভাবে জীবন দুর্বিষহ। ফসলের ক্ষতি, প্রাণের ক্ষতি, জীববৈচিত্র্যের অপূরণীয় ক্ষতি। তারপরও জীবন কি থেমে থাকবে?

৮.
আমাদের মানব জীবনের সীমিত আয়ুর সংজ্ঞা হচ্ছে- ‘আজ আছি কাল নেই’- এ কথা ভুলে আমরা যে অনপনেয় বিভেদের বীজ বুনে রেখেছি সমাজের শরীরে- সেই বিভেদের বিষবৃক্ষ উৎপাটন করতে হবে।
করোনাকাল ও বন্যা যেন আমাদের এই চৈতন্যোদয় ঘটায়। আমরা তাহলে রবিঠাকুরের এই আশঙ্কা উড়িয়ে দিয়ে-

‘এখনো সমুখে রয়েছে সুচির শর্বরী
ঘুমায় অরুণ সুদূর অস্ত-অচলে!
বিশ্বজগৎ নিশ্বাস বায়ু সম্বরি
স্তব্ধ আসনে প্রহর গনিছে বিরলে।
সবে দেখা দিল অকূল তিমির সন্তরি
দূর দিগন্তে ক্ষীণ শশাঙ্ক বাঁকা।
ওরে বিহঙ্গ, ওরে বিহঙ্গ মোর,
এখনি, অন্ধ, বন্ধ কোরো না পাখা।’
[রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। এখন দুঃসময়]

এই প্রত্যয়ে আশার প্রদীপ জ্বালিয়ে- জয় বাংলা, বাংলাদেশ চিরজীবী হোক- স্লোগানে জেগে উঠতে পারি।

সাইফুল আলম : সম্পাদক, দৈনিক যুগান্তর; সভাপতি, জাতীয় প্রেস ক্লাব

 

সুত্রঃ যুগান্তর