কেন হেলমেট ছাড়াই মাঠে নামতেন রমন লাম্বা?

ভালোবাসার মানুষকে এক নজর দেখার জন্যই মাঠে হেলমেট ছাড়া খেলতে নামতেন রমন লাম্বা। প্রেমিকার প্রতি তার এমন গভীর ভালোবাসাই শেষ পর্যন্ত কাল হলো।

নব্বইয়ের দশকে ঢাকার মাঠে আবাহনী-মোহামেডানের মধ্যকার ম্যাচের পরতে পরতে থাকত উত্তেজনা। আবাহনী-মোহামেডান ম্যাচ মানেই ছিল মহারণ। এখন অবশ্য সেই উত্তেজনার ছিটেফোটাও নেই। কিন্তু তখনকার দিনে আবাহনী-মোহামেডান দ্বৈরথ মানে সব সমর্থকের দুই ভাগ হয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা।

এমনি এক ম্যাচে ১৯৯৮ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে আবাহনীর হয়ে খেলতে নেমেছিলেন রমন লাম্বা। বাংলাদেশের ক্রিকেটে তখন পরিচিত মুখ ছিলেন ভারতীয় এ তারকা ক্রিকেটার। ১৯৯১ সাল থেকে ঢাকার ক্রিকেটে নিয়মিত খেলতেন তিনি। আবাহনীর হয়ে খেলতে খেলতে এক সময়ে আবাহনীর ‘ঘরের ছেলে বনে যান রমন লাম্বা।

২০ ফেব্রুয়ারির ওই ম্যাচে মোহামেডানের বিপক্ষে জিতলেই চ্যাম্পিয়ন। সেই ম্যাচে ১৫৭ রান করে আবাহনী। মোহামেডানের হয়ে তখন ব্যাট করছিলেন মেহরাব হোসেন অপি, নন-স্ট্রাইকে ছিলেন আমিনুল ইসলাম বুলবুল। আবাহনীর নিয়মিত অধিনায়ক আকরাম খান তখন মাঠের বাইরে ছিলেন, তার পরিবর্তে অধিনায়কের দায়িত্ব সামলাচ্ছিলেন খালেদ মাসুদ পাইলট৷

মোহামেডানকে আরও চেপে ধরতেই পাইলট বল তুলে দিয়েছিলেন বাঁহাতি স্পিনার সাইফুল্লাহ খান জিমের হাতে। জিমের ওভারে বারবার শর্ট মিড উইকেট থেকে হেঁটে হেঁটে স্লিপে গিয়ে অপিকে স্লেজিং করছিলেন রমন লাম্বা।

কী ঘটেছিল মাঠে সেদিন? সাইফুল্লাহ খান জিম ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসকে বলেছেন, ওই ওভারটি ছিল সার্কেলের শেষ ওভার। শেষ তিন বলে যেন রান না হয় সে জন্য আমি রমন লাম্বাকে শর্ট মিড উইকেটে থাকতে বলেছি। কিন্তু ও বারবার স্লিপে চলে আসছিল। আমি ওকে বললাম, আমার লাস্ট বল, তুমি স্লিপে এসো না। চার হয়ে গেলে মোহামেডানের রান বেশি হয়ে যাবে। তুমি শর্ট মিড উইকেটেই থাকো। কিন্তু ও হাঁটতে হাঁটতে এসে অপিকে স্লেজিং করছিল এবং ফরোয়ার্ড শর্ট লেগে দাঁড়াচ্ছিল হেলমেট ছাড়া। আমি বারবার নিষেধ করেছি। হেলমেট নিতে অনুরোধ করেছি, কিন্তু ও শোনেনি। আমার বলে খেলা অপির পুল শট রমন লাম্বার মাথায় লেগে বল ওপরে উঠলে পাইলট ক্যাচ ধরে। সেই মাঠে স্ট্রেচারও ছিল না। ওকে হাঁটতে হাঁটতে ড্রেসিংরুমে নিয়ে যাওয়া হলো৷ হেঁটে যাওয়ার সময় মোটামুটি কথা বলতে পারছিল। ড্রেসিংরুমে যাওয়ার পর আর কথা বলতে পারেনি।

৩৮ বছর বয়সী রমন লাম্বা মাঠে জ্ঞান ড্রেসিংরুমে ফেরার পর বমি করতে করতে অজ্ঞান হয়ে পড়ে। এরপর দেশসেরা সব চিকিৎসকদের চেষ্টা ব্যর্থ করে ২৩ ফেব্রুয়ারি তিনি না ফেরার দেশে পাড়ি জমান।

আশির দশকে ভারতের হয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেক হওয়া রমন লাম্বার খেলেন ৪ টেস্ট আর ৩২ ওয়ানডে। জাতীয় দলের বাইরে বাংলাদেশ, আয়ারল্যান্ড ও ইংল্যান্ডের নিয়মিত ঘরোয়া লিগ খেলেছেন তিনি। খেলতে খেলতেই তার প্রেম হয়ে যায় আইরিশ তরুণী কিমের সঙ্গে।

সাইফুল্লাহ খান জিম আরও বলেন, রমন লাম্বার এমন অকাল মৃত্যুর পর আমি ১৩ দিনের মতো ঘরে বসেছিলাম, সারাক্ষণ মন খারাপ থাকত। রমন লাম্বার স্ত্রী আমাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলছিলেন, তুমি এত দুশ্চিন্তা কোরো না। ওর স্ত্রী যখন বাচ্চা নিয়ে আসতেন, তখন দেখেছি তাদের মধ্যে কেমন সম্পর্ক ছিল। সারাক্ষণ রমন লাম্বার কানে কি যেন গুনগুন করে বলে যাচ্ছিল। এটা দেখে আমি চোখের জল ধরে রাখতে পারিনি। আমাকে রমন লাম্বার স্ত্রী কিম বলেছিলেন, তুমি এটা নিয়ে কোনো অনুশোচনা করো না। আমাকে দেখার জন্যই ও হেলমেট পরত না। এখানে তোমার কোনো দোষ নেই।

রমন লাম্বার স্মৃতি চারণ করতে গিয়ে কান্নাজড়িত কণ্ঠে জিম বলেন, ওর সঙ্গে আমার খুব ভালো সম্পর্ক ছিল। মাঠে নামার আগে ও আমাকে বলেছিল, জিম আমি ভারতে যে বাড়িটা বানিয়েছি সেখানে এবার ফ্যামিলি নিয়ে উঠব৷ একদম নতুন বাড়ি৷ ওর স্ত্রীও বারবার সে কথাই বলছিলেন, আমার স্বামীর নতুন বাড়িতে ওঠার কথা ছিল। ওর সে আশা পূরণ হলো না।

সাইফুল্লাহ জিম আরও বলেন, রমন লাম্বা খুব রসিক ছিল। কিন্তু খুব প্রফেশনাল ছিল। ওর মধ্যে সব সময় জয়ের নেশা থাকত। সে কখনও হার পছন্দ করত না। প্র্যাকটিসের সময় বলত, কাল সেঞ্চুরি করব, তাই করতো। ৩০-৪০ হলেই আমরা ধরে নিতাম ও সেঞ্চুরি করবে। এ জন্যই রমন লাম্বা বন্ধুদের সঙ্গে রসিকতা করে বলত, ‘আমি ঢাকার ডন।

 

সুত্রঃ যুগান্তর