উৎপাদন ব্যাহত হওয়ার শঙ্কা

কৃষি উপকরণের অস্বাভাবিক দামে দিশেহারা চাষি

সিল্কসিটিনিউজ ডেস্ক:

রাজধানী ঢাকা থেকে প্রায় ৭০ কিলোমিটার দূরে মানিকগঞ্জের ঘিওর উপজেলার চৌবাড়ীয়া গ্রাম। ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক থেকে উত্তর দিকে প্রায় ৩ কিলোমিটার দূরে এই গ্রামজুড়ে বিস্তীর্ণ ফসলের মাঠ।

তিন ফসলি জমি হওয়ায় কৃষিই এখানকার মানুষের প্রধান জীবিকা। বংশপরম্পরায় এই গ্রামের অনেকেই ফলাচ্ছেন সোনালি ফসল।

আবার এক সময় যারা ছিলেন গ্রামের নামকরা গৃহস্থ, তাদের কেউ কেউ লোকসানের মুখে কৃষি থেকে এখন অনেক দূরে। এমন গৃহস্থদের জমি বছর চুক্তিতে কিনে নিয়ে চাষবাস করেন অন্যরা।

১১ নভেম্বর গোধূলি লগ্নে গ্রামটি সরেজমিন দেখা গেছে, পাওয়ার টিলার (চাষ যন্ত্র) দিয়ে জমি চাষে ব্যস্ত কৃষকরা। তাদেরই একজন শামসুল ইসলামের কাছে জিজ্ঞাসা ছিল, কৃষি কাজে এখন লাভ কেমন-আক্ষেপের সুরে হিসাব তুলে ধরে তার জবাব, ‘আমাগো এহন মাতায় (মাথায়) আত (হাত)।

আলচাষ (হালচাষ) ছাড়া কিচু করার নাই, তাই করি। সার, ডিজেল, বিষ (কীটনাশক), বেচুন (বীজ) সবকিছুর দাম বাড়তি। বছর না যাইতেই বিঘায় আবাদ করতে ১০-১৫ হাজার টাকা খরচ বেশি।

কেমনে কি করি দিসা পাই না। আমাগো পকেট খালি! মাতার (মাথা) ঘাম পায়ে ফেলে আবাদ করলেও আমাগো কপালে ভালো কিছু জুটে না।

আর কষ্ট কইরা আবাদের পর ঝরি-ম্যাগ অইলে পুরাই লস। কদিন আগে ঝরি ম্যাগে (ঘূর্ণিঝড় সিত্রাং) অনেকের পেঁয়াজ ও আলুর আবাদ পইচ্যা গ্যাছে। তাগো কষ্টের কতা হুনলে কানবেন।’

শামসুল ইসলামের কথার সূত্র ধরে যুগান্তরের নিজস্ব অনুসন্ধানে পাওয়া গেছে কৃষকের দুর্দশার ভয়াবহ চিত্র। উৎপাদন খরচ অস্বাভাবিক বাড়ায় কৃষকরা দিশেহারা।

২০২৩ সালে দুর্ভিক্ষের শঙ্কায় কৃষি উৎপাদন বাড়ানোর তাগিদ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কিন্তু সার, কীটনাশক, বীজসহ বিভিন্ন ধরনের কৃষি উপকরণের দাম অস্বাভাবিক হারে বাড়ায় উৎপাদন ব্যাহত হওয়ার শঙ্কা দেখা দিয়েছে।

এক্ষেত্রে স্থানীয় কৃষি কর্মকর্তারাও কোনো ভূমিকা রাখতে পারছেন না। তাই সার, কীটনাশকসহ কৃষি উপকরণের দাম নিয়ন্ত্রণে জরুরি পদক্ষেপ নিতে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ দরকার বলে মনে করছেন কৃষিবিদরা।

কৃষি অর্থনীতিবিদ ড. জাহাঙ্গীর আলম যুগান্তরকে বলেন, ‘কৃষককে প্রফিট (লাভ) দিতে হবে সেই উদ্দেশ্য নিয়ে সরকারি সংস্থাগুলো কাজই করে না।

প্রধানমন্ত্রীকে চারপাশ থেকে যারা ঘিরে রাখেন তারা তার কাছে ভুল বার্তা দেন। প্রধানমন্ত্রীর কাছে কৃষকের আসল চেহারা তুলে ধরা হয় না। আর এ কারণে তিনি (প্রধানমন্ত্রী) এক ইঞ্চি জমি অনাবাদি না রাখার যে আহ্বান জানাচ্ছেন তাতে সাড়া মিলবে না।

কৃষক যদি চাষ করে লাভবান না হয়, তাহলে তারা শুধু খোরপোষের জন্য চাষাবাদ করবে। বাণিজ্যিক চাষাবাদ থেকে তারা মুখ ফিরিয়ে নেবে।’ এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘ধরুন এবার সরকারিভাবে ধানের দাম নির্ধারণ করা হয়েছে প্রতি কেজি ২৮ টাকা।

আর চালের দাম নির্ধারণ করা হয়েছে প্রতি কেজি ৪২ টাকা। অথচ সরকারি হিসাবেই প্রতি কেজি ধানের উৎপাদন খরচ ২৭ টাকা ৮৪ পয়সা আর চালের উৎপাদন খরচ ৪১ টাকা ৫৮ পয়সা। উৎপাদন খরচের সমান দাম নির্ধারণ করলে কৃষক লাভবান হবে কিভাবে।

এই সুযোগে মধ্যস্বত্বভোগীরা বাজার দখল করে নিচ্ছে। এ ব্যাপারে সরকার হস্তক্ষেপ করতে পারছে না। আরেক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, কৃষককে লাভবান করতে হলে কৃষক সমবায়ের ভিত্তিতে বাজারের সঙ্গে কৃষকের সরাসরি যোগাযোগ স্থাপন করতে হবে। যাতে কৃষক সরাসরি ভোক্তা পর্যায়ে তাদের পণ্য বিক্রি করতে পারে। তাহলে কৃষক লাভবান হবে।’

জানা গেছে, কৃষি উৎপাদন বাড়াতে সবচেয়ে বেশি দরকার ইউরিয়া সার। ভর্তুকি মূল্যে এই সার কৃষকদের সরবরাহ করে সরকার। গত বছর প্রতি বস্তা ইউরিয়া সারের দাম ছিল ৮০০ টাকা। চলতি বছর দাম বেড়ে হয়েছে ১১০০ টাকা।

প্রতি বস্তা ইউরিয়া সারে দাম বেড়েছে ৩০০ টাকা। অনেক সময় কৃত্রিম সংকট দেখিয়ে খুচরা পর্যায়ে আরও অনেক বেশি দামে ইউরিয়া সার বিক্রির অভিযোগ পাওয়া যায়। তবে ভর্তুকি মূল্যের টিএসপি, এমওপি ও ডিএপি সারের দাম বাড়েনি। তবে বেসরকারি উৎস থেকে কেনা অন্যান্য সারের দাম বেড়েছে অস্বাভাবিক হারে। এক বছরের ব্যবধানে প্যাকেটজাত প্রতি কেজি জিংক সার ৩০ টাকা বেড়ে হয়েছে ২৩০ টাকা। সালফার কেজিতে ৫০ বেড়ে হয়েছে ২৫০ টাকা। ২৫০ টাকা কেজির বোরন এবার দ্বিগুণ দামে ৫০০ টাকায় কিনতে হচ্ছে কৃষককে। এছাড়া আগাছা ও কীটপতঙ্গ দমনের বিষ এখন কৃষকের জন্য বিষফোঁড়া। কীটপতঙ্গের আক্রমণ থেকে রক্ষায় ফসলের অনুখাদ্য হিসাবে জমিতে দেওয়া হয় কার্বফুরান। গত বছর প্রতি কেজি কার্বফুরানের দাম ছিল ১৫০ টাকা। এবার কৃষককে তা কিনতে হচ্ছে ২৩০ টাকায়। ২০০ টাকার প্রতি কেজি সালফার এবার বিক্রি হচ্ছে ২৫০ টাকায়। ২৫০ টাকা কেজির বোরন দ্বিগুণ দামে ৫০০ টাকায় কিনছে কৃষক। ফলে অনেকেই কীটপতঙ্গের আক্রমণ থেকে ফসল রক্ষা করতে পারছে না। এতে ফলন কমছে। বিশেষ করে সবজি ক্ষেতে পোকা-মাকড়ের আক্রমণ হচ্ছে ব্যাপক ভাবে।

মানিকগঞ্জের ঘিওর এলাকার কৃষক আওলাদ হোসেন জানান, এক সময় কৃষি শ্রমিকদের দিয়ে ক্ষেতের আগাছা পরিষ্কার করা হতো। কিন্তু এখন আগাছা মারার জন্য ব্যবহার করা হয় রাসায়নিক। আগাছা পচানোর বিষ হিসাবে পরিচিত প্রতি লিটার গ্লাইফোসেট গত বছর পাওয়া যেত ৪৫০ টাকায়। এবার তার দাম ১০৪৫ টাকা। প্রতি লিটার প্যারাকোয়াট গত বছর ছিল ৪০০ টাকা। এবার দাম বেড়ে হয়েছে ৫৫০ টাকা।

মানিকগঞ্জের শিবালয় উপজেলার একজন ব্যবসায়ী জানান, বেসরকারি কোম্পানির প্যাকেটজাত সার ও কীটনাশকের দাম নির্ধারণে সরকারের কোনো নজরদারি নেই। তাই কোম্পানিগুলো ইচ্ছেমতো তাদের সার ও কীটনাশকের দাম বাড়ালেও কৃষকের বলার কিছু নেই। সরকারি তদারকি সংস্থাগুলোর দায়িত্বপ্রাপ্তরাও কোনো দিন এগুলোর দাম সম্পর্কে খোঁজখবর নেন না।

একাধিক কৃষকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শুধু কীটনাশক নয়, কীটনাশক ছিটানোর মেশিন, পাওয়ার টিলার, কাচি, নিড়ানিসহ সব ধরনের কৃষি উপকরণের দামও এখন আকাশচুম্বী। কীটনাশক স্প্রে করার একটি ছোট মেশিনের এক বছরের ব্যবধানে দাম বেড়েছে অন্তত ৩০০-৫০০ টাকা। বেড়েছে কৃষি শ্রমিকের মজুরিও।

ঘিওর উপজেলার পাওয়ার টিলার চালক আলম মিয়া জানান, ডিজেলের দাম বাড়ার কারণে জমি চাষ খরচ বেড়েছে অন্তত ৬০০ থেকে ১৬০০ টাকা পর্যন্ত। আগে প্রতি বিঘায় এক চাষ খরচ ছিল ৫০০ টাকা। এখন তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭০০ টাকা। পেঁয়াজ, রসুন, আলু আবাদের জন্য একটি জমিতে সর্বোচ্চ আটটি চাষ দেওয়ার প্রয়োজন হয়। সে হিসাবে প্রতি বিঘা পেঁয়াজ, আলু ও রসুন আবাদের জন্য চাষ খরচ বেড়েছে ১৬০০ টাকা। আর সরিষা আবাদে দিতে হয় তিন চাষ। এক্ষেত্রে চাষ খরচ বেড়েছে বিঘায় ৬০০ টাকা। এভাবে যে কোনো ধরনের ফসল আবাদেই চাষ খরচ বেড়েছে।

চৌবাড়ীয়া গ্রামের সবজি চাষী মতিয়ার রহমান বলেন, কীটনাশকের দাম অস্বাভাবিক বাড়ার কারণে সবজি চাষ ব্যাহত হচ্ছে। অধিক উৎপাদন খরচে চাষ করলেও গ্রামের বাজারে সবজির দাম বাড়েনি। অথচ আমাদের কাছ থেকে পাইকারি সবজি নিয়ে রাজধানীবাসীর পকেট কাটছে এক শ্রেণির মুনাফালোভী ব্যবসায়ী। আসলে লাভবান হচ্ছে মধ্যস্বত্বভোগীরা। ভোক্তারাও বলছেন, তারা দামের আগুনে পুড়ছেন। এই দামের সুফল পাচ্ছেন না প্রান্তিক কৃষক। তাহলে রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে ফসল ফলিয়ে কৃষকরা কি পাচ্ছেন। অনেক ক্ষেত্রে কৃষকদের লাভ দূরের কথা লোকসান হচ্ছে। যারা কিনে খাচ্ছেন তারা আবাদ করে খেলে বুঝতেন ফসল ফলানো কত কঠিন।

চৌবাড়ীয়া গ্রামের আরেক প্রভাবশালী গৃহস্থ বাবলু মিয়া যুগান্তরকে জানান, উৎপাদন খরচ বাড়ার কারণে তিনি চাষাবাদ করে আর পোষাতে পারছেন না। তাই এবার সব জমি বছরচুক্তিতে অন্য কৃষকের কাছে বিক্রি করে দিয়েছেন। শুধু ১ বিঘা জমিতে বেগুনের চাষ করার কথা তুলে ধরে তিনি আক্ষেপের সুরে বলেন, ‘আড়তে বেগুন নিলে ১০ টাকা কেজি বিক্রি করতে হয়। অথচ টেলিভিশনে খবরে দেখি ঢাকার শহরে মানুষ ৬০-৭০ টাকা কেজি বেগুন কিনে খান।’

বাবলু মিয়ার এ কথার সূত্র ধরে মানিকগঞ্জের সবজির আড়তে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শুক্রবার সকালে সেখানে বেগুন ১০ টাকা, মুলা ৮ টাকা, করলা ৩৫ টাকা, ফুলকপি ৪৫ টাকা, শসা ৫০ টাকা, ঢ্যাঁড়শ ৪০ টাকা, শিম ৪০ টাকা, পটোল ২৬ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়েছে। একই সময়ে ঢাকার আগারগাঁও কাঁচাবাজার সরেজমিন দেখা গেছে, এসব সবজি মানিকগঞ্জের আড়তের চেয়ে চার-পাঁচগুণ বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে। এই বাজারে এক মাত্র কাঁচা পেঁপে ছাড়া কোনো সবজি ৫০-৬০ টাকার নিচে বিক্রি করতে দেখা যায়নি। মানিকগঞ্জের ৫০ টাকা কেজির শসা এই বাজারে বিক্রি হচ্ছে ১২০ টাকা কেজি দরে।

জানা গেছে, এসব সবজির বীজের দাম আকাশচুম্বী। এক বিঘা জমিতে মুলা চাষ করতে ১ কেজি বীজ প্রয়োজন হয়। ১ কেজি মুলা বীজের দাম ৮ হাজার টাকা। ১ বিঘা জমিতে করলা চাষ করতে প্রয়োজনীয় ১ কেজি বীজের দাম ১৪ হাজার টাকা। ১ বিঘা পেঁয়াজ আবাদ করতে প্রয়োজনীয় ১ কেজি পেঁয়াজের বীজের দাম (জাত ভেদে) ৫ থেকে ২৬ হাজার টাকা। বীজের এই অগ্নিমূল্যে কৃষক দিশেহারা। বীজের সঙ্গে, চাষ ও সেচ খরচ, সার, কীটনাশকসহ অন্যান্য খরচ মিটিয়ে কৃষক লোকসান ছাড়া লাভের মুখ দেখেন খুব কম।

এ ব্যাপারে কৃষিবিদ মিজানুর রহমান বলেন, কৃষি মন্ত্রণালয়ের অধীনে কৃষি বিপণন অধিদপ্তর আছে। তারা কৃষকের উৎপাদন খরচের সঙ্গে মিলিয়ে দাম নির্ধারণ করে থাকে। তাদের দায়িত্ব বাজারে কোন ফসল কত দামে বিক্রি হবে তা নির্ধারণ করে দেওয়া। কিন্তু বাস্তবে তাদের কোনো তৎপরতা দেখা যায় না। মধ্যস্বত্বভোগীদের তৎপরতা বন্ধে সরকারি কোনো মেকানিজম নেই। বিদেশি সহায়তায় এলজিইডির মাধ্যমে ইউনিয়ন পর্যায়ে সরাসরি কৃষকের পণ্য বিক্রির কিছু উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তা জনপ্রিয়তা পায়নি।সূত্র: যুগান্তর