কিভাবে থামবে ইউক্রেনের সর্বনাশা সংঘর্ষ

সিল্কসিটিনিউজ ডেস্কঃ

উনিশ শতকের রুশ ঔপন্যাসিক ফিওদর দস্তয়েফিস্ক মানুষের মূল্যবোধগত তাঁর লেখা ‘ইডিয়ট’ গ্রন্থের জন্য বিশ্বব্যাপী খ্যাতি লাভ করেছিলেন। ‘ইডিয়ট’-এর কেন্দ্রীয় চরিত্র প্রিন্স মিশকিন একদিকে তাঁর পার্থিব কামনা-বাসনা, আধিপত্যবাদী লোভ-লালসা এবং চারিত্রিক একগুঁয়েমি কিংবা উচ্চাকাঙ্ক্ষার কারণে পর্যায়ক্রমিকভাবে অনেক অমার্জনীয় অপরাধমূলক কার্যকলাপ সংঘটিত করেছেন; অন্যদিকে খ্রিস্টীয় ও অন্যান্য মানবিক মূল্যবোধগত কারণে একজন পরিপূর্ণ আদর্শ (সুন্দর) মানুষ হিসেবেও তাঁকে চিত্রায়িত করা হয়েছে। প্রিন্স মিশকিনের এই আর্থ-রাজনৈতিক দ্বান্দ্বিক কিংবা সাংঘর্ষিক চরিত্র রূপায়ণকে অনেক ক্ষেত্রে নিজেও সহজভাবে গ্রহণ করতে সমর্থ হননি ঔপন্যাসিক দস্তয়েফিস্ক। তবু তাঁর চূড়ান্ত বিবেচনায় তিনি বলেছেন, ‘আমি এই উপন্যাসের সমর্থনে সম্পূর্ণভাবে দ্বিধাহীন না হলেও এর ভাবধারাকে সমর্থন করি।

’ ১৮৬৮-৬৯ সালে এই উপন্যাস প্রকাশিত হলেও তার ২০০ বছর পর আজও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে কিছু বোদ্ধা পাঠক বর্তমান রুশ শাসক ভ্লাদিমির পুতিনের মধ্যে প্রিন্স মিশকিনের চরিত্রের বেশ কিছু মিল খুঁজে পান বিভিন্ন মানবিক ও রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে।

সোভিয়েত-পরবর্তী রাশিয়ায় তার হারানো সভ্যতা, শক্তিমত্তা, সমৃদ্ধি, ঐতিহ্য এবং সর্বোপরি আর্থ-রাজনৈতিক ক্ষমতার পুনরুত্থান ঘটাতে চেয়েছিলেন বর্তমান রুশ শাসক ভ্লাদিমির পুতিন। কিন্তু এ ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদীরা রাশিয়া ও খণ্ডিত সাবেক সোভিয়েত অঞ্চলগুলোর ওপর তাদের আগ্রাসী প্রভাব বিস্তার করার চেষ্টা করেছে বারবার। কৃষ্ণ সাগরের উপকূলে অর্থাৎ পূর্ব ইউরোপীয় দেশগুলোতে, এমনকি বাল্টিক অঞ্চলে পশ্চিমাদের সে প্রচেষ্টা বা ষড়যন্ত্র এখনো অব্যাহত রয়েছে বলে অভিযোগ রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিনের। সে কারণেই অতীতে জর্জিয়া কিংবা বর্তমানে ইউক্রেনে সামরিক অভিযান চালিয়ে নিজেদের প্রভাববলয় কিংবা আঞ্চলিক স্বার্থ ও নিরাপত্তাব্যবস্থা টিকিয়ে রাখতে তৎপর হয়ে উঠেছেন প্রেসিডেন্ট পুতিন। তাঁর এই একাগ্র বাসনা ও আকাঙ্ক্ষা ছিল সাবেক অর্থাৎ ভেঙে পড়া সোভিয়েত শাসনাধীন অঞ্চল নিয়ে আবার এক শক্তিশালী রুশ প্রভাবাধীন অঞ্চল গড়ে তোলা। কিন্তু পশ্চিমা শক্তির প্ররোচনায় রাশিয়ার নিকটতম প্রতিবেশী ইউক্রেন রাষ্ট্রের ভিন্নতর চিন্তা-চেতনার কারণে চরম হুমকির মুখে পড়েছে পুতিনের সে অভিলাষ। শুধু    তা-ই নয়, তাতে আশঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে রাশিয়ার অখণ্ডতা ও প্রতিরক্ষাগত নিরাপত্তার প্রশ্নেও। মূলত সে কারণেই বর্তমানে রাশিয়ার এই সামরিক অভিযান, যা এখন দশম সপ্তাহে পড়তে যাচ্ছে।

এ অবস্থায় আগামী ৯ মে মস্কোর রেড স্কয়ারে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে রাশিয়ার ৭৭তম বিজয় দিবস উদযাপন। ১৯৪৫ সালের ৯ মে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালে এই রেড স্কয়ারেই রুশ সেনাদের কাছে আত্মসমর্পণ করেছিল পরাজিত জার্মান হামলাকারী বাহিনী। এদিন রেড স্কয়ারে মারিওপোলের স্টিল প্লান্ট ও তার আশপাশের অবরুদ্ধ কিংবা ভিন্ন অর্থে বলা যায়, পরাজিত কুখ্যাত (নাৎসিবাদী) আজব ব্রিগেডের সদস্যদের হাজির করার কথা ছিল রাশিয়ার। কিন্তু এ নিবন্ধ লেখার সময় পর্যন্ত (৩ মে ২০২২) যত দূর জানা গেছে, তাতে দেখা যায় আজভ বাহিনীর ইউক্রেনীয় যোদ্ধারা তখনো রুশ বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ কিংবা অস্ত্র সংবরণ করেনি। তবে জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসের রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে মস্কোতে অনুষ্ঠিত সাম্প্রতিক বৈঠকের ফলে শতাধিক আটকে পড়া নারী, শিশু ও বৃদ্ধকে মারিওপোল স্টিল প্লান্ট থেকে অন্যত্র সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। আগামী কয়েক দিনের মধ্যে আরো বেশ কিছু বেসামরিক ইউক্রেনীয়কে সরিয়ে নেওয়া হবে বলে জানা গেছে। এ অবস্থায় আটকে পড়া কিংবা অবরুদ্ধ আজভ ব্রিগেডের যোদ্ধাদের শেষ পর্যন্ত কী পরিণতি হবে, তা-ও স্পষ্ট করে কিছু বলা যাচ্ছে না। তদুপরি দক্ষিণ-পূর্ব ইউক্রেনের দোনবাস প্রদেশের বেশ কিছু এলাকায় এখনো চলমান রয়েছে রুশ সেনা ও ইউক্রেনীয়দের মধ্যে সশস্ত্র যুদ্ধ। দোনবাসের লুহানস্ক অঞ্চলেই বর্তমান রুশ অভিযান তীব্রতর হতে দেখা যাচ্ছে। এ অঞ্চলে রুশ সেনাসংখ্যা ও অস্ত্রশস্ত্র সরবরাহের পরিমাণ আরো বাড়ানো হয়েছে। অন্যদিকে ইউক্রেনীয় যোদ্ধারাও পশ্চিমা দেশগুলো থেকে অস্ত্রশস্ত্র ও সাহায্য-সহযোগিতা পাচ্ছে বলে মনে করা হচ্ছে। ভিডিও লিংকে ইউক্রেনীয় আইন প্রণেতাদের উদ্দেশে দেওয়া এক ভাষণে গত ৩ মে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন আরো ৩৭৫ মিলিয়ন ডলারের সহযোগিতা প্রদানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন এবং বলেছেন, বিজয় শেষ পর্যন্ত ইউক্রেনীয়দেরই হবে। তবে কবে নাগাদ এবং কিভাবে তা সম্পন্ন হবে, সে ব্যাপারে তিনি আর বিশেষ আলোকপাত করেননি।

ইউক্রেনে রাশিয়ার বর্তমান সামরিক অভিযানের কিভাবে ইতি টানা যায় কিংবা এ পর্যায়ে কিভাবে একটি যুদ্ধবিরতি প্রস্তাব গ্রহণ করে দুই দেশের মধ্যে একটি শান্তিপূর্ণ সমাধান নিশ্চিত করা যায়, তা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য কিংবা পশ্চিমা সামরিক জোট ন্যাটোর অন্য সদস্যরা কিছুই বলছে না। এ ক্ষেত্রে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়িপ এরদোয়ান ছাড়া কারো কোনো প্রচেষ্টা আছে বলে মনে হচ্ছে না। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভোলোদিমির জেলেনস্কি আগে দু-একবার শান্তি প্রতিষ্ঠার উদ্যোগের কথা বললেও পশ্চিমা শাসকদের সঙ্গে কথা বলে বারবার সে প্রচেষ্টা থেকে পিছিয়ে গেছেন। এতে মনে হচ্ছে, ইউক্রেনে তারা সবাই একটি দীর্ঘস্থায়ী সংঘর্ষের পক্ষে।

সে লক্ষ্যে যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনকে মিলিয়ন-বিলিয়ন ডলার অর্থ ও অস্ত্র সাহায্য দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে। চেকোস্লোভাকিয়া ও পোল্যান্ড থেকে ট্যাংক ও যুদ্ধবিমান পাঠানোর প্রক্রিয়া চলছে। রুশ সেনাদের এরই মধ্যে পশ্চিমাদের পাঠানো বেশ কিছু অস্ত্রশস্ত্র ধ্বংস করার খবরও পাওয়া গেছে। রুশ বাহিনী দক্ষিণ ইউক্রেনের ওডেসা বন্দর এলাকায় নতুন করে হামলার পরিমাণ বাড়িয়ে দিচ্ছে বলে জানা গেছে। রুশ পরিকল্পনার একটি উল্লেখযোগ্য দিক হচ্ছে, ইউক্রেনের দক্ষিণ-পূর্ব ও দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের বন্দর ও শিল্পাঞ্চলগুলো শিগগিরই দখলে নেওয়ার প্রাণপণ চেষ্টা করেও রুশ সেনারা সে ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ সফল হতে পারছে না।

ইউক্রেনের দক্ষিণ-পূর্বে মারিওপোল বন্দর ও শিল্প এলাকা এবং দক্ষিণ-পশ্চিমে ওডেসা বন্দর ও শিল্প এলাকা। মধ্যখানে কৃষ্ণ সাগরের উপকূলে ক্রিমিয়া বন্দর। ক্রিমিয়া ভৌগোলিক দিক থেকে কিছুটা বিচ্ছিন্ন একটি দ্বীপ হলেও তার সঙ্গে সংযোগ স্থাপনের জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছে রাশিয়া। রুশ সেনানায়করা ইউক্রেনের দক্ষিণের উপকূলীয় সমগ্র অঞ্চলটিকে মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন করে তাঁদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে মরিয়া হয়ে উঠেছেন, তবে এ ক্ষেত্রে অগ্রগতি পরিকল্পনা মোতাবেক হচ্ছে না। নির্ভরযোগ্য সূত্রে যত দূর জানা গেছে, সমগ্র ইউক্রেন দখল করা রাশিয়ার প্রকৃত উদ্দেশ্য নয়, তাতে ধ্বংস ও ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ অনেক বাড়বে। তবে রাশিয়া ইউক্রেনের নির্ভরযোগ্য সব সামরিক স্থাপনা ধ্বংস করে তাকে সামরিক দিক থেকে একটি সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ দেশে পরিণত করার পক্ষপাতী।

রাশিয়ার এ পরিকল্পনার বিরুদ্ধে এখন কাজ করছে পশ্চিমা সামরিক জোট ন্যাটো এবং ইউক্রেনীয় অবশিষ্ট সশস্ত্র বাহিনী। এর মধ্যে সবচেয়ে দুর্ধর্ষ ও মারাত্মক হচ্ছে মারিওপোলভিত্তিক আজভ ব্যাটালিয়ন কিংবা বাহিনী। আজভ সাগরকেন্দ্রিক এই বাহিনী ২০১৪ সাল থেকে নয়া নাৎসি আদর্শে বিশ্বাসী ইউক্রেনের একটি ন্যাশনাল গার্ড হিসেবে কাজ করছে। তাদের মূল দায়িত্ব ছিল ২০১৪ সালে রাশিয়া ইউক্রেনের ক্রিমিয়া বন্দর দ্বীপ দখলের পর থেকে ইউক্রেনের দক্ষিণ-পূর্ব ও অন্যান্য রুশভাষী অঞ্চলের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের মোকাবেলা করা। এই তথাকথিত নয়া নাৎসি বাহিনী দোনবাসের দোনেত্স্ক, লুহানস্ক ও মারিওপোলের রুশভাষী বিচ্ছিন্নতাবাদীদের নিশ্চিহ্ন করার কাজে নিয়োজিত ছিল। সে কারণেই রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিনের মারিওপোলের ওপর বিশেষভাবে অভিযান পরিচালনা করা। নয়া নাৎসিবাদীদের এই কথিত অঞ্চল থেকে নিশ্চিহ্ন করা প্রেসিডেন্ট পুতিনের একটি অগ্রাধিকারমূলক মিশন বলে বিবেচিত হচ্ছে। আজভ বাহিনীর সেনাসংখ্যা দুই হাজার পাঁচ শর মতো বলে ধারণা করা হচ্ছে। তবে এত কিছুর পরও তাদের সংখ্যা এখন হাজারখানেকের মতো বর্তমান রয়েছে বলে জানা গেছে। তবে মারিওপোল স্টিল প্লান্টকে কেন্দ্র তাদের একটি বিশাল অংশ এখন অবরুদ্ধ হয়েছে বলে জানা গেছে। পশ্চিমা সামরিক জোট ন্যাটো এখন আজভ বাহিনীর বাকি অংশ এবং অন্যদের প্রয়োজনীয় অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে একটি ‘প্রক্সি ওয়ার’ চালিয়ে যাওয়ার পক্ষপাতী। সে লক্ষ্যে ইউক্রেনীয়দের সার্বিক সাহায্য-সহযোগিতার আশ্বাস দেওয়া হচ্ছে প্রতিনিয়ত। যুদ্ধবিরতি কিংবা আলোচনা নয়, দীর্ঘস্থায়ী শক্তিশালী সশস্ত্র সংঘর্ষ চালিয়ে যাওয়ার পক্ষে পশ্চিমা সামরিক জোট। এতে ভীত নন রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিন। তিনি বলেছেন, রাশিয়ার ওপর হামলা কিংবা তার সার্বিক নিরাপত্তা বিঘ্নিত হলে তিনি সর্বাধুনিক হাইপারসনিক অস্ত্রশস্ত্র ব্যবহার করতে দ্বিধা বোধ করবেন না, যেগুলোর গতি শব্দের চেয়ে পাঁচ গুণ দ্রুততর।

এই মারাত্মক পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ও যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনসহ আরো অনেকে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক আদালতে যুদ্ধাপরাধের মামলা করার হুমকি দিয়েছেন। বলা হচ্ছে, পুতিন ইউক্রেনে গণহত্যা চালিয়েছেন। তবে এর পাশাপাশি প্রতিপক্ষের অভিযোগ হচ্ছে, জাতিংঘের সম্মতি ছাড়া যুক্তরাষ্ট্র একতরফাভাবে ইরাক ও আফগানিস্তানে হামলা করে বছরের পর বছর যে গণহত্যা চালিয়েছে, তার বিচার করবে কে? অনেক সংবাদ বিশ্লেষকের মতে, পুতিন পূর্ব ইউরোপে নিরাপত্তা ও শান্তি নিশ্চিত করতে চেয়েছিলেন। অর্থনৈতিক উন্নয়নের মাধ্যমে সমৃদ্ধি আনতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সেখানেই আপত্তি পুঁজিবাদী ও সাম্রাজ্যবাদী দেশের নেতাদের। তাঁরা যুদ্ধ বাধিয়ে ফায়দা লুটতে চান। তাঁদের শ্রেষ্ঠত্ব বজায় রাখতে চান। এরই মধ্যে ইউক্রেনের প্রায় ৬০ লাখ মানুষ শরণার্থী হয়েছে। মৃত্যুমুখে পতিত হয়েছে হাজার হাজার নিরস্ত্র নিরপরাধ মানুষ। দস্তয়েফিস্কর মতো তাই বলতে হয়, ‘বিপর্যয় নয়, সৌন্দর্যবোধই বিশ্বকে বাঁচাতে পারে। ’

লেখক : বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার (বাসস) সাবেক প্রধান সম্পাদক ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক
[email protected]

 

সূত্রঃ কালের কণ্ঠ