কার স্বার্থে প্রাথমিক শিক্ষা বোর্ড আইন?

সম্প্রতি প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় ‘প্রাথমিক শিক্ষা বোর্ড আইন-২০২১’ নামক একটি আইনের খসড়া তৈরি করে তাদের ওয়েবসাইটে সবার মতামতের জন্য উন্মুক্ত করেছে। প্রস্তাবিত এ আইনটি জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০, প্রস্তাবিত শিক্ষা আইন, ভিশন-২০৪১ এমন কী প্রস্তাবিত নতুন শিক্ষাক্রম ধারণার সঙ্গেও সাংঘর্ষিক।

সরকার একদিকে পরীক্ষার চাপমুক্ত সৃজনশীল ভবিষ্যৎ জাতি গড়ার কথা বলছে এবং যার অংশ হিসাবে প্রস্তাবিত শিক্ষাক্রমে প্রাক-প্রাথমিক থেকে উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত মূল্যায়ন ব্যবস্থায় বড় ধরনের পরিবর্তন আনছে দশম শ্রেণির পূর্বে সব পাবলিক পরীক্ষা পরিহার করে, শ্রেণিকক্ষে মূল্যায়নের ওপর গুরুত্ব দিচ্ছে; অন্যদিকে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রস্তাবিত আইনের খসড়া চূড়ান্ত করে বিপরীত মেরুতে অবস্থান নিয়েছে।

প্রস্তাবিত শিক্ষা আইনেও সহায়ক বইয়ের নামে ‘গাইডবই’ এবং এদিক-সেদিক করে কোচিং বাণিজ্যের বিষয়টি রেখেই দেওয়া হয়েছে। এমন বাস্তবতায় শিক্ষাকে আমরা পণ্যে পরিণত করে ফেলেছি। প্রস্তাবিত এ আইন চূড়ান্ত হলে ভবিষ্যতে একটি মুখস্থনির্ভর মানহীন জাতি তৈরি হবে, যেখানে সৃজনশীলতা হারিয়ে যাবে।

প্রস্তাবিত ‘প্রাথমিক শিক্ষা বোর্ড আইন-২০২১’ বাস্তবায়িত হলে পিইসি পরীক্ষা স্থায়ী রূপ পাবে, যা পক্ষান্তরে শিক্ষার্থীদের কোচিং ও গাইডবইনির্ভর করে তুলবে। এর ফলে গাইডবই ও কোচিং বাণিজ্যের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা লাভবান হলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তারা জাতীয় সম্পদের পরিবর্তে জাতীয় বোঝা হয়ে দাঁড়াবে। অনেকের মতে, এই আইনের মাধ্যমে স্বার্থান্বেষী কোনো মহলকে লাভবান করার চেষ্টা করা হচ্ছে।

প্রাথমিক শিক্ষা হলো একজন শিক্ষার্থীর জীবনের মূল ভিত্তি। সেটি যদি মুখস্থনির্ভর হয়, সৃজনশীল না হয়; তবে ব্রয়লার মুরগির মতো চার দেওয়ালে আবদ্ধ করে প্রতিপালন করা শিশু আগামী দিনে আমাদের আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে তেমন কোনো অবদান রাখতে পারবে না। ফলে বৈষম্য ও বিশৃঙ্খলা বৃদ্ধি পাবে।

বর্তমান প্রেক্ষাপটে আমরা একের পর এক শিক্ষার্থীদের প্রতিযোগিতামূলক পড়াশোনার দিকে ঠেলে দিয়েছি। ভালো জিপিএ অর্জনের জন্য একজন শিশুর সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর থেকে পড়াশোনা শুরু হয়। বাসে- রিকশায় মায়ের সঙ্গে যাওয়ার সময় পড়াশোনা চলতে থাকে, স্কুলে পড়া চলতে থাকে। স্কুল থেকে কোচিং, তারপর কোচিং থেকে বাড়ি না ফিরতেই গৃহশিক্ষক অপেক্ষা করেন শিশুর জন্য।

শিশুর পাশাপাশি শহরে শিশুর বাবা-মা থেকে শুরু করে বাড়ির কাজের লোকটিও দৌড়াতে থাকে। পড়ার জন্য মূল বই বাদ দিয়ে বিভিন্ন প্রকাশনীর বিভিন্ন গাইডবই প্রেসক্রিপশন আকারে দেওয়া হয়। প্রয়োজন না হলেও প্রতিষ্ঠানের চাপের কারণে তারা এসব কিনতে বাধ্য হন।

পিইসি পরীক্ষা স্থায়ী রূপ পেলে আগের মতো প্রশ্নপত্র ফাঁসের মতো গর্হিত অসাধুতার সঙ্গে কোমলমতি শিক্ষার্থীরা জড়িয়ে পড়বে। এ আইন প্রণয়নের মাধ্যমে কোনো স্বার্থান্বেষী মহল হয়তো শতকোটি টাকার গাইডবই বা কোচিং বাণিজ্যকেই পরোক্ষভাবে উৎসাহিত করছে।

জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০ অনুযায়ী, পঞ্চম শ্রেণির পরীক্ষাকে পাবলিক পরীক্ষা হিসাবে গণ্য করা হয়নি; বরং এ পরীক্ষার বিকল্প হিসাবে উপজেলা, পৌরসভা বা থানা পর্যায়ে সবার জন্য অভিন্ন প্রশ্নপত্রে সমাপনী পরীক্ষা নেওয়ার কথা বলা আছে। অতি উদ্বেগের সঙ্গে আমরা লক্ষ্য করছি, সরকার এ উদ্যোগ বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে তেমন কোনো পদক্ষেপই গ্রহণ করেনি।

সরকার বিনামূল্যে শতভাগ শিক্ষার্থীদের মূল পাঠ্যবই বিতরণ করছে বছরের প্রথম দিনে উৎসব করে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা খুব স্পষ্ট করে শিক্ষার্থীদের ওপর পরীক্ষার বোঝা কমানোর ব্যাপারে সংশ্লিষ্টদের বিভিন্ন সময় বলেছেন। তার প্রতিফলন আমরা নতুন শিক্ষাক্রম-২০২৫ এর রূপরেখায় দেখতে পেয়েছি, যেখানে পিইসি এবং জেএসসি পরীক্ষা রাখা হয়নি। বিষয়টি নাগরিক সমাজসহ সংশ্লিষ্ট সবার কাছে প্রশংসিত হয়েছে।

কিন্তু হঠাৎ করে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এমন আচরণ আমাদের সবাইকে উদ্বিগ্ন করছে। চলমান বাস্তবতা ও জাতীয় শিক্ষানীতিসহ অন্যান্য আইনের সঙ্গে কোনো প্রাসঙ্গিকতা নেই; বরং সাংঘর্ষিক।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রায় এক শতাব্দী আগে ‘তোতাকাহিনী’ লিখে গিয়েছিলেন। মূর্খ পাখিকে শিক্ষিত করার প্রজেক্ট দিয়ে মন্ত্রী, নায়েব থেকে শুরু করে রাজার আশপাশের লোকজনের আঙুল ফুলে কলা গাছ হয়। অথচ আসল উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন হয় না। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর চোখে আঙুল দিয়ে সেই তখনই এই মুখস্থনির্ভর তোতা পাখি তৈরির শিক্ষাব্যবস্থার নিন্দা করেছেন। আজকের শিক্ষাব্যবস্থায় শিশুরা শৈশবের চঞ্চলতা হারিয়েছে। পাঠ্যপুস্তকের চাপে ভারাক্রান্ত হয়ে তারা নাচ-গান, খেলাধুলাসহ সব সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সুযোগ বঞ্চিত হচ্ছে। যার ফলে সমাজে মাথাচাড়া দিচ্ছে উগ্রতা আর অসহিঞ্চুতা।

যুগোপযোগী বিজ্ঞানমনস্ক একটি আধুনিক জাতি গঠন হুমকির মুখে পড়েছে। আমরা তোতা পাখি তৈরির এক নোংরা খেলায় মেতে উঠেছি। কী রাষ্ট্র, কী শিক্ষক, কী অভিভাবক ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান-সব ক্ষেত্রেই এ প্রয়াস অব্যাহত। ছোট্ট শিশুদের পিঠের ব্যাগের ওজন এত বেশি যে, তারা মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়াতে পারে না। শিশুদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশের জন্য চাই আনন্দের সঙ্গে শিক্ষা গ্রহণ। উন্নত বিশ্বের স্কুলগুলোতে শিশুরা প্রথম দিন সেখানে গিয়ে একে অপরের সঙ্গে খেলাধুলা করতে করতে পরিচিত হয়। স্কুলগুলোতে শিশু মনোবিজ্ঞানীরা তাদের আচরণ পর্যবেক্ষণ করে সে অনুযায়ী শিখন প্রদান করে থাকেন। আর আমাদের দেশে কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মনোবিজ্ঞান বিষয় নিয়ে পাশ করা কয়েক হাজার শিক্ষার্থী বের হলেও তাদের কাজে লাগাচ্ছি না।

করোনায় বিপর্যস্ত পুরো দেশ। গত শিক্ষা বছরে করোনার কারণে একটি পরীক্ষাও নেওয়া সম্ভব হয়নি। চলতি শিক্ষা বছরেও পিইসি এবং জেএসসি পরীক্ষা নেওয়া হবে না বলেই সিদ্ধান্ত হয়েছে। অনেক অভিভাবক কর্ম হারিয়ে গ্রামে চলে গেছেন। বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থীর ঝরে পড়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। বাল্যবিয়ে ও শিশুশ্রম বৃদ্ধি পেয়েছে। নতুন করে অনেক মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে গেছে। যেখানে দেশের মানুষ নিজেদের জীবন ধারণের রসদ জোগাতে হিমশিম খাচ্ছে, সেখানে নতুন করে ‘প্রাথমিক শিক্ষা বোর্ড আইন-২০২১’ প্রণয়ন করে শিক্ষার্থীর অভিভাবকদের গাইড ক্রয়, কোচিংয়ের খরচ, প্রাইভেট টিউশনের খরচের দিকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে, যেটাকে এক কথায় বলা যায় ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’।

প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী গণমাধ্যমে বলেছেন, ‘বোর্ডের সুফল কুফল নিয়ে লেখালেখি হলে জাতি যদি না চায়, তখন তা পরিবর্তনও হতে পারে।’ তার এ বক্তব্যকে আমরা সাধুবাদ জানিয়ে বলতে চাই, ইতোমধ্যে যেহেতু প্রাথমিক শিক্ষা বোর্ড স্থাপনের ব্যাপারে দেশের বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, বিশেষজ্ঞ এবং গণমাধ্যম আপত্তি জানাচ্ছে, সেহেতু এই মেরুদণ্ড ধ্বংসকারী সিদ্ধান্ত থেকে মন্ত্রণালয় সরে এসে নতুন শিক্ষাক্রমের দর্শন বঙ্গবন্ধুর শিক্ষাদর্শন বাস্তবায়নে মনোযোগী হোক, যাতে দরিদ্র পরিবারের মেধাবী সন্তানরা আর্থিক সংকটের কারণে শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত না হয়।

সবার সমন্বিত উদ্যোগে ‘ভিশন-২০৪১’ এর লক্ষ্য অর্জন ও দেশকে প্রকৃত মধ্য আয়ের দেশ এবং উন্নত দেশে উন্নীত করতে সবার জন্য শিক্ষা নিশ্চিত করা অতীব জরুরি। আধুনিক শিক্ষায় সুশিক্ষিত, বিজ্ঞানমনস্ক ও তথ্যপ্রযুক্তিতে দক্ষ মানুষের উন্নত দেশ হিসাবে বাংলাদেশকে প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্য ‘ভিশন-২০৪১’ বাস্তবায়নের জন্য শিক্ষাই প্রধান ও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার। তাই জাতীয় বাজেটে শিক্ষা খাতে প্রয়োজনীয় বরাদ্দ নিশ্চিত করা এবং বরাদ্দকৃত অর্থের সুষ্ঠু ও যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করার পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।

ড. মোস্তাফিজুর রহমান : গবেষক ও লেখক

smostafiz_r@yahoo.com

 

সুত্রঃ যুগান্তর