কাতারে চাকরির জন্য দশ বছরে ১৭ হাজার কোটি টাকা খরচ বাংলাদেশিদের

ভাগ্য বদলের আশায় প্রতি বছর কাতারে পাড়ি জমান বহু বাংলাদেশি নাগরিক। কিন্তু তার জন্য দালালদের হাতে লাখ লাখ টাকার তথাকথিত ‘রিক্রুটমেন্ট ফি’ তুলে দিতে ঘর-বাড়ি বিক্রি করতে হয় অনেককে। তারপরও সঠিক চাকরির নিশ্চয়তা নেই। দেশে থাকতে যে আশ্বাস দেওয়া হয়, কাতারে গেলে দেখা যায় তার চেয়ে কঠিন কাজ দেওয়া হচ্ছে, বেতনও অনেক কম। ফলে রিক্রুটমেন্ট ফির জন্য ধারদেনা করা সেই অর্থ তুলতেই বছরখানেক লেগে যায় বেশিরভাগ কর্মীর। সম্প্রতি ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ানের এক অনুসন্ধানে উঠে এসেছে উদ্বেগজনক এই তথ্য।

বৃহস্পতিবার (৩১ মার্চ) এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২২ ফুটবল বিশ্বকাপের আয়োজক কাতারে চাকরির জন্য বাংলাদেশ-নেপালের মতো দেশগুলোর নিম্ন বেতনের অভিবাসী কর্মীদের গত এক দশকে কয়েকশ কোটি মার্কিন ডলার খরচ করতে হয়েছে।

অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ২০১১ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে কাতারে কাজের জন্য রিক্রুটমেন্ট ফি হিসেবে বাংলাদেশি অভিবাসীরা ১৫০ কোটি থেকে ২০০ কোটি মার্কিন ডলার (১৭ হাজার ২৮৫ কোটি টাকা প্রায়) খরচ করেছেন। আর নেপালি কর্মীরা ২০১৫ সালের মধ্যভাগ থেকে থেকে ২০১৯ সালের মধ্যভাগ পর্যন্ত দিয়েছেন ৩২ কোটি খেকে ৪০ কোটি ডলার।

jagonews24

কাতারের বিদেশি শ্রমশক্তির প্রায় এক-তৃতীয়াংশই বাংলাদেশ ও নেপালের নাগরিক। কিন্তু তাদের বেতন তুলনামূলক কম। কাতারে কাজের জন্য বাংলাদেশিদের সাধারণত তিন হাজার থেকে চার হাজার ডলার (আড়াই থেকে সাড়ে তিন লাখ টাকা) রিক্রুটমেন্ট ফি দিতে হয়, আর নেপালিরা দেন এক থেকে দেড় হাজার ডলার।

কিন্তু কাতারে গিয়ে মাসে মাত্র ২৭৫ ডলারও (২৩ হাজার ৭৬৬ টাকা) বেতন পান অনেকে। ফলে তাদের রিক্রুটমেন্ট ফির অর্থ তুলতেই চলে যায় অন্তত এক বছর।

গার্ডিয়ানের খবর অনুসারে, কাতারে রিক্রুটমেন্ট ফি দাবি করা বেআইনি। বাংলাদেশ-নেপালে এর জন্য রয়েছে সুনির্দিষ্ট সীমা। সীমার বাইরে গেলেই সেটিকে বেআইনি বলে ধরা হয়। কিন্তু তারপরও এসব দেশে অতিরিক্ত ফি দাবি করা বহুল প্রচলিত সাধারণ ঘটনা হয়ে উঠেছে।

jagonews24

আগ্রহীদের কাছ থেকে বিভিন্নভাবে রিক্রুটমেন্ট ফি হাতিয়ে নেওয়া হয়। প্রায়ই দেখা যায়, কাতারের কোম্পানি বা দালাল এবং কর্মী প্রেরণকারী দেশগুলোতে নিয়োগদাতা এজেন্টরা চাকরি দেওয়ার নামে কর্মীদের অর্থপ্রদানে বাধ্য করে। কাতারের উদ্দেশে রওয়ানা দেওয়ার আগেই এজেন্টদের হাতে এই অর্থ তুলে দিতে হয়।

এই ফি জোগাড় করতে গিয়ে অনেক সময় চড়া সুদে ঋণ অথবা ঘর-বাড়ি, জমি-জমা বন্ধক বা বিক্রি করে দেয় চাকরিপ্রার্থীর পরিবার। এতে আর্থিকভাবে তাদের অবস্থা আরও অরক্ষিত হয়ে পড়ে। এই দেনা পরিশোধ না হওয়া পর্যন্ত কর্মীরা চাকরি ছাড়তেও পারেন না। এটিকে ‘আধুনিক দাসত্বের একটি রূপ’ বলে উল্লেখ করেছে গার্ডিয়ান।

তা সত্ত্বেও লাখ লাখ বাংলাদেশি ও নেপালি কর্মী প্রতি বছর উপসাগরীয় অঞ্চলে ও এর বাইরে কাজের সন্ধানে ছোটেন। এর পেছনে স্বদেশে কাজের অভাব ও কম মজুরির কথা উল্লেখ করা হয়েছে। অনেকে ঝুঁকির কথা জেনেও দালালদের হাতে ফি তুলে দেন শুধু দীর্ঘমেয়াদে বেশি লাভের আশায়।

কাতারে নিযুক্ত নেপালের সাবেক রাষ্ট্রদূত নারদ নাথ ভরদ্বাজ এই অভ্যাসকে ‘ভয়াবহ গল্প’ বলে অভিহিত করেছেন। তার ভাষ্যমতে, ৯০ শতাংশের বেশি কর্মীকে রিক্রুটমেন্ট ফি পরিশোধ করে কাতার যেতে হয়।

তিনি বলেন, এই অর্থপ্রদান অবৈধ, এর বেশিরভাগই ঘটে টেবিলের নিচ দিয়ে। তাই কর্মীদের কাছে কোনো প্রমাণ থাকে না যে তারা অর্থ দিয়েছেন। অথচ দেড়-দুই লাখ নেপালি রুপি না দিলে তাদের কাজ মেলে না, ভালো চাকরির জন্য রেট আরও বেশি।

২০১৬ সালে কাতারে একটি চাকরির জন্য ৩ লাখ ৬০ হাজার টাকা দিয়েছিলেন আমান উল্লাহ নামে এক বাংলাদেশি। তাকে মাসে আড়াই হাজার কাতারি রিয়াল (প্রায় ৬০ হাজার টাকা) বেতনে ওয়েল্ডারের কাজ দেওয়ার আশ্বাস দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু কাতারে পৌঁছালে আমান উল্লাহকে মরুভূমির ভেতর একটি খামারে মাত্র ৮০০ রিয়াল (প্রায় ১৯ হাজার টাকা) বেতনের চাকরিতে নিয়োগ দেওয়া হয়।

jagonews24

সেই অভিজ্ঞতা জানিয়ে আমান উল্লাহ দ্য গার্ডিয়ানকে বলেন, কাজের কোনো সীমা ছিল না। ছিল না বিদ্যুৎ বা শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা। কম্পাউন্ড থেকে বেরও হওয়ারও অনুমতি ছিল না।

শেষমেষ বহু কেঁদেকেটে অসুস্থ মাকে দেখার কথা বলে দেশে ফেরার অনুমতি পান এই বাংলাদেশি কর্মী। কিন্তু দেশে ফেরেন অনেকটা খালি হাতেই। ততদিনে তার ঋণের বোঝা ফুলেফেঁপে আট লাখে দাঁড়িয়েছে। কাতার যাওয়ার ঋণ শোধ করতেই আরও ধারদেনা করতে বাধ্য হয়েছিলেন আমান উল্লাহ।

কাতার সরকার বলেছে, অবৈধ নিয়োগ কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত প্রতিষ্ঠানগুলোকে কঠোর শাস্তি দিচ্ছে তারা। সম্প্রতি ২৪টি রিক্রুটিং এজেন্সি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। কাতারের আইন ভঙ্গ করার জন্য তাদের লাইসেন্স বাতিল করা হয়েছে।

কাতার সরকারের এক মুখপাত্র বলেন, আমাদের বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক অভিবাসী সুরক্ষার জটিল চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে। তার অংশ হিসেবে কাতার নিজস্ব শ্রমবাজারে অবৈধ নিয়োগপ্রথা নির্মূল, হয়রানি বন্ধ ও শোষণ মোকাবিলায় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।

বাংলাদেশের প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. আহমেদ মুনিরুছ সালেহীন বলেন, বাংলাদেশ সরকার নিরাপদ, সুশৃঙ্খল, নিয়মিত ও দায়িত্বশীল কর্ম অভিবাসন নিশ্চিত করতে দৃঢ় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। নিয়োগে চড়া খরচের জন্য কর্মীপ্রেরক ও গন্তব্য উভয় দেশের মধ্যস্থতাকারীদের ‘ভিসা বাণিজ্যকে’ দায়ী করে তিনি বলেন, অন্যায় কর্মকাণ্ডের অভিযোগ পাওয়া গেলে রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর বিরুদ্ধে অবিলম্বে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হয়।

এ বিষয়ে নেপাল সরকারের কোনো মন্তব্য পাওয়া যায়নি।

 

সূত্রঃ জাগো নিউজ