‘কাঠগড়ায়’ বিএনপির নেতৃত্ব নির্বাচন

সিল্কসিটি নিউজ ডেস্ক :

অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে কঠিন চ্যালেঞ্জে বিএনপি। নানা ঘটনাপ্রবাহে টানা তিন মেয়াদ ক্ষমতার বাইরে থাকা দলটির সামনে এখন বড় পরীক্ষার নাম নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন নিশ্চিত করে সরকারের পতন। এ লক্ষ্যে গত জুলাই মাসের শেষভাগ থেকে এক দফার যুগপৎ আন্দোলনে দলটি। এসময় বিভিন্ন কর্মসূচিতে নেতাকর্মীদের আশানুরূপ সাড়াও মিলছে। কেন্দ্রের পাশাপাশি তৃণমূলে সাংগঠনিক ভিত্তি মজবুত করতে মরিয়া নীতিনির্ধারকরা। তবে বড়োসড়ো প্রশ্নের জায়গা তৈরি হয়েছে দলের নেতৃত্ব নির্বাচন প্রক্রিয়া নিয়ে। সরকারবিরোধী চূড়ান্ত আন্দোলনের সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়েও বিএনপি এবং এর অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনগুলোর নেতৃত্ব বেশ প্রশ্নবিদ্ধ। ধারণা করা হয়, সংগঠনকে সময়োপযোগী করে গড়ে তুলতে না পারায় গত দেড় দশকে রাজপথের আন্দোলনে ততটা সামর্থ্য নিয়ে টিকতে পারেনি বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ এ রাজনৈতিক দলটি।

অন্যদিকে এটাও সত্য যে, বাংলাদেশে বিএনপির ব্যাপক জনসমর্থন আছে। দেশের গণ্ডি পেরিয়ে সংগঠনটির পরিধি সম্প্রসারিত হচ্ছে বিদেশেও। তবে নেতৃত্ব নির্বাচনে দলের প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান যতটা ক্যারিশমাটিক ছিলেন বর্তমান হাইকমান্ডে তা বহুলাংশেই অনুপস্থিত। অতীতের মতো বর্তমানে সঠিক নেতৃত্ব নির্বাচন কেন হচ্ছে না, দলের ভেতরে-বাইরে এ প্রশ্নের পালে জোর হাওয়া লাগছে। উত্তর খুঁজতে গিয়ে স্থায়ী কমিটির সদস্য থেকে শুরু করে দেশ-বিদেশের দলের বিভিন্ন পর্যায়ে নেতাদের বক্তব্যে উঠে এসেছে ভিন্ন ভিন্ন বিশ্লেষণ ও অভিমত। তাদের অনেকে বলছেন, জিয়াউর রহমান সততা ও দেশপ্রেমের যে মানদণ্ডে নেতৃত্ব নির্বাচন করতেন বর্তমানে সে পন্থা অনুসরণ করা হচ্ছে না। এর পেছনে সামাজিক অবক্ষয় এবং ক্ষয়িষ্ণু রাজনীতির দায়ও দেখছেন তারা।

শুধু বিএনপি নয়, গোটা সমাজেই সঠিকভাবে নেতৃত্ব নির্বাচন হচ্ছে না। জিয়াউর রহমানের তুলনা তিনি নিজেই। তবে হ্যাঁ, জিয়াউর রহমানের সঙ্গে যারা রাজনীতি করেছেন তারা অনেকটাই সংযত। তাদের সততা, মিতব্যয় ও সাদামাটা জীবনযাপন এখনকার সময়ে বিরল। জিয়াউর রহমান ও খালেদা জিয়ার আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে বিশ্বস্ত ও নির্ভীক কর্মী তৈরি হয়েছে বলেই বিএনপি টিকে আছে। কর্মীরাই তো দল টিকিয়ে রেখেছেন। এখন যাদের নেতৃত্ব দিচ্ছেন তারেক রহমান।

বিএনপির বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের বক্তব্যে স্পষ্ট যে, পরিধি বাড়লেও দলে যোগ্য, মেধাবী ও মননশীল নেতৃত্বের অভাব রয়ে গেছে। নেতৃত্ব নির্বাচনে দলের প্রতিষ্ঠাতার মানদণ্ড মানা হচ্ছে না। এ কারণে বিএনপি বিগত বছরগুলোতে বিভিন্ন সময়ে আন্দোলনে থাকলেও কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে ব্যর্থ হয়েছে। দলের অন্য একটি অংশের নেতারা মনে করেন, খালেদা জিয়া কারান্তরীণ এবং তারেক রহমান দেশের বাইরে থাকলেও দুই শীর্ষ নেতার অনুপস্থিতিতে বর্তমান নেতৃত্বে বিএনপি যথেষ্ট ঐক্যবদ্ধ এবং সঠিক পথে রয়েছে। তাদের মতে, বড় রাজনৈতিক দলে সামান্য ভুল-ত্রুটি থাকবেই। এগুলো শুধরে শেষ পর্যন্ত রাজনৈতিক পরিপক্বতা দিয়ে মানুষের ভোটাধিকার ফিরিয়ে আনবে বিএনপি।

jagonews24বিপুল জনসমর্থনকে কাজে লাগাতে ব্যর্থ বিএনপি- সংগৃহীত ছবি

দলীয় সূত্র জানায়, ৪৫ পেরিয়ে ৪৬ বছরে পা রেখেছে বিএনপি। দীর্ঘ এ পথচলায় দলটি একাধিকবার রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন হয়েছে। জাতীয় সংসদে প্রধান বিরোধীদলের ভূমিকায়ও ছিল একাধিকবার। বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সবশেষ অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে সরকারে আসে। সেই সরকারের ২০০১-০৬ মেয়াদের শেষপ্রান্তে দেশে ওয়ান/ইলেভেনের উত্থান ঘটে। ২০০৮ সালের নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোটের কাছে ভূমিধস পরাজয়ের পর টানা প্রায় ১৫ বছর ক্ষমতা বলয়ের বাইরে বিএনপি। এরমধ্যে ২০১৪ সালে নির্বাচন বর্জন এবং ২০১৮ সালে ড. কামাল হোসেনকে ‘ইমাম’ মেনে নির্বাচনে গিয়ে আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক কৌশলের কাছে পরাজিত হয় দলটি। এরই মধ্যে দুর্নীতির একাধিক মামলায় কারাগারে যান খালেদা জিয়া। অন্যদিকে ১৫ বছর আগে ২০০৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বর দেশ ছেড়েছিলেন তারেক রহমান। সেই থেকে তিনি লন্ডনে অবস্থান করছেন। দেশের আদালতে একাধিক মামলায় তিনিও দণ্ডপ্রাপ্ত। রাজপথে দলের দুই শীর্ষ নেতার দীর্ঘকালীন অনুপস্থিতি এবং দলটির সাংগঠনিক বাস্তবতায় গত ১৫ বছরে বিভিন্ন সময় বিএনপির সরকার পতনের আন্দোলন মুখ থুবড়ে পড়ে।

বিএনপির দপ্তর সূত্রে জানা গেছে, প্রায় অর্ধশতাব্দীর পথচলায় দলের কেন্দ্র থেকে ওয়ার্ড পর্যায় পর্যন্ত নেতৃত্ব রয়েছে। সারাদেশে জেলা পর্যায়ে দলের ৮২টি সাংগঠনিক ইউনিট এবং বিশ্বের অন্তত ৪০টি দেশে বিভিন্ন পর্যায়ে বিএনপি এবং অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের কমিটি রয়েছে।

আমাদের নেতা তারেক রহমান বর্তমানে দল থেকেই গড়ে ওঠা নেতৃত্বকে প্রাধান্য দিচ্ছেন। আমাদের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী ছাত্রদল থেকে এসেছেন। মহানগর উত্তরের আহ্বায়ক আমানউল্লাহ আমান ছাত্রদল থেকে এসেছেন। আমি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি, আমাদের অভিভাবক তারেক রহমানের হাত ধরেই বিএনপির বর্তমান নেতৃত্ব আগামীতে দেশের নেতৃত্ব দেবে।

১৯৮১ সালের ৩০ মে বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান নিহত হন। পরবর্তীকালে ১৯৮২ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত দলটির নেতৃত্বের সোনালি যুগ ধরা হয়। জিয়াউর রহমানের অবর্তমানেও তার বিশেষ নেতৃত্বের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে ওই সময় বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষ বিএনপিমুখী হয়। তাদের মধ্যে অনেকে ছিলেন রাজনীতিতে ডায়নামিক ব্যক্তিত্বের অধিকারী। যাদের পেশাগত দক্ষতা এবং পারিবারিক প্রভাবে দেশের বিভিন্ন এলাকা বিএনপির ঘাঁটি হিসেবে পরিচিতি পায়। বৃহৎ এ রাজনৈতিক দলটির ক্ষয়ের চোরাস্রোত তৈরি হয় ২০০১ সালে জামায়াতকে সঙ্গে নিয়ে চারদলীয় জোট গঠনের মধ্য দিয়ে। সেবার বিএনপি-জামায়াতের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগকে হারিয়ে চারদলীয় জোট সরকার গঠন করলেও সেখান থেকেই মূলত বিএনপির নেতৃত্বের ক্ষয়িষ্ণু ধারা সূচনা হয়। তখন বিএনপিতে দুর্নীতিগ্রস্ত নেতাদের প্রভাব বাড়তে থাকে। সিন্ডিকেটের মাধ্যমে মনোনয়ন বাণিজ্য এবং অর্থের বিনিময়ে কমিটি দিয়ে যোগ্য ও ত্যাগী নেতাদের বঞ্চিত করার বিস্তর অভিযোগ প্রকাশ্যে আসতে থাকে।

দেড় দশক ধরে কার্যত রাজনীতিতে খাদের কিনারায় বিএনপি। দলটি এখন দল নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলন করছে। আওয়ামী লীগের ক্ষমতার টানা তিন মেয়াদের বিভিন্ন সময়ে বিএনপি তীব্র আন্দোলনের হাঁকডাক দিলেও তা প্রতিধ্বনি হয়েই ফিরে গেছে। সম্প্রতি সরকার পতনের আন্দোলনেও উঁকি দিচ্ছে সেই চিত্র। গত বছরের ৭ ডিসেম্বর বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে পুলিশি অভিযানের পর এর প্রতিবাদে নয়াপল্টনে গিয়েছিলেন দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তখন এই হাইভোল্টেজ নেতার সঙ্গে একমাত্র ছিলেন নির্বাহী কমিটির সদস্য অ্যাডভোকেট আবেদ রাজা। এরপর সরকার পতনের এক দফা আন্দোলন কর্মসূচি পালন করতে গিয়ে গত ২৯ জুলাই আবারও মারাত্মকভাবে ধাক্কা খায় বিএনপি। প্রশ্ন ওঠে বিএনপি ও অঙ্গ সংগঠনসমূহের সাংগঠনিক সক্ষমতা এবং নেতৃত্বের গুণমান নিয়ে।

ক্ষমতার বাইরে থাকলেও সারাদেশে বিপুল জনসমর্থন রয়েছে বিএনপির। এরপরও দাবি আদায়ের আন্দোলনে দলটি কেন বারবার ব্যর্থ হচ্ছে? এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে বিএনপির বিভিন্ন স্তরের দায়িত্বশীল একাধিক নেতার মতামত পাওয়া গেছে। তারা কথা বলেছেন সংগঠনের বর্তমান হালচাল ও নেতৃত্ব নির্বাচনে মূল্যায়ন পদ্ধতি নিয়েও।

jagonews24তরুণ ও যোগ্য নেতৃত্বের প্রত্যাশা সবার-সংগৃহীত ছবি

বিএনপির সাবেক মহাসচিব প্রয়াত খোন্দকার দেলোয়ার হোসেনের বড় ছেলে মানিকগঞ্জ জেলা বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ড. খোন্দকার আকবর হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, জিয়াউর রহমানের সময় নেতৃত্ব নির্বাচনের ক্ষেত্রে সততা ও দেশপ্রেমের যে মানদণ্ড ছিল সত্যি কথা বলতে এখন সেটা নানা বাস্তবতায় সময়ের সঙ্গে অনেকটাই পরিবর্তন হয়েছে। এখন এক পরিস্থিতি তখন ছিল অন্য পরিস্থিতি। এখন ক্ষমতার লড়াইয়ে অর্থসহ আরও অনেক কিছু প্রয়োজন। সময়ের চাহিদায় নেতৃত্ব নির্বাচনেও পরিবর্তন এসেছে।

দলের নির্বাহী কমিটির সদস্য ও মৌলভীবাজার-২ আসনে বিএনপির সম্ভাব্য প্রার্থী (যদি বিএনপি নির্বাচনে অংশ নেয়) অ্যাডভোকেট আবেদ রাজা বলেন, যখন দেশের রাজনীতি বিঘ্নিত হয়, যখন দেশ স্বৈরশাসকের কবলে থাকে, তখন মানুষের অধিকার কিংবা ব্যক্তিস্বাধীনতা থাকে না। রাজনীতিও ক্ষয়িষ্ণু ধারায় প্রবাহিত হয়। এখনকার সময়ে গণআন্দোলন যেভাবে সংঘটিত হচ্ছে, সেখানেও কিছু মানুষের অংশগ্রহণ বাড়ছে। এর মধ্য দিয়েই দেশের রাজনীতি পরিশুদ্ধ জায়গায় যাবে বলে বিশ্বাস করি।

স্বেচ্ছাসেবকবিষয়ক সম্পাদক মীর সরাফত আলী সপু বলেন, নেতৃত্ব নির্বাচনে অবশ্যই এখনো সততার মাপকাঠি বহাল আছে। ভাত খেলে তো দু-একটা দানা ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়বেই। কিছু এদিক-ওদিক তো হতেই পারে। কিন্তু আমাদের সততা না থাকলে ১৫ বছর পরও এত জনসমর্থন থাকতো না। আজ বিএনপিকে মানুষ কেন চায়? মানুষ জানে, একটা সুন্দর নির্বাচন হলে বিএনপি রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব পাবে।

কেন্দ্রীয় যুবদল নেতা মাহমুদুল হাসান বাপ্পী বলেন, বিএনপির অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনগুলোর সারাদেশে শক্তিশালী সাংগঠনিক ভিত্তি রয়েছে। কিন্তু সব সংগঠনের সাংগঠনিক ভিত্তি সারাদেশে সমান নয়। কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যন্ত নেতাকর্মীদের মধ্যে বর্তমান নেতৃত্বের প্রতি অগাধ আস্থা রয়েছে।

স্বেচ্ছাসেবক দলের সভাপতি এস এম জিলানী বলেন, বিএনপির নেতৃত্ব শতভাগ স্বচ্ছতার মধ্য দিয়ে নির্বাচিত হয়। আমরা স্বেচ্ছাসেবক দলেও স্বচ্ছতার মাধ্যমে নেতৃত্ব নির্বাচন করি। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় যেখানে ভোট হওয়া প্রয়োজন সেখানে ভোট করি। সিলেকশন করে ভালো হলে সেটাও করি। তবে যেটুকু দেখেছি, সবার সঙ্গে আলোচনা করে কমিটি দিলে এর সুফল পাওয়া যায়।

সাংগঠনিক নেতৃত্ব নির্বাচন প্রক্রিয়া সম্পর্কে কৃষক দল সভাপতি হাসান জাফির তুহিন বলেন, প্রায় সব ক্ষেত্রেই আমাদের নেতাকর্মীদের অভিন্ন মতামত হচ্ছে, চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দলের চেয়ারপারসন বা ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান নেবেন। তবে উনারা ব্যক্তিগতভাবে কোনো সিদ্ধান্ত নেন না। সংশ্লিষ্ট নেতাকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে তাদের মতামত নিয়েই সিদ্ধান্ত নেন। সুতরাং নেতৃত্ব নির্বাচনে বিএনপি সবচেয়ে বেশি গণতান্ত্রিক ধারা অনুসরণ করে।

অন্য এক প্রশ্নে তিনি বলেন, কৃষকরা সবসময় রাজনীতিতে সম্পৃক্ত থাকে না। তবে, স্বাধীনতা আন্দোলনের মতো বৃহৎ যে কোনো পরিবর্তনে কৃষকরা অপরিসীম ভূমিকা রাখে। আগামীতেও ইনশাল্লাহ্ পরিবর্তন হবে। আর সেই পরিবর্তনে বাংলার কৃষক সমাজ সম্পৃক্ত হবে বলে আমি বিশ্বাস করি।

দলের শিক্ষাবিষয়ক সম্পাদক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. ওবায়দুল ইসলাম বলেন, জিয়াউর রহমান সৎ, দক্ষ ও দেশপ্রেমিকদের দলে সর্বাধিক গুরুত্ব দিতেন। এ কারণে আজও বাংলাদেশে বিএনপি এক নম্বর দল। বিএনপির এসময়ের নেতাকর্মীরাও তার আদর্শকেই ধারণ ও লালন করেন।

ঢাকা মহানগর বিএনপির সদস্য সচিব আমিনুল হক বলেন, আমি যখন বিএনপির রাজনীতিতে যোগদান করি, এরপর থেকেই দেখবেন অনেক খেলোয়াড় বিএনপিতে এসেছেন। অনেকে এখনো আসছেন। আবার অনেক ভালো ভালো পরিবারের সদস্যরা বিএনপিতে আসার চিন্তা করেন, কিন্তু তারা আসেন না। কারণ, দেশের রাজনীতিতে যে মামলা-হামলা ও গুম-খুনের সংস্কৃতি তৈরি হয়েছে, যেভাবে বাকস্বাধীনতা হরণ করা হচ্ছে, এ পরিস্থিতিতে তাদের অনেকে রাজনীতিতে আসতে চান না।

দল এখন অতীতের চেয়ে অনেক বড় হয়েছে। এ প্রসার অব্যাহত আছে। নেতার সংখ্যাও বেড়েছে। আগে থানা পর্যায়ে নেতৃত্ব তৈরি করতে আমাদের লোক খুঁজতে হতো। এখন ইউনিয়ন পর্যায়ে নেতৃত্ব নিয়ে প্রতিযোগিতা চলে। এত বড় দলে সব জায়গায় সবসময় সবকিছু সঠিকভাবে যাচাই-বাছাই করে নেতৃত্ব নির্বাচন সম্ভব হয় না। কিছুটা ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকেই। এগুলো বড় করে না দেখে বরং সামগ্রিকভাবে যে দল সামনের দিকে এগোচ্ছে সেদিকেই তাকানো উচিত।

বর্তমানে বিএনপিতে সাবেক ছাত্রনেতাদের মূল্যায়ন প্রসঙ্গে জানতে চাইলে দলটির সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক মো. সেলিমুজ্জামান সেলিম বলেন, আমাদের নেতা তারেক রহমান বর্তমানে দল থেকেই গড়ে ওঠা নেতৃত্বকে প্রাধান্য দিচ্ছেন। আমাদের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী ছাত্রদল থেকে এসেছেন। মহানগর উত্তরের আহ্বায়ক আমানউল্লাহ আমান ছাত্রদল থেকে এসেছেন। আমি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি, আমাদের অভিভাবক তারেক রহমানের হাত ধরেই বিএনপির বর্তমান নেতৃত্ব আগামীতে দেশের নেতৃত্ব দেবেন।

জাতীয়তাবাদী মহিলা দলের সাধারণ সম্পাদক সুলতানা আহমেদ বলেন, এত ধরপাকড়, জুলুম-নির্যাতন আর গুম-খুনের মধ্যেও নেতাকর্মীরা দল ধরে রেখেছে। এজন্য তারা ক্রেডিট পাওয়ার যোগ্য বলে আমি মনে করি।

দেশের চিকিৎসক সমাজকে রাজনীতির মূল স্রোতধারায় ফেরাতে বিএনপির ভূমিকা প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত গোপালগঞ্জ-২ আসনের সম্ভাব্য প্রার্থী ডক্টরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ড্যাব) এর সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক কে এম বাবর আলী বলেন, মেধাবী চিকিৎকদের রাজনীতির মূল স্রোতধারায় ফেরাতে বিএনপি নানা উদ্যোগ নিয়েছে। যার প্রমাণ বিএনপিপন্থি চিকিৎসকদের সংগঠন ড্যাব।

ইতালি বিএনপির সাধারণ সম্পাদক ঢালী নাসির উদ্দিন বলেন, নেতৃত্বের ধারাবাহিকতায় বিএনপি এখন সময়োপযোগী সংগঠনে পরিণত হয়েছে। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে প্রবাসীরা বিভিন্ন দেশ থেকে যেমন স্বাধীনতার পক্ষে সংগঠিত হয়ে ভূমিকা রেখেছেন, তেমনই গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে বিএনপি এখন ভূমিকা রাখছে।

https://cdn.jagonews24.com/media/imgAllNew/BG/2023March/bnp-4-20230920190757.jpgকর্মসূচিতে ব্যাপক সাড়া পেলেও কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অধরা-সংগৃহীত ছবি

কিশোরগঞ্জ জেলা বিএনপির সভাপতি শিল্পোদ্যোক্তা মো. শরিফুল আলম বলেন, সময় পরিবর্তন হয়েছে। আমাদের বাবা-মায়েরা যেভাবে কষ্ট করে আমাদের লালন-পালন করতেন, এখন কিন্তু ঠিক সেরকমটি নেই। এখন সন্তান লালন-পালনে কিছুক্ষেত্রে কৃত্রিমতা এসেছে। এত কিছুর পরও আমি মনে করি দল সঠিক পথে আছে। আমি ব্যবসায়ী পরিবারের সন্তান। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট মানিয়ে নিয়ে আমি আমার অবস্থান থেকে চেষ্টা করে খাপ খাওয়াতে পেরেছি।

দলের প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের জন্মস্থান বগুড়া অঞ্চলের নেতা বিএনপির মিডিয়া সেলের সদস্য ও জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক আতিকুর রহমান রুমন বলেন, সংগঠন এবং নেতৃত্বের মূল্যায়ন নিয়ে অনেক সময় অনাঙ্ক্ষিত কিছু ভুল হয়! ওই ভুলগুলো আগামীতে যেন না হয়, সে বিষয়ে আমরা আরও বেশি সজাগ থাকবো, ইনশাআল্লাহ্!

তিনি বলেন, অবশ্যই একটি সঠিক মানদণ্ডে নেতৃত্ব নির্বাচন হয়। কালের বিবর্তনে এবং চলমান সময়ের চাহিদা অনুযায়ী অনেক ক্ষেত্রে কিছুটা পরিবর্তন করা হলেও জিয়াউর রহমানের আদর্শের বাইরে গিয়ে কিছুই করা হয় না। অতীতে সাংবাদিকতা পেশা থেকে এসে দলে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন, এমন নজিরও আছে। বর্তমানেও কয়েকজন সাংবাদিক দলীয় বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত।

জাতীয় পার্টি থেকে বিএনপিতে যোগ দেওয়া আবদুস সালাম এখন ঢাকা মহানগর দক্ষিণের আহ্বায়ক এবং দলের চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা। তিনি বলেন, অনেক কিছু ছোঁয়াচে আছে। স্বাধীনতার পর আওয়ামী লীগ দেশকে যেখানে নিয়ে গিয়েছিল, পরবর্তীকালে ১৯৯৬ সালে এসব সংক্রামক ব্যাধির কিছু প্রভাব তো সমাজে পড়বেই। কিন্তু বিএনপি খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে এবং পরবর্তীসময়ে তার অনুপস্থিতিতে তারেক রহমানের নেতৃত্বে এসব বাধা-বিপত্তি অতিক্রম করে এগিয়ে যাচ্ছে। আগামী দিনেও বিএনপি জনগণের দল হিসেবে এগিয়ে যাবে।

দলের সহ-শ্রমবিষয়ক সম্পাদক ফিরোজ উজ জামান মামুন মোল্লা বলেন, এখন নেতৃত্ব নির্বাচনের ক্ষেত্রে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান সংশ্লিষ্টদের মতামত নিয়ে চূড়ান্ত যাচাই-বাছাই করেন। আমাদের জোরালো শ্রমিক সংগঠন থাকা সত্ত্বেও সরকারের চাপে ঠিকভাবে কাজ করতে পারি না। এরপরও আমরা কাজ করছি। শ্রমিক দিবসে বিশ্বের সর্ববৃহৎ শোভাযাত্রা জাতীয়তাবাদী শ্রমিক দল আয়োজন করে। দেশের সাড়ে ছয় কোটি শ্রমিকের অধিকার প্রতিষ্ঠায় আমরা নিরলস কাজ করছি।

বিএনপির আইনবিষয়ক সম্পাদক ব্যারিস্টার কায়সার কামাল জাগো নিউজকে বলেন, আসলে বিএনপিতে কোনো মনোনয়ন বাণিজ্য বা কমিটি বাণিজ্য হয় না। এগুলো সবই প্রতিপক্ষের অপপ্রচার।

বিএনপির ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত নোয়াখালী অঞ্চল থেকে নির্বাচিত সাবেক সংসদ সদস্য দলটির যুগ্ম মহাসচিব ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন বলেন, বিএনপির আদর্শ জাতীয়তাবাদ। জিয়াউর রহমান বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের তত্ত্ব দিয়ে গেছেন। এ তত্ত্ব এত জনপ্রিয় যে, আজ দেশের ৮০ শতাংশের বেশি মানুষ এটি পছন্দ করেছে। এ তত্ত্ব সামনে রেখেই বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া তিনবার প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। এরশাদের আমল থেকে বিভিন্ন সময়ে বিএনপি ভাঙার ষড়যন্ত্র ও চেষ্টা হয়েছে। জাতীয়তাবাদের রাজনীতি শেষ করে দেওয়ার চেষ্টা করছে। কিন্তু পারেনি। সবার শ্রমে ও মেধায় বিএনপি আরও বেশি জনপ্রিয় দল হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

jagonews24নেতৃত্বের গুণেই বাধার মুখে এগিয়ে যাচ্ছে বিএনপি-ফাইল ছবি

নেতৃত্ব নির্বাচনের ক্ষেত্রে জিয়াউর রহমানের সময়ে সততা ও দেশপ্রেমের মানদণ্ড আর এখনকার মানদণ্ডের মাত্রা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ডেমোক্রেসিতে শতভাগ সৎ ও যোগ্য নেতৃত্ব পাবেন তা নয়। তারপরও তুলনামূলক বিএনপিতে ভালো নেতৃত্ব রয়েছে। সততার জন্যই বিএনপিকে জনগণ আজও পছন্দ করে।

একই অঞ্চল থেকে নির্বাচিত দলের সাবেক এমপি বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান মো. শাহজাহান বলেন, নেতৃত্বের গুণমান সঠিক আছে বলেই এত বাধা-বিপত্তির মুখেও বিএনপি এগিয়ে যাচ্ছে। গুণমানের সংকট থাকলে তা হতো না। এক কথায় বলতে গেলে, জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর থেকে দল বহু প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে চলেছে। আজও সেই প্রতিকূলতা মাড়িয়েই দল এগিয়ে চলছে। তারপরও আমাদের প্রত্যাশা সঠিক ও যোগ্য নেতৃত্বেই আগামীতে দল এগিয়ে যাবে।

অনেক কিছু ছোঁয়াচে আছে। স্বাধীনতার পর আওয়ামী লীগ দেশকে যেখানে নিয়ে গিয়েছিল, পরবর্তীকালে ১৯৯৬ সালে- এসব সংক্রামক ব্যাধির কিছু প্রভাব তো সমাজে পড়বেই। কিন্তু বিএনপি খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে এবং পরবর্তী সময়ে তার অনুপস্থিতিতে তারেক রহমানের নেতৃত্বে এসব বাধা-বিপত্তি অতিক্রম করে এগিয়ে যাচ্ছে। আগামী দিনেও বিএনপি জনগণের দল হিসেবে এগিয়ে যাবে।

তিনি বলেন, দল এখন অতীতের চেয়ে অনেক বড় হয়েছে। এ প্রসার অব্যাহত আছে। নেতার সংখ্যাও বেড়েছে। আগে থানা পর্যায়ে নেতৃত্ব তৈরি করতে আমাদের লোক খুঁজতে হতো। এখন ইউনিয়ন পর্যায়ে নেতৃত্ব নিয়ে প্রতিযোগিতা চলে। এত বড় দলে সব জায়গায় সবসময় সবকিছু সঠিকভাবে যাচাই-বাছাই করে নেতৃত্ব নির্বাচন সম্ভব হয় না। কিছুটা ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকেই। এগুলো বড় করে না দেখে বরং সামগ্রিকভাবে যে দল সামনের দিকে এগোচ্ছে সেদিকেই তাকানো উচিত।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, বর্তমান যে রাষ্ট্রব্যবস্থা তাতে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো ধ্বংস হয়ে গেছে। সবকিছু মিলিয়ে সমাজমানসের মেধা ও মননে ধস নেমেছে। আগে যারা রাজনীতি করতেন তারা দেশকে নিয়েই ভাবতেন। এখনকার রাজনীতিকরা কি দেশকে নিয়ে ততটা ভাবেন? বরং তারা নিজেদের নিয়েই বেশি ভাবিত। যারা শুধু নিজেদের নিয়ে ভাবেন তারা দেশকে কিছুই দিতে পারেন না। এই সমাজ থেকেই তো রাজনীতিবিদের জন্ম হয়। ছাত্র রাজনীতি থেকে কয়জন ছাত্রনেতা জাতীয় পর্যায়ে এসেছে। পদ পেলেই তো নেতা হওয়া যায় না। মন্ত্রী-এমপি হলেই তো নেতা হওয়া যায় না। নেতা হতে বিশেষ বৈশিষ্ট্য থাকা লাগে। সেদিক থেকে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে নেতৃত্বে ভাটা পড়েছে। রাজনীতি না করেও অনেকে মন্ত্রী-এমপি হয়েছেন। অন্যদিকে রাজনীতি করতে করতে উপরে উঠেছে এরকম নেতার এখন সংকট।

জিয়াউর রহমান যে মানদণ্ডে নেতৃত্ব নির্বাচন করতেন এখন সেভাবে নেতা নির্বাচন হচ্ছে কি না- এমন প্রশ্নে বিএনপির এ জ্যেষ্ঠ নেতা বলেন, শুধু বিএনপি নয়, গোটা সমাজেই সঠিকভাবে নেতৃত্ব নির্বাচন হচ্ছে না। জিয়াউর রহমানের তুলনা তিনি নিজেই। তবে হ্যাঁ, জিয়াউর রহমানের সঙ্গে যারা রাজনীতি করেছেন তারা অনেকটাই সংযত। তাদের সততা, মিতব্যয় ও সাদামাটা জীবনযাপন এখনকার সময়ে বিরল। জিয়াউর রহমান ও খালেদা জিয়ার আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে বিশ্বস্ত ও নির্ভীক কর্মী তৈরি হয়েছে বলেই বিএনপি টিকে আছে। কর্মীরাই তো দল টিকিয়ে রেখেছেন। যাদের এখন নেতৃত্ব দিচ্ছেন তারেক রহমান।