কাঁদে না শুধু বড় মানুষের মন

সিল্কসিটিনিউজ ডেস্ক:

আমি বাংলাদেশের সবচেয়ে গরিব এলাকার একজন সাধারণ কৃষক। উন্নয়নের ট্রেন ধরতে না পারায় দারিদ্র্য বাড়ছে আমাদের এলাকায়। নীলফামারীর ডোমার, ডিমলা, জলঢাকাসহ অনেক এলাকার গৃহস্থ, প্রান্তিক কৃষক কিংবা ক্ষুদ্র উদ্যোক্তার কষ্টে পাথরও কাঁদছে। কাঁদে না শুধু বড় মানুষের মন। লাভ-ক্ষতির অঙ্ক আমরা কষতে পারি না। কষলেই অদৃশ্য একটা লোহার বল বুকের ভেতর আছড়ে পড়ে। সে আছাড়ে কেউ মরে, কেউ না মরে আধমরার মতো বেঁচে থাকে। সে আছাড়ে অনেকেই হৃদ্‌যন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মরে। এই তো আমার প্রতিবেশী সাবান আলী গত মে মাসেই মেয়ে ও বোনের সংসারে অভাবের কালবৈশাখী দেখে ও আসন্ন দুর্গতি কল্পনা করে সকালবেলা টুপ করে মরে গেল। আর কেউ কেউ হয়তো আমার মতো না মরে আধমরা হয়ে বেঁচে থাকে। তবে আমার মতো বেঁচে থাকতে হলে তাকে অনেক সাধনা করতে হয়। প্রশ্ন উঠবে, কেমন সেই সাধনা? উত্তর: জটিল নয়, খুবই সরল সে সাধনা।

গেল বছর দুবিঘা জমিতে বিআর-২৮ জাতের ধান বর্গাতে চাষ করেছিলাম। দুসের ধানও পাইনি। কেউ বলে জলবায়ুর অভিঘাত, কেউ বলে নিম্নমানের বীজ দায়ী। এবার বুক শক্ত করে দুবিঘায় হীরা-২ (হাইব্রিড) চাষ করেছি। ধান দেখে সুখে বুক ভরে গিয়েছিল। ধান কাটার এক সপ্তাহ আগে কালবৈশাখীতে সব শেষ।

গত ঈদুল আজহার আগে মোটাতাজাকরণের উদ্দেশ্যে পাঁচটি দেশি জাতের এঁড়ে বাছুর কিনি। আনুষঙ্গিক খরচসহ মোট ব্যয় হয় দেড় লাখ টাকা। ১০ মাস লালনপালনের পর ভারতীয় গরুর দেদার প্রবেশাধিকারের কল্যাণে এখন বাজারমূল্য সর্বোচ্চ আশি হাজার টাকার মতো। এই হলো অর্থনীতিতে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করা একজন প্রান্তিক যুব কৃষকের হাল-হকিকত। শুধু আমি একা নই; আমার এলাকার অগণিত কৃষকের এখন একই বর্তমান। এ শুধু মন্দভাগ্য কৃষকদের পরিণতি হলেও না হয় কথা ছিল, কিন্তু সৌভাগ্যবান কৃষকদের কপালও ইঁদুরের কপাল থেকে বড় নয়। এক বিঘা থেকে পাঁচ বিঘা জমি চাষাবাদ করে জীবনের সার্থকতা খুঁজে নেয় আমার এলাকার কৃষকেরা।

সেই পাঁচ বিঘাওয়ালা জমির কৃষকের বুক আর পেটের চিত্রটাও খুব বেশি যে সমৃদ্ধ নয়, তার প্রমাণ মিলবে ছোট্ট একটি হিসাবে। যদি ফসল মার না যায়, তাহলে পাঁচ বিঘা জমি আবাদ করে ছয় মাসে জোটে ২৫ হাজার টাকা। উন্নয়নের মহাসড়কে ফিটনেস বজায় রেখে এই ২৫ হাজার টাকায় একজন পাঁচ বিঘাওয়ালা কৃষককে টানা ছয় মাস চলতে হবে বা হচ্ছে।

ভাবছেন, এমন ফিটনেস নিয়েও কোথাও এরা প্রতিবাদ করে না কেন? করে, তবে সেটা ক্ষমতাবানের দরবারে নয়, অদৃশ্য ভাগ্যবিধাতার দরবারে। আর বুকের ভেতর জমা কফের মতো আক্ষেপগুলো বউ-বাচ্চার আবদারের জবাবে চোটপাট করে উগরে দিয়ে! খাদ্য স্বয়ংসম্পূর্ণতার দাবিদার দেশের মূল কারিগরদের এই অবস্থার জন্য বস্তুত দায় কার?

না, আমরা কাউকে আমাদের দুর্ভাগ্যের জন্য দায়ী করি না, করতে পারি না! আমরা কৃষকেরা দোষারোপের সংস্কৃতিতে বিশ্বাস করি না। ওটাতে আমাদের মুনশিয়ানাও নেই। আমাদের গলা ছোট, আওয়াজ ছোট, ভাষা ছোট। তির্যক বা কড়া ভাষায় জবাব দেওয়ার বিদ্যাতেও আমরা খাটো। যদি সুস্পষ্টভাবে জবাব দিতে যাই যে কে আমাদের এমন দুর্ভাগ্যের জন্য প্রচ্ছন্নভাবে কলকাঠি নাড়ছে? তাহলে চোখে আঙুল ঢুকিয়ে দিয়ে বলতে হয় সাহেবদের কথা, ভদ্রদের কথা, স্বঘোষিত উন্নয়নের চালকের দাবিদারদের তৈরি করা বাজারব্যবস্থার কথা। তাদের সম্মিলিত অবহেলা আমাদের কাবু করে রেখেছে!

বললে গোল বেধে যাবে। তেড়ে এসে বুকের পাঁজর ধরে বলবে, ‘যত বড় মুখ নয়, তত বড় কথা!’ হ্যাঁ, আমাদের ভুলগুলো খুবই ছোট, তাই আমরা কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছি।

নীলফামারীর ডিমলা উপজেলার প্রত্যন্ত বন্দর খড়িবাড়ি গ্রামে জন্মগ্রহণ করি ৮৪ সালে। ভূমিষ্ঠ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমার স্বাধীন রাষ্ট্রটির রাজনীতিক, সুশীল, গণমাধ্যম ও বিভিন্ন অংশীজন আমার কানের কাছে বলল, যদি তুমি সুনাগরিক হও, রাষ্ট্রের প্রতি অনুগত হও, মূল্যবোধ ধারণ করো, বিপথগামী কিংবা বিপজ্জনক না হও, তাহলে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় সব সুযোগ-সুবিধা তোমার হাতের মুঠোয় পৌঁছে দেওয়া হবে। আমি বিশ্বাস করলাম। পাঁচ বছর বয়সে বাবাকে হারিয়ে ক্ষুধা-অনটনের সঙ্গে লড়াই করে পড়ালেখা চালাতে থাকলাম। বিজ্ঞান বিভাগ থেকে এসএসসি প্রথম শ্রেণি পাই। পরে এইচএসসি, এরপর অর্থনীতিতে অনার্স, মাস্টার্স। আর এর মাঝে সাধনাটাও সরল। ঢাকায় গিয়ে গার্মেন্টসে হেলপারি, এলাকায় পান-বিড়ির দোকানদারি, সোয়েটারের ভারী কসেস টানা, মিরপুরে রিকশা চালানো, মানুষের বাসায় লজিং থাকা ও পল্লী বিদ্যুতে চাকরি করা।

কঠিন হয়েছিল তখন, যখন অন্যায়-দুর্নীতির সঙ্গে আপস না করে ভরা অফিসে প্রতিবাদ করে শেষ পর্যন্ত চাকরি ছেড়ে দিই। পদত্যাগপত্রে লিখে দিই, অন্যায় না করা, দুর্নীতি না করা ও আপসকামী না হওয়ায় অফিস আমার প্রতি বৈরী। এ কারণে শিক্ষাগত যোগ্যতার অনেকগুলো সনদ থাকলেও আমি পরিত্যক্ত হলাম, কর্মসংস্থান হলো না। রাষ্ট্র, রাজনীতিক, সুশীল, গণমাধ্যম, কেউ কথা রাখল না। এলাকায় যৌতুক ছাড়া বিয়ে অস্বাভাবিক রেওয়াজ। আমি সে রেওয়াজ অতিক্রম করেছি। পকেটের পয়সা খরচ করে বিয়ে করেছি। এখন দুই বছরের ফুটফুটে একটি ছেলে নিয়ে কথাসাহিত্যিক সমরেশ মজুমদারের ‘কালবেলা’, ‘কালপুরুষ’-এর নায়ক অনিমেষের মতো লেংচে লেংচে দিন যাপন করছি। চারপাশের সবাই বাবা-মায়ের দেওয়া সেলিম নামটা ঢেকে নতুন নাম ‘ব্যর্থ’ ‘অযোগ্য’ বলে ডাকতে শুরু করেছে। পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র ভর্ৎসনা করতে বিন্দুমাত্র কার্পণ্য করছে না।

আমারও গন্ডারের চামড়া। জবাব দিই, ‘বাংলাদেশে অনেকেই আমার মতো!’ এদিকে আমার হবু উন্নত রাষ্ট্রটি বলে বেড়াচ্ছে, ‘এখানে উন্নয়ন পাওয়া যায়!’ আমি কী করে বলি যে ‘আমার ভাগের উন্নয়ন কোথায়?’ উন্নয়ন পাওয়াও যায় বৈকি! সে উন্নয়ন পাওয়ার জন্য যোগ্যতা থাকতে হয়! যে যোগ্যতায় মা, মাটি, দেশ, মূল্যবোধের চিরন্তন নীতিগুলো হয়ে যায় স্রেফ পণ্য। আমার মতো অনেকেই সেসব যোগ্যতার সূচকগুলো অর্জন করতে অসমর্থ। ফলে আমাদের মতো লোকের ভাগ্যে উন্নয়নও জোটে না। যদি উন্নয়ন, সুশাসন, গণতন্ত্র ও সংবিধানের একচুল বিশুদ্ধ স্বাদ আমরা পেতাম, তাহলে আমাদের জীবন এমন হতো না। কিন্তু উন্নয়নের রোল মডেল রাষ্ট্রটি আমার মতো অসংখ্য সেলিমকে সুকৌশলে রকমারি অযোগ্যতার তকমা দিয়ে গৌণ করে রেখেছে।

হতাশায় নিজেকে ক্লীব বানাতে ইচ্ছে করে খুব; হয়তো তাহলে আর কোনো অভিযোগ থাকত না। কিন্তু পরক্ষণে থমকে যাই। না, আমি, আমরা কি এতই দুর্বল! কতটা দুর্বল আমরা যে বাংলাদেশ মায়ের এত এত রূপ, রস পেয়েও শতকরা ৫ ভাগ লোকের হাতে মাকে অরক্ষিত রেখে পালিয়ে যাব? না, মা, মাটি, দেশের দাবি ছেড়ে আমরা পালাব না।