করোনায় হুমকির মুখে প্রিন্টিং শিল্প

করোনাভাইরাসের কারণে চরম সঙ্কটে পড়েছে রাজধানীর প্রিন্টিং ও প্যাকেজিং শিল্প। অন্যান্য সময় বছরের শেষদিকে (নভেম্বর-ডিসেম্বর) প্রিন্টিং প্রেস ও প্যাকেজিং কারখানাগুলোতে চরম ব্যস্ততা থাকলেও চলমান পরিস্থিতিতে আগের সেই চিত্র এ বছর অনুপস্থিত।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিগত একশো বছরেও এমন দুরাবস্থা হয়েছে বলে তারা শোনেননি। এমন অবস্থায় হতাশা ভর করেছে এই শিল্পে জড়িত হাজার হাজার মানুষের মনে।

সরেজমিন গিয়ে দেখা গেছে, রাজধানীর অনেক প্রিন্টিং-প্যাকেজিং কারখানার শ্রমিকরা অলস সময় পার করছেন। আগের মতো অর্ডার না থাকায় মালিকপক্ষ অনেক শ্রমিককে ছাঁটাই করতে বাধ্য হচ্ছেন। যারা টিকে আছেন, তারা ঢিমেতালে কাজ করে সময় পার করছেন।

কথা বলে জানা গেছে, চলতি মৌসুমে ছাপাখানাগুলোতে ক্যালেন্ডার, ডায়েরি ও নোটপ্যাডের আশানুরূপ অর্ডার না থাকায় প্রেস ব্যবসায়ীরা ক্ষতির মুখে পড়েছেন। অনেকটা ‘বিড়ালের ভাগ্যে শিকে ছেঁড়ার’ আশায় প্রতিদিন দোকান খুলছেন ব্যবসায়ীরা।

jagonews24

দীর্ঘদিন ধরে দেশের প্রায় সব সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার পর পুনরায় চালু হলেও প্রেসে আসছে না কাঙ্খিত কাজ।

প্রতি বছর অক্টোবর থেকে জানুয়ারি পর্যন্তু ডায়েরি, ক্যালেন্ডার ও নোটপ্যাড তৈরিতে ব্যস্ত সময় পার করেন রাজধানীর বিখ্যাত প্রিন্টিং হাউজ আজাদ প্রোডাক্টস-এর শ্রমিকরা। এবার তাদের কাজ কমে গেছে ৫০ শতাংশ।

প্রতিষ্ঠানটির জেনারেল ম্যানেজার মোস্তফা কামাল রোববার  বলেন, ‘গত ৫ মাস প্রিন্টিং প্রেস বন্ধ থাকার পর সম্প্রতি প্রিন্টি-প্যাকেজিং খানিকটা সচল হয়। তবে এবার মৌসুমি অর্ডার মোটেও আগের মতো নেই। আমাদের প্রায় দেড় শতাধিক কর্মীর বেতন দেয়াও কঠিন হয়ে পড়েছে।’

তবে আগামী মাস অর্থাৎ ডিসেম্বরে কাজের পরিমাণ বাড়বে বলে আশা করেন আজাদ প্রোডাক্টসের এই কমকর্তা।

আজাদ প্রোডাক্টসের নিয়মিত ক্রেতা এস আর ইন্টারন্যাশনালের স্বত্ত্বাধিকারী ইউসুফ আলী বলেন, ‘প্রতিবছর আমরা ৫ হাজার ডায়েরি তৈরি করলেও এবার মাত্র দু’হাজার করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’

jagonews24

পুরানা পল্টনের নিউ কার্টুনে গিয়ে দেখা যায়, চারজন বিক্রেতা দোকান খুলে বসে আছেন।

নিউ কার্টুন প্রোডাক্টসের ম্যানেজার এফ এম আরুর আলী জানান, বর্তমানে নিয়মিত ক্রেতা পাওয়া যাচ্ছে না। কদাচিৎ যে দু-একজন পরিচিত ক্রেতা আসছেন, তারা আগের তুলনায় অর্ধেক কাজের অর্ডার দিচ্ছেন।

তিনি বলেন, ‘সাধারণত প্রতিবছর অক্টোবর থেকে জানুয়ারি পর্যন্তু প্রায় চার লাখ ক্যালেন্ডার করে থাকি আমরা। অথচ এবার নভেম্বর মাস চলে যাচ্ছে, অথচ এক লাখেরও অর্ডার পাইনি। ডায়েরি বিক্রি হয়েছে মাত্র হাজার পাঁচেকের মতো। এত কম কাজ নিয়ে কারখানাগুলো চালু রাখতে পারছি না। কর্মী ছাঁটাই করতে হচ্ছে। এটা প্রতিষ্ঠানের জন্য দুঃসংবাদ। তবে আশা করছি, আগামী দু’মাসের মধ্যে যে বিক্রি হবে তাতে শ্রমিকদের বেতন দিয়ে প্রতিষ্ঠান টিকিয়ে রাখাতে পারব।’

রাজধানীর বৃহত্তর ছাপাখানা এলাকা বাংলা বাজারে গিয়েও একই চিত্র দেখা গেছে।

রংবাহারী প্রোডাকশনে গিয়ে দেখা যায়, ২০ জন শ্রমিক ঢিলেঢালাভাবে কারখানায় কাজ করছেন। বড় ধরনের অর্ডারের চাহিদা না থাকায় ছোট ছোট কাজ দিয়ে কারখানা চলছে।

প্রতিষ্ঠানটির ম্যানেজার মনসুর আলী বলেন, ‘করোনাকালীন সময়ে ক্রেতারা কাজের অর্ডার বন্ধ করে দিয়েছে। এজন্য বাংলা বাজার এলাকার অনেক ছাপাখানা বন্ধ হয়ে গেছে। বছরের শেষ তিনমাস ডায়েরি ও ক্যালেন্ডার বিক্রি করে আমাদের সারাবছর চললেও এবার আর সেই অবস্থা নেই। কাজ না থাকায় অর্ধেক শ্রমিক ছাঁটাই করতে হয়েছে। মনে হচ্ছে কারখানা আর চালু রাখা যাবে না।’

পাশেই মনোরমা প্রোডাকশনেও একই অবস্থা। কাজের অভাবে তাদের শ্রমিকের সংখ্যা নেমেছে ২৪ থেকে ৬ জনে। কাজ না থাকায় অনেক শ্রমিকই পেশা বদল করতে বাধ্য হয়েছে বলে জানান তারা।

এদিকে, প্রতিবছর অন্তত অর্ধকোটি টাকা মূল্যের প্রমোশনাল প্রকাশনা বের করে ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি। কিন্তু আর্থিক সঙ্কটের কারণে এবার কোনো ধরনের প্রকাশনা বের করা হচ্ছে না বলে জানান প্রতিষ্ঠানটির জনসংযোগ বিভাগের প্রধান কর্মকর্তা আবু শাহাদাত।

jagonews24

তিনি বলেন, ‘গত মার্চ থেকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। ক্লাস চলছে অনলাইনে। এ কারণে এবার ডেস্ক ক্যালেন্ডার, পরীক্ষার খাতা, নোট প্যাডসহ অন্যান্য অনেক প্রকাশনা না ছাপানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।’

বাংলাদেশ প্রিন্টিং এন্ড প্রোডাকশন এসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ শাহ্জাহান বলেন, ‘কাজের অভাবে প্রিন্টিং প্রেস, ডিজাইন হাউজ, বাইন্ডিং কারখানা ও শোরুমগুলো বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম। মার্কেটে ক্রেতা নেই, তাই কাজ আসছে না। কেউ কেউ সামান্য কাজ পেলেও অনেকেই কারখানা বন্ধ রাখতে বাধ্য হচ্ছে। এমন পরিস্থিতি চলতে থাকলে এ শিল্পে ধস নামবে।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমরা বছরে তিন মাস বেশি কাজ পেয়ে থাকি। এতেই আমাদের সারা বছর চলে যায়। কিন্তু এবার নভেম্বর শেষ হলেও কারখানায় কাজ আসছে না। তার ওপর সরকারকে পাঁচ শতাংশ ভ্যাট দিতে হচ্ছে।’

চলমান পরিস্থিতিতে শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে সরকারের কাছে ভ্যাট মওকুফের দাবি জানান এই নেতা।

 

সূত্রঃ জাগো নিউজ