করোনায় লন্ডভন্ড বাংলাদেশের শ্রম বাজার

সারা পৃথিবীতেই চলছে করোনা তাণ্ডব। এতে লন্ডভন্ড এখন বাংলাদেশের শ্রম বাজার। বাংলাদেশের শ্রমিকদের এখন অন্য দেশে যাওয়া দূরে থাক, উল্টো কয়েক লাখ প্রবাসী  বাংলাদেশি দেশে ফেরত আসতে পারেন বলে জানাচ্ছেন সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা।

বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় শ্রম বাজারগুলো হচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে। বিশ্বে তেলের দাম তলানিতে ঠেকাসহ অর্থনৈতিকভাবে বিপাকে পড়ায় বিদেশি জনবল ছাঁটাই করছে এসব দেশের কর্তৃপক্ষ। মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন দেশ থেকে জোর করে পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে বাংলাদেশি  শ্রমিকদের। ইতিমধ্যে এক হাজারের বেশি শ্রমিককে দেশে ফিরিয়ে আনা হয়েছে। এখন পর্যন্ত প্রায় তিন হাজারের বেশি শ্রমিককে দেশে ফিরিয়ে আনাদের তালিকায় নাম রয়েছে।

প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের একজন শীর্ষ কর্মকর্তা  বলেন, দেড় থেকে দুই লাখ শ্রমিক হয়তো পর্যায়ক্রমে দেশে ফেরত আসতে পারেন। বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যের দেশ সৌদি আরব, ওমান, কাতার, কুয়েত, বাহরাইনসহ বেশ কয়েকটি দেশ থেকে শ্রমিক ফিরিয়ে আনার জন্য চাপ রয়েছে। আমাদের মন্ত্রী এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী দুজনই নীতিগতভাবে একমত হয়েছেন। যেসব দেশে শ্রমিকরা খুবই সমস্যায় আছেন। আমরা পর্যায়ক্রমে তাদেরকে ফিরিয়ে আনব।

ওই কর্মকর্তা বলেন, ইতিমধ্যে প্রায় দেড় হাজারের বেশি শ্রমিককে দেশে ফিরিয়ে  আনা হয়েছে। কুয়েত, আমিরাত, বাহরাইন ও সৌদি আরব থেকে বিভিন্ন ফ্লাইটে এসেছেন। করোনার এমন পরিস্থিতিতে দেড় থেকে দুই লাখ প্রবাসী দেশে ফেরত আসতে পারেন-  সেটি নির্ভর করছে ওইসব দেশের পরিস্থিতি কেমন হয় তার ওপর।

সদ্য পদোন্নতি পাওয়া প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. আহমেদ মুনিরম্নছ সালেহীন বলেন, ‘শ্রম বাজারের বর্তমান পরিস্থিতি মোকাবেলায় আন্তঃমন্ত্রণালয়ের উচ্চ পর্যায়ের কমিটি কাজ করছে। যেসব দেশে শ্রমিকরা সমস্যয় আছেন, ওইসব দেশের সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কূটনৈতিকভাবে যোগাযোগ চলছে। ৩০টি মিশনের মাধ্যমে প্রায় ১০ কোটি টাকা শ্রমিকদের জন্য বরাদ্দ করা হয়েছে।

অভিবাসন ও মানব পাচারবিষয়ক গবেষণা প্রতিষ্ঠান রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটিং মুভমেন্টস রিসার্চ ইউনিটের (রামরু) চেয়ারপারসন অধ্যাপক ড. তাসনিম সিদ্দিকী বলেন, ‘জনশক্তি নিয়ে কাজ করা বেসরকারি ১৬টি সংগঠন মিলে জাতিসংঘের মহাসচিবের কাছে আমরা একটি চিঠি পাঠিয়েছি। সেই চিঠিতে দাবি করা হয়েছে,  এভাবে প্রবাস থেকে জোর করে দেশে ফেরত পাঠিয়ে দেওয়া আন্তর্জাতিক আইনের পরিপন্থী। প্রধানমন্ত্রী এখন পৃথিবীর যত মাল্টিলেটারাল ফোরাম রয়েছে সেগুলোকে ব্যবহার করে এই যে, প্রবাসী শ্রমিকদের ওপর রাষ্ট্রগুলো যে অন্যায় করছে সেটি তুলে ধরবেন প্রধানমন্ত্রী।

ব্র্যাক মাইগ্রেশন প্রোগ্রামের প্রধান ও অভিবাসন বিশ্লেষক শরিফুল হাসান বলেন, ‘এখন পর্যন্ত যেসব শ্রমিককে দেশে পাঠানো হয়েছে, তাদের বেশিরভাগকেই ডেপোর্টেশন সেন্টার থেকে ফেরত পাঠানো হয়েছে। এ পর্যন্ত দেড় হাজারের বেশি শ্রমিক এসেছে। এখন পর্যন্ত বিভিন্ন দেশের কর্মহীন বৈধ শ্রমিক কিংবা অবৈধ শ্রমিকদের পাঠানো শুরু হয়নি। কেবল  অবৈধ শ্রমিক, যাদের বৈধ কাগজপত্র নেই, যারা সৌদি আরবে তথাকথিত ফ্রি ভিসার নামে গেছেন- এমন শ্রমিকই আছেন সেখানে প্রায় তিন থেকে চার লাখ। মালয়েশিয়ায় বৈধ কাগজপত্রহীন প্রবাসী আছেন লক্ষাধিক, কুয়েতে ২০ হাজারের বেশি। সব মিলিয়ে পাঁচ থেকে ১০ লাখ প্রবাসী শ্রমিক আছেন যাদের বৈধ কাগজপত্র নেই। এসব শ্রমিকদের দেশে ফেরত পাঠিয়ে দেওয়া হলে কঠিন অবস্থার মধ্যে পড়বে শ্রম বাজার। এর মধ্যে করোনা উদ্ভুত পরিস্থিতিতে কর্মহীন হয়ে পড়া শ্রমিকরা দেশে ফিরলে ভয়ঙ্কর বিপর্যয় দেখা দেবে।

শরিফুল হাসান আরো বলেন, একটি আশার কথা বলি, সামনের দিনগুলোতে ওইসব দেশগুলো কিন্তু আবারো ঘুরে  দাঁড়ানোর চেষ্টা করবে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে, অর্থনীতি চাঙ্গা করতে আপ্রাণ চেষ্টা থাকবে। তবে ঘুরে দাঁড়াতে চাইলে বিপুল পরিমাণ শ্রমিক দরকার হবে তাদের, কম পারিশ্রমিকের শ্রমিক প্রয়োজন পড়বে। সেই দিনগুলোর কথা মাথায় রেখেই এখনই আমাদের কূটনৈতিক তৎপরতা বাড়াতে হবে।

অভিবাসী বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ফেব্রুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত  আমাদের প্রায় দুই লাখ প্রবাসী শ্রমিক দেশে ফেরত এসেছেন। পাশাপাশি বাংলাদেশ থেকে প্রায় চূড়ান্তভাবে নির্বাচিত দেড় লাখের বেশি শ্রমিক সেখানে যেতে পারেননি। এছাড়া এক কোটি প্রবাসীর বেশিরভাগের এখন হাতে কোনো কাজ নেই। মধ্যপ্রাচ্যসহ বেশ কয়েকটি দেশ আমাদের শ্রমিকদের ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য চাপ দিচ্ছে। তারা অলিখিতভাবেই বলছেন, আমরা যদি এই বাংলাদেশিদের এখনই ফিরিয়ে না নেই, তাহলে ভবিষ্যতে তারা আমাদের কাছ থেকে কোনো  কর্মী নাও নিতে পারেন। কূটনৈতিকভাবে আমরা ওইসব রাষ্ট্রগুলোর কাছে যেন আহ্বান জানাতে পারি, যেন তারা  শ্রমিকদের দেশে ফেরত পাঠাতে না পারে। করোনা উদ্ভুত পরিস্থিতিতে শ্রম বাজার একটি বড় ধরনের সংকটের মধ্যে পড়ে গেছে দেশ। ইতিমধ্যে একটি সংখ্যায় প্রবাসীরা দেশে ফেরত আসতে বাধ্য হয়েছেন। আগামীতে আরো হয়তো আসবেন, এসব শ্রমিক পুনরায় ওইসব দেশে ফেরত যেতে পারবেন কি-না, সেটার নিশ্চয়তা নেই।

অভিবাসী বিশ্লেষকরা বলছেন, মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশ থেকে শ্রমিকদের জোর করে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে, যা আন্তর্জাতিক আইনের স্পষ্ট লঙ্ঘন। তাঁরা বলছেন, এ বিষয়ে সরকারের দ্বিপক্ষীয় তৎপরতা বাড়ানো উচিত। পাশাপাশি, এসব বিষয় তুলে ধরতে হবে আন্তর্জাতিক ফোরামগুলোতে। করোনায় দীর্ঘ হচ্ছে ক্ষতির পরিধি, বিমান বন্দর বন্ধ কিন্তু থামছে না শ্রমিক আসা।

প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী ইমরান আহমদ গণমাধ্যমকে বলেন, ‘এই করোনা মহামারির কারণে ওরা এবং আমরা উভয়ই ক্ষতিগ্রস্ত। এ কারণে সেখান থেকে বৈধ প্রবাসী শ্রমিকদের ছাঁটাই করে নিজ নিজ দেশে ফেরত পাঠাচ্ছে। পাশপাশি বৈধ কাগজপত্রহীন শ্রমিকের তো অনেক আছে। ইতিমধ্যে সমস্যায় থাকা ৩০টি দূতাবাসের মাধ্যমে প্রায় ১০ কোটি টাকা প্রদান করা হয়েছে প্রবাসীদের জন্য। এছাড়া ফেরত আসা প্রবাসী শ্রমিকদের পুনর্বাসনের জন্য স্বল্প সুদে ঋণ প্রদানের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

 

সুত্রঃ কালের কণ্ঠ