করোনায়ও ব্যবসা ধরে রেখেছে সুপারশপগুলো, আক্রান্ত হয়নি কোনো কর্মী

মাছ-মাংস, সবজি, মসলা কিংবা গৃহস্থালি পণ্য—সব কিছুই এক ছাদের নিচে নির্ধারিত দামে পাওয়ায় আগে থেকেই এক শ্রেণির ভোক্তার কাছে জনপ্রিয় ছিল সুপারশপ। করোনাভাইরাস আসার পর নিরাপদ ও ঝুঁকিমুক্ত কেনাকাটার জন্য এটি আরো জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। আগে যাঁরা বাজার করার ক্ষেত্রে বাসাবাড়িসংলগ্ন বা কাছের বাজারগুলোকে বেছে নিতেন, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে করোনার ঝুঁকি এড়িয়ে স্বাচ্ছন্দ্যে বাজার করতে তাঁদের অনেকেই ঝুঁকেছেন সুপারশপগুলোতে। ফলে স্বপ্ন, আগোরা, মীনা বাজারসহ দেশের সুপারশপের আউটলেটগুলোতে ক্রেতার কমতি ছিল না কখনোই। জানা যায়, গত মার্চ-এপ্রিলের দিকে সুপারশপের বিক্রিও বেড়েছে ২০ থেকে ৩০ শতাংশ পর্যন্ত। যদিও উদ্যোক্তারা বলছেন, এ সময় চাল-ডালসহ নিত্যপণ্য ও সুরক্ষা পণ্যই বিক্রি হয়েছে বেশি। গার্মেন্ট ও প্রসাধনীসহ অন্য পণ্যগুলোর চাহিদা এ সময় একেবারেই কমে গেছে। করোনার এই সময়ে আউটলেটগুলো চালু রাখতেও নানা প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। সব কিছু উপেক্ষা করে ব্যবসা এবং সাধারণ মানুষের জীবনযাপন সহজ করতে আউটলেটগুলো খোলা রেখেছেন উদ্যোক্তারা। এ সময় পণ্যের সরবরাহ ও স্বাস্থ্য সুরক্ষার চিন্তাই ছিল অগ্রাধিকার। ক্রেতারাও আস্থা নিয়ে আউটলেটগুলোতে কেনাকাটা করছেন। এই আস্থাকেই তাঁরা এ খাতের বড় সাফল্য হিসেবে দেখছেন।

জানা যায়, দেশে প্রথম করোনার রোগী শনাক্ত হয় গত ৮ মার্চ। এর আগে থেকেই বিশ্বব্যাপী করোনার প্রাদুর্ভাব ছড়িয়ে পড়ায় দেশের মানুষ অনেক সুরক্ষা পণ্য কেনা বাড়িয়ে দেয়। এরপর ২৬ মার্চ থেকে দেশে লকডাউনের খবর ছড়িয়ে পড়লে সব ধরনের নিত্যপণ্যের কেনাকাটা হঠাৎ বেড়ে যায়। বাজারগুলোতেও পণ্যের সংকটে দাম বাড়তে থাকে। কিছু মানুষ স্বাস্থ্যঝুঁকি এড়িয়ে পণ্য কিনতে ছুটে যান সুপারশপগুলোতে। কেউ কেউ পণ্য কিনতে থাকেন প্রয়োজনের চেয়ে কয়েক গুণ বেশি। এ অবস্থায় ১৮ মার্চ বাংলাদেশ সুপারমার্কেট ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএসওএ) পক্ষ থেকে পর্যাপ্ত পণ্য মজুদ রয়েছে বলে এক বিবৃতিতে জানানো হয়। তাই করোনাভাইরাস (কভিড-১৯) আতঙ্কে অতিরিক্ত পণ্য না কেনার আহ্বান জানায় সংগঠনটি।

এরপর ছুটি শুরু হলে সংকট আরো ঘনীভূত হয়। এ সময় দেশে করোনা রোগীর সংখ্যা বাড়তে থাকে। বাজারের সময় কমিয়ে দুপুর ১২টা পর্যন্ত করা হয়। তবে সুপারশপ খোলা রাখার সময় ৬টা পর্যন্ত থাকে। একদিকে বাজারের সময় কমিয়ে আনা, অন্যদিকে সব কিছু বন্ধ হওয়ার শঙ্কা। দুয়ে মিলে বাজারগুলোতে বেড়ে যায় ক্রেতাসমাগম। এতে সংক্রমণের ঝুঁকি বেড়ে যায় বাজারগুলোতে। এ ছাড়া পণ্যের সংকট ও দামও লাগামহীন বাড়তে থাকে। তবে এসব ঝামেলা ছিল না সুপারশপগুলোতে।

উদ্যোক্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ছুটির এই সময়গুলোতে তারা নানা ধরনের সমস্যা মোকাবেলা করেছেন আউটলেটগুলো খোলা রাখতে গিয়ে। প্রথমত, বিক্রয়কর্মীরা করোনার ঝুঁকি নিয়ে কাজে আসতে চাইতেন না। কর্মীদের সংখ্যা কমে গিয়েছিল ৫০ শতাংশের মতো। তাঁদের নানাভাবে প্রেষণা দিয়ে কাজে রাখতে হয়েছে। এ ছাড়া নানা সংকটে অনেক পণ্যের সরবরাহও ব্যাহত হয়েছে। তবে তাঁরা পণ্যের সরবরাহ সমস্যার দ্রুত সমাধান করেছেন। নিজেদের ডেলিভারি ভ্যানগুলোকে অতিরিক্ত ব্যবহার করে পণ্যের সরবরাহ ঠিক রাখা হয়েছে। যথাযথ স্বাস্থ্য সুরক্ষার বিষয়গুলো পরিপালন করেছেন। ছোট আয়তনের আউটলেটগুলোতে করেছেন টোকেন পদ্ধতি। যাতে নির্দিষ্ট সংখ্যক ক্রেতার বেশি ঢুকতে না পারেন।

বিএসওএর সাধারণ সম্পাদক জাকির হোসেন  বলেন, ৮ মার্চের পর যখন দেশে একটা রব ওঠে সব কিছু বন্ধ হয়ে যাবে, তখনই আমরা সুপারশপগুলোর মালিকদের নিয়ে জরুরিভাবে বসেছিলাম। সেখানে আমরা আলোচনা করেছি, যদি সব কিছু বন্ধ হয়ে যায় তাহলে মানুষের কেনাকাটায় সমস্যা হবে। বিশেষ করে খাদ্যপণ্যের সরবরাহে ব্যাঘাত ঘটবে। এটা যাতে না হয় এ জন্য আমাদের শপগুলো খোলা রাখতে হবে এবং পণ্যের সরবরাহ ঠিক রাখতে হবে। শেষ পর্যন্ত এটা আমরা করতে পেরেছি। হঠাৎ কেনাকাটা বেড়ে যাওয়ায় পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বাজারগুলোতে পণ্যের সরবরাহ ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছিল। কিন্তু আমাদের সুপারশপগুলোতে এটা হয়নি। আমরা অনেক প্রতিকূলতার মাঝেও পণ্যের সরবরাহ ঠিক রেখেছি। এই সঙ্গে হ্যান্ড স্যানিটাইজার দেওয়া, নির্দিষ্ট দূরত্ব বজায় রাখাসহ সব ধরনের সুরক্ষাব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।’

জানা যায়, সুপারশপের বাজারে বড় ব্র্যান্ড ছয়টি—স্বপ্ন, আগোরা, মীনা বাজার, প্রিন্স বাজার, সিএসডি ও ডেইলি শপিং। সবচেয়ে বেশি আউটলেট এসিআই লজিস্টিকসের সুপারশপ ব্র্যান্ড স্বপ্নের। স্বপ্ন যাত্রা শুরু করে ২০০৮ সালে। মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছানোর বিষয়ে নজর দিয়ে তারা নিজস্ব ৫৯টি ও ফ্র্যাঞ্চাইজির ভিত্তিতে ৬৭টি মিলিয়ে মোট ১২৬টি স্টোর খুলেছে।

রাজধানীর মগবাজার, বিজয়নগর, বাসাবো, মুগদা, মানিকনগর, গোপীবাগসহ বিভিন্ন এলাকার সুপারশপগুলো ঘুরে দেখা যায়, প্রবেশপথেই নিরাপত্তাকর্মীরা ক্রেতাদের হাতে হ্যান্ড স্যানিটাইজার দিয়ে প্রবেশ করাচ্ছেন। বিক্রয়কর্মীরা থাকছেন নির্দিষ্ট দূরত্বে এবং সুরক্ষা পোশাকে। মাস্ক ছাড়া ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না কোনো আউটলেটেই। ভেতরের ট্রলিগুলোকে নির্দিষ্ট সময় পর পর জীবাণুমুক্ত করার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। লাইনে প্রবেশের ক্ষেত্রে দূরত্ব বজায় রাখতে বলা হচ্ছে। ক্রেতা বেশি হলে টোকেন পদ্ধতিতে প্রবেশ করতে দেওয়া হচ্ছে।

করোনায় আক্রান্ত নেই সুপারশপের কোনো বিক্রয়কর্মী

টানা চার মাস করোনার প্রকোপের মধ্যেও সুপারশপগুলোর কোনো বিক্রয়কর্মীই আক্রান্ত হননি। বিএসওএ এবং বিভিন্ন সুপারশপের সঙ্গে কথা বলে বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া গেছে।

 

সুত্রঃ কালের কণ্ঠ