করোনার ভয়াবহতা শেষের ইঙ্গিত দিচ্ছে ওমিক্রন

বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাসের নতুন ধরন ওমিক্রন দ্রুত ছড়ালেও রোববার পর্যন্ত এতে কোনো মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়নি। এমন তথ্য জানিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও)। ভাইরাসটির ডেলটাসহ অন্যান্য ধরন সংক্রমিত হয়ে এ পর্যন্ত বিশ্বে প্রায় ৫৩ লাখ মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন।

আগের ধরনগুলো যতটা প্রাণঘাতী ছিল ওমিক্রন সে রকম নয় বলে জানিয়েছেন আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞরা। ইতোমধ্যে নতুন ধরনটির মধ্যে ‘সাধারণ ঠান্ডার ভাইরাসের জিনগত বৈশিষ্ট্য’ পাওয়ার কথা জানিয়েছেন চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা। তারা দীর্ঘদিন ধরে সতর্ক করে বলছেন, করোনা কখনও নির্মূল হওয়ার সম্ভাবনা নেই, তবে এটি হালকা ঠান্ডার ভাইরাসে রূপান্তরিত হবে।

বিজ্ঞানীদের মতে, নতুন ধরনটি হালকা অসুস্থতার কারণ হলে ‘করোনার মহামারি ভয়াবহতা শেষের দিকে ধাবিত’ হওয়ার গতি ত্বরান্বিত হবে। দক্ষিণ আফ্রিকায় ওমিক্রন ধরনে সংক্রমিত রোগীদের হাসপাতালে ভর্তি হার খুবই কম এবং মৃত্যুর রেকর্ড নেই। তবে বিজ্ঞানীরা বলছেন, এর ভয়াবহতা সম্পর্কে নিশ্চিত হতে হলে কমপক্ষে দুই সপ্তাহ পর্যবেক্ষণ করতে হবে।

দক্ষিণ আফ্রিকার বিজ্ঞানীরা বলেছেন, ওমিক্রনে সংক্রমিত রোগীরা অল্পবয়সি ও তাদের হালকা লক্ষণ রয়েছে? এগুলোর মধ্যে রয়েছে ক্লান্তি, মাথা ও পেশি ব্যথা এবং রোগী কয়েক দিনের মধ্যে সুস্থ হয়ে উঠছে।

জার্মান স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ বলেছেন, নতুন ধরনটি শুধু হালকা অসুস্থতার কারণ হলে তা বড় সুখবর হবে। জার্মানির ক্লিনিকাল মহামারি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক কার্ল লাউটারবাখ বলেন, ‘প্রাথমিক তথ্য-উপাত্ত অনুযায়ী ওমিক্রন আগামী ক্রিসমাস বড় উপহার হতে পারে এবং এটি মহামারিটির সমাপ্তি ত্বরান্বিত করতে পারে।

অধ্যাপক কার্ল জার্মানির পরবর্তী স্বাস্থ্যমন্ত্রী হওয়ার দৌড়ে রয়েছেন। তিনি বলেন, ওমিক্রনের অনেক মিউটেশন রয়েছে- ৩২টি স্পাইক প্রোটিন, যা ডেলটার দ্বিগুণ-যার অর্থ এটি অধিক সংক্রামক ও কম প্রাণঘাতী। বেশিরভাগ শ্বাসযন্ত্রের ভাইরাস যেভাবে বিকশিত হয় তার সঙ্গে এটি সামঞ্জস্যপূর্ণ।

ইস্ট অ্যাঙ্গলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক পল হান্টার বলেন, এ তত্ত্বটি ‘সত্য প্রমাণিত হতে পারে’। কিন্তু উচ্চমাত্রার পূর্ববর্তী সংক্রমণ ও টিকা-ধরনটির বিরুদ্ধে সুরক্ষা প্রদান করতে হবে। তিনি বলেন, এটি ইতিবাচক লক্ষণও হতে পারে। কারণ আমরা জানি, উচ্চ সংক্রামক ধরনে কোভিড আক্রান্ত ব্যক্তির বেঁচে থাকা বা টিকার কার্যকারিতা বেশি থাকে।

গবেষকরা বলছেন, ওমিক্রন সাধারণ ঠান্ডা-জ্বরের জন্য দায়ী অপর একটি ভাইরাসের জিনগত উপাদানের অংশকে বেছে নিয়ে নিজের বিন্যাস ঘটিয়েছে। সার্স-কভ-২ ভাইরাসের আগের কোনো সংস্করণেই এ জিনগত বিন্যাসের উপস্থিতি ছিল না। সাধারণ ঠান্ডা-জ্বরসহ অন্যান্য অনেক ভাইরাসের ক্ষেত্রে এটি দেখা যায়।

কেমব্রিজ ম্যাসাচুসেটসভিত্তিক ডেটা বিশ্লেষণী প্রতিষ্ঠান এনফারেন্সের কর্মকর্তা ভেনকি সৌন্দরাজন বলেছেন, জিনগত বিশেষ এ বিন্যাস ঘটিয়ে ওমিক্রন নিজেকে মানুষের শরীরে প্রবেশের জন্য আরও বেশি উপযোগী করে তুলেছে, যা তাকে মানুষের শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে ফাঁকি দিতে সহায়তা করেছে।

বৃহস্পতিবার ওএসএফ প্রিপ্রিন্টসের সার্ভারে এ গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছে। এর অর্থ ভাইরাসটি সম্ভবত আরও সহজে সংক্রমণ ঘটাতে পারে; যা শুধু হালকা বা উপসর্গহীন রোগ হয়ে যায়।

এবার ভারতের দিল্লিতে শনাক্ত : ভারতের দিল্লিতে প্রথমবার ওমিক্রন আক্রান্ত একজন রোগী শনাক্ত হয়েছেন। এর মধ্য দিয়ে দেশটিতে করোনার নতুন এ ধরনে আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে পাঁচে দাঁড়িয়েছে।

দিল্লির স্বাস্থ্যমন্ত্রী সত্যেন্দর জৈন রোববার জানিয়েছেন, ওই ব্যক্তি সম্প্রতি আফ্রিকার দেশ তানজানিয়া থেকে ফিরেছেন, তিনি এখন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। ভারতে প্রথম দুই রোগী শনাক্ত হন কর্নাটকের বেঙ্গালুরু শহরে। এরপর গুজরাটের জামনগরে একজন ও মহারাষ্ট্রের মুম্বাইয়ে একজন রোগী শনাক্ত হন। চতুর্থ কোনো স্থান হিসাবে এবার দিল্লিতে ওমিক্রন শনাক্ত হলো।

যুক্তরাজ্য-যুক্তরাষ্ট্রে ভ্রমণ কড়াকড়ি : ব্রিটিশ সরকার জানিয়েছে, যুক্তরাজ্যে প্রবেশের আগে ভ্রমণকারীদের করোনা পরীক্ষা করাতে হবে। ব্রিটিশ স্বাস্থ্যমন্ত্রী সাজিদ জাভিদ বলেছেন, মঙ্গলবার বিকাল ৪টা থেকে নতুন বিধিনিষেধ কার্যকর হবে। নতুন বিধিনিষেধের আওতায় অন্য দেশ থেকে যুক্তরাজ্যে যেতে চাওয়া মানুষদের যাত্রার সর্বোচ্চ ৪৮ ঘণ্টা আগে করোনা পরীক্ষা করাতে হবে। ১২ ও তার চেয়ে বেশি বয়সিদের ক্ষেত্রে এ নিয়ম কার্যকর হবে।

লাল তালিকাভুক্ত দেশগুলো থেকে যুক্তরাজ্যে এলে বাধ্যতামূলকভাবে ১০ দিনের হোটেল কোয়ারেন্টিনে থাকতে হয়। ভ্রমণকারীদের করোনার নেগেটিভ রিপোর্ট বাধ্যতামূলক করছে যুক্তরাষ্ট্র। আজ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে নতুন বিধিনিষেধ কার্যকর হবে বলে জানিয়েছে সেন্টার্স ফর ডিজেজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন (সিডিসি)। নতুন নির্দেশনা অনুযায়ী, সব ভ্রমণকারীকে ভ্রমণের একদিন আগের করোনার নেগেটিভ রিপোর্ট দেখাতে হবে।

এছাড়া ভ্রমণের অন্তত ৯০ দিন আগে করোনা থেকে সুস্থ হওয়ার সার্টিফিকেট দেখাতে হবে।

মানুষ থেকে প্রাণীতে গেলে নতুন ধরনের ঝুঁকি বাড়ে : মানুষ থেকে প্রাণীর দেহে করোনার সংক্রমণের মধ্য দিয়ে ভাইরাসটির নতুন নতুন ধরন তৈরির ঝুঁকি বাড়ে। যুক্তরাষ্ট্রের কলোরাডো বিশ্ববিদ্যালয়ের কলেজ অব ভেটেরিনারি মেডিসিন অ্যান্ড বায়োমেডিক্যাল সায়েন্সেসের গবেষক দল এ দাবি করেছে।

সম্প্রতি ন্যাশনাল একাডেমি অব সায়েন্সেসের সাময়িকী ‘পিএনএএস’-এ গবেষণা প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়। মুখ্য গবেষক ও পেনসিলভানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্যপ্রাণীর রোগসংক্রান্ত বিশ্লেষক এরিক গানি জানান, মানুষ বিভিন্ন ধরনের প্রাণীর সংস্পর্শে আসে। আর এর মধ্য দিয়ে ভিন্ন ভিন্ন প্রজাতির প্রাণীকে সংক্রমিত করার সুযোগ পেয়ে যায় ভাইরাসটি।

গবেষক লরা বাশর জানান, সাধারণত দেখা যায় ভাইরাসগুলো এক প্রজাতির প্রাণী থেকে অন্য প্রজাতিতে ছড়াতে পারে না। সুনির্দিষ্ট প্রজাতির মধ্যে তাদের সংক্রমণ সীমিত থাকে। কিন্তু সার্স-কভ-২ ভাইরাসের বিস্তৃত প্রজাতিকে আক্রান্ত করার সক্ষমতা রয়েছে।

 

সুত্রঃ যুগান্তর