করোনার প্রভাবে রফতানি আয়ে বড় ধাক্কা

করোনাভাইরাসের প্রভাবে দেশের রফতানি আয়ে বড় ধাক্কা লেগেছে। সদ্য বিদায়ী ২০১৯-২০ অর্থবছরে রফতানি আয়ে লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় ঘাটতি হয়েছে প্রায় ২৬ শতাংশ। এর আগের অর্থাৎ ২০১৮-১৯ অর্থবছরের তুলনায় বিদায়ী অর্থবছরে রফতানি আয় কম হয়েছে প্রায় ১৭ শতাংশ। স্মরণকালের মধ্যে রফতানি আয়ে এতবড় পতন দেখা যায়নি।

রোববার রফতানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) থেকে বিদায়ী অর্থবছরের রফতানি আয়ের বিষয়ে একটি প্রতিবেদন তৈরি করা হয়। ওই প্রতিবেদন থেকে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।

সংশ্লিষ্টরা জানান, করোনার প্রভাবে বাংলাদেশসহ বিশ্বজুড়ে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে স্থবিরতা দেখা দেয়। এর প্রভাবে ব্যবসা-বাণিজ্যে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। এমন পরিস্থিতিতে ক্রেতারা বাংলাদেশের প্রধান রফতানি পণ্য তৈরি পোশাকের প্রায় ৩৫০ কোটি ডলারের কার্যাদেশ বাতিল করে দেয়। অন্যান্য খাতেও নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। এমন কি তৈরি পণ্যও বিদেশে রফতানি করা সম্ভব হয়নি। এসব কারণে রফতানি আয় ভয়াবহভাবে কমে গেছে।

ইপিবির প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, বিদায়ী অর্থবছরের রফতানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৪ হাজার ৫৫০ কোটি ডলার। এর বিপরীতে আয় হয়েছে ৩ হাজার ৩৬৭ কোটি ডলার। লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় আয় কমেছে ২৬ শতাংশ। এর আগের ২০১৮-১৯ অর্থবছরে রফতানি আয় হয়েছিল ৪ হাজার ৫৪ কোটি ডলার। এ অর্থবছরের তুলনায় আয় কমেছে প্রায় ১৭ শতাংশ।

সূত্র জানায়, বাংলাদেশের মোট রফতানি আয়ের মধ্যে তৈরি পোশাকের অবদান প্রায় ৮৪ শতাংশ। রফতানি আয় তৈরি পোশাক শিল্প খাত নির্ভর বলে এ খাতে আয় সামান্য কমে গেলেই পুরো রফতানি আয়ে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। আলোচ্য অর্থবছরে পরিমাণে সবচেয়ে বেশি রফতানি আয় কমেছে তৈরি পোশাকের। বিদায়ী অর্থবছরে তৈরি পোশাক খাতে রফতানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল ৩ হাজার ৮২০ কোটি ডলার। আয় হয়েছে ২ হাজার ৭৯৪ কোটি ৯১ লাখ ডলার। লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় প্রায় ২৭ শতাংশ। এছাড়া ২০১৮-১৯ অর্থবছরের তুলনায় রফতানি আয় কম হয়েছে ১৮ দশমিক ১২ শতাংশ।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ নিটওয়্যার প্রস্তুতকারক ও রফতানিকারক সমিতি (বিকেএমইএ) প্রথম সহ-সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, করোনার প্রভাবে বিক্রি না হওয়ায় ক্রেতাদের কাছে আগের পণ্য মজুদ রয়ে গেছে। এ অবস্থায় আগামীতে রফতানি আদেশ আরও আশঙ্কাজনক হারে কমে যেতে পারে। দেশের পোশাক খাতের ইতিহাসে রফতানি আয়ে এ ধস এর আগে কখনও দেখেননি উদ্যোক্তারা।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ রফতানিকারক সমিতির সভপাতি আবদুস সালাম মুর্শেদী বলেন, তৈরি পোশাক রফতানিতে বড় ধরনের বিপর্যয় যাচ্ছে। খাতটি বিদায়ী অর্থবছরের শুরু থেকেই সংকটের মধ্যে ছিল। ফলে রফতানি আয় কম হচ্ছিল। করোনার ধাক্কায় আয় আরও কমে গেছে। সামনের দিনগুলোতে আরও বড় চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হবে।

প্রতিবেদন থেকে পাওয়া তথ্যে দেখা যায়, অর্থবছরের শুরু থেকেই রফতানি আয় কমছে। এর মাঝে কয়েক মাস সামান্য বাড়লেও করোনার ধাক্কায় মার্চ থেকে রফতানি আয়ে ধস নামে। যে ধারা অর্থবছরের শেষ পর্যন্ত ছিল। ফলে প্রায় সব খাতেই রফতানি আয় কমেছে।

এদিকে বিজিএমইএ সূত্র জানায়, করোনার কারণে পরিস্থিতি এতটা খারাপ হয়েছে যে নতুন রফতানি আদেশও খুব বেশি আসছে না। কারণ বিশ্ববাজারে চাহিদা কমে এসেছে। কবে নাগাদ এ অবস্থা কাটবে তাও বলা যাচ্ছে না। এছাড়া করোনা পরিস্থিতিতে বিজিএমইএর সদস্যভুক্ত কারখানার মধ্যে ৩৪৮টি বন্ধ হয়েছে গত ২ মাসে। এ ছাড়া বেশকিছু কারখানা টিকে থাকার লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে।

প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০১৯-২০ অর্থবছরের চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যে রফতানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল ১০৯ কোটি ৩০ লাখ ডলার। আয় হয়েছে ৭৯ কোটি ৭৬ লাখ ডলার। আয় কম হয়েছে ২৭ শতাংশ। এছাড়া ২০১৮-১৯ অর্থবছরের তুলনায় রফতানি কমেছে ২১ দশমিক ৭৯ শতাংশ।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ ফিনিশড লেদার, লেদারগুডস ফুটওয়্যার অ্যান্ড এক্সপোর্টার অ্যাসোসিয়েশন (বিএফএলএফইএ) সভাপতি মহিউদ্দিন আহমেদ মাহিন বলেন, করোনা পরিস্থিতির কারণে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের রফতানি আয়ে বড় ধরনের ধস নেমেছে। আর এ রকম অস্থির পরিস্থিতিতেই এবার কোরবানি ঈদে চামড়া সংগ্রহের প্রস্তুতি নিতে হচ্ছে। সবাই আর্থিক সংকটে আছে। পরিস্থিতি কোন দিকে যাবে, বোঝা যাচ্ছে না।

প্রতিবেদনে বলা হয়, ফ্রোজেন ও লাইভ ফিশ খাতে বিদায়ী অর্থবছরে রফতানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল ৫২ কোটি ডলার। আয় হয়েছে ৪৫ কোটি ৪১ লাখ ডলার। ওই সময়ে আয় কমেছে ১২ দশমিক ২৮ শতাংশ। কৃষি পণ্য রফতানি খাতে আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল ১১২ কোটি ডলার। আয় হয়েছে ৮৬ কোটি ২০ লাখ ডলার। কমেছে ২৩ শতাংশ। উৎপাদন খাতে রফতানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল ৪ হাজার ৩৮৬ কোটি ডলার।

আয় হয়েছে ৩ হাজার ২৩৫ কোটি ৫৮ লাখ ডলার। কম হয়েছে ২৬ দশমিক ২৩ শতাংশ। রাসায়িক পণ্য খাতে আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল ২৮ কোটি ২০ লাখ ডলার। আয় হয়েছে ১৯ কোটি ৮৮ লাখ ডলার। আলোচ্য সময়ে ঘাটতি হয়েছে ২৯ দশমিক ৪৮ শতাংশ। এর বাইরে পাট ও পাটজাত পণ্যের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল ৮২ কোটি ৪০ লাখ ডলার। আয় হয়েছে ৮৮ কোটি ২৩ লাখ ডলার। লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় আয় বেশি হয়েছে ৭ শতাংশ।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ জুট ডাইভারসিফায়েড প্রডাক্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ও ক্রিয়েশন প্রাইভেট লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. রাশেদুল করীম মুন্না বলেন, বহুমুখী পণ্য উৎপাদনের কারণে পাটের সম্ভাবনা অফুরন্ত। সম্ভাবনাময় আন্তর্জাতিক বাজারের ১০ শতাংশ দখল করতে পারলেও শুধু এ পাট দিয়েই বছরে ৫০ হাজার কোটি টাকা আয় করা সম্ভব। আগামী বছর থেকে পাট শিল্প থেকে বছরে কয়েক বিলিয়ন ডলার আয় করা মোটেও কোনো স্বপ্ন নয়।

 

সুত্রঃ যুগান্তর